জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, বাড়তি ব্যয়, সংসারের চাকা ঘুরছে না রাইড শেয়ার করা চালকদের
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করতেন মাহবুবুল আলম মাসুদ। করোনার মধ্যে চাকরি হারান তিনি।
বেশ কিছুদিন বেকার থাকার পর স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে একটি মোটরসাইকেল কিনে চট্টগ্রামে রাইড শেয়ারিং শুরু করেন তিনি। মাহবুবুলের উপার্জনে টেনেটুনে ভালোই চলছিল সংসার। কিন্তু জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে রাইডে যেমন যাত্রীও কমেছে তেমনি খরচও বেড়েছে। তাই জীবন ধারণের খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।
মাহবুবুল আলম মাসুদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "করোনার মধ্যে চাকরি হারিয়ে রাইড শেয়ারিং শুরু করার পরে আমার পরিবারের মুখে হাসি ফিরেছিলো। সদ্য বাবা হয়েছি, খরচও বেড়েছে। কিন্তু সরকার হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম প্রায় দ্বিগুণ করে দিয়েছে।"
"আপনি কল্পনা করতে পারবেন না কী পরিমাণ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে আমাদের। করোনাকালের সেই ভয়াবহ স্মৃতি আবার স্বরণ করিয়ে দিচ্ছে এই দুঃসময়," বলেন তিনি।
ঢাকায় রাইড শেয়ার করা মো. আজাদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরির পাশাপাশি সন্ধ্যা থেকে ৩/৪ ঘণ্টা রাইড শেয়ার করি। তেলের দাম বাড়ার আগে প্রতিদিন ১০০০ টাকার মতো পাঠাও ও উবারে রাইড শেয়ার করতে পারতাম। সেখানে সব খরচ গিয়ে ৪০০-৫০০ টাকার মতো থাকতো। যা দিয়ে নিজের হাত খরচ এবং সন্তানদের ছোট ছোট আবদার মেটাতে পারতাম। কিন্তু তেলের দাম বাড়ার পরে এখন ২০০ টাকা হাতে নিয়েও বাসায় ফিরতে পারি না। এভাবে চলতে থাকলে ঢাকায় টিকে থাকাই কষ্টকর হয়ে যাবে।"
মাহবুবুল আলম মাসুদ ও আজাদ হোসেনের মতো দেশের লাখো পরিবারের জীবন জীবিকা এখন রাইড শেয়ারিংয়ের উপর নির্ভর করে। মোটরসাইকেলের চাকা ঘুরলে ঘুরে এসব সংসারের চাকা। আর এ দুই চাকা থেমে গেলে থমকে যায় জীবিকা। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি রাইড শেয়ারিং চালকদের জীবনে নিয়ে এসেছে অমানিশার অন্ধকার।
প্রায় দ্বিগুণ মূল্যের জ্বালানীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মগুলোর ট্রিপের বাড়তি ভাড়া। অন্যদিকে সিএনজি চালিত অটোরিকশা যাত্রী পরিবহন করছে আগের দামেই। ফলে যাত্রী পরিবহনে পিছিয়ে পড়েছেন বাইক রাইডাররা। চালকরা বলছেন, সব মিলিয়ে রাইড শেয়ারিং এখন অনিশ্চিত পেশা হয়ে গেছে। এমন বাস্তবতায় অনেকে ভিন্ন পেশা খুঁজছেন।
শুধু তাই নয় অনেকেই এখন এ্যাপসের মাধ্যমে রাইড শেয়ার না করে কন্ট্রাক্টেই যাত্রী পরিবহন করছেন। ফলে একদিকে বাড়ছে ঝুঁকিও, আবার যাত্রীদের অনেক সময় বাড়তি ভাড়াও গুণতে হচ্ছে।
রাইড শেয়ার করা পাঠাও-উবারসহ কন্ট্রাক্টে শেয়ার করা একাধিক মোটরসাইকেল চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনার কারণে দেশের অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী বেকার হয়েছেন। জীবিকার তাগিদে তারা রাইড শেয়ারিংকে পেশা বেছে নিয়েছেন। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাত্রী পরিবহন করেন তারা।
তেলের দাম বৃদ্ধির আগে কোনোদিন ৫০০-৭০০ টাকা, কোনোদিন ১ হাজার টাকাও উপার্জন হতো। যা দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করতেন তারা। কিন্তু এখন সে আয় নেমে এসেছে অর্ধেকেরও নিচে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "বর্তমানে প্রায় ১২ লক্ষ বাইকার রাইড শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে সারাদেশে দৈনিক প্রায় ৫০ লক্ষ ট্রিপ যাত্রী পরিবহন করছে। পেট্রল ও অকটেনের দাম একসঙ্গে প্রায় ৫০ টাকা বেড়ে যাওয়ায় রাইডাররা যাত্রী কম পাচ্ছেন। এতে তাদের জীন চালানো দুস্কর হয়ে উঠেছে।"
ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকায় রাইড শেয়ার করা মোহাম্মদ জামিল বলেন, "২ লক্ষ টাকা দিয়ে বাইক কিনে এরপর সেটির সার্ভিসিং খরচ, রোডে বাইক চলার ট্যাক্স, ১৩৫ টাকা লিটার তেল খরচ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাইড শেয়ার করছি। এরপরেও আমরা কোনো সুযোগ সুবিধা পাচ্ছি না। মনে হয় ভিক্ষা করছি।"
চট্টগ্রামে রাইড শেয়ার করা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য রফিকুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর এই মোটর সাইকেলটি আমার জীবন জীবিকার প্রধান উৎস। পরিবারের ভরণ-পোষন, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চলে এই আয় থেকেই। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর থেকে ভাড়ার পরিমাণ কমে গেছে। অন্যদিকে আগের দামে ভাড়া টেনে পোষানো যাচ্ছেনা।"
চট্টগ্রামের মোটরসাইকেল চালক রফিকুল ইসলাম টিবিএসকে জানান, এক লিটার অকটেন দিয়ে ৪০ কিলোমিটার রাইড দেওয়া যায়।
"সে হিসেবে আমরা ১ কিলোমিটার ১০ টাকা হিসেবে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নিতাম। কিন্তু এখন অকটেনের দাম বেড়েছে প্রতি লিটারে ৪৬ টাকা। কিন্তু যাত্রীরা সেই বাড়তি টাকা দিতে রাজি হচ্ছেন না। ফলে আগে যেখানে দৈনিক ১ হাজার টাকা উপার্জন হতো, সেখানে এখন হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। এ দিয়ে সংসার চলে না," বলেন তিনি।
এদিকে নতুন নিয়ম অনুযায়ী, ঢাকায় পাঠাওয়ের বাইক শেয়ারিংয়ে কিলোমিটার প্রতি ভাড়া ১২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫ টাকা করা হয়েছে। চট্টগ্রামে কিলোমিটার প্রতি ভাড়া ১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২.৫ টাকা করা হয়েছে। সিলেটে কিলোমিটার প্রতি ভাড়া ৬.৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮.৫ টাকা করা হয়েছে। পাঠাওয়ের এই সিদ্ধান্তেও অসন্তুষ্ট রাইড শেয়ারিংয়ের চালকরা।
ঢাকা রাইড শেয়ারিং ড্রাইভার অ্যাসোসিয়েশনের (ডিআরডিইউ) সভাপতি বেলাল আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে যানজট, গণপরিবহন সংকট, ভাড়া নৈরাজ্য ও যাত্রী সেবার মান তলানীতে পৌঁছানোর কারণে সময়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারিং চালু হয়েছিলো। পেট্রোল ও অকটেনের দাম বৃদ্ধি আমাদের জীবন জীবিকাকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। শ্রম আইনের অধীনে রাইড চালকদের স্বীকৃতি দেওয়া এখন সময়ের দাবি।"
তিনি আরও বলেন, পাঠাও রাইড শেয়ারিং এর রেট কিছু বাড়ালেও উবারের তেমন কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ে না। এর ফলে অনেকেই অ্যাপে রাইড শেয়ার না করে কন্ট্রাক্টে যাত্রী নেয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা আরও বেড়ে গেছে।
"আমরা আর এক সপ্তাহ দেখবো। যদি অ্যাপ ভিত্তির সেবায় চালকদের সুবিধা বাড়ানো না হয় তাহলে আমরা সবাই একসাথে অ্যাপ বয়কটের ঘোষণা দিবো," বলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, "যারা রাইড শেয়ার করে তাদের জন্য এ ধরনের গিগ ইকোনোমির কাঠামোগত তেমন কোনো রেগুলেশন নেই। এজন্য প্রথমেই দরকার সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে রেগুলেটরি ফরমেশনের মধ্যে নিয়ে আসা এবং রাইড শেয়ার কতজন করছে তার একটি তালিকা থাকা।"
"তারাও আমাদের অর্থনীতির একটা অংশ। এসব দিকে কাঠামোগত সংস্কার দরকার। এখানে যারা শ্রমিক আছেন তাদের ক্ষেত্রে শ্রম আইন কিছুটা হলেও মানা হচ্ছে কিনা সে বিষয়েও মালিকপক্ষের দিকে নজর রাখা দরকার সরকারের। এছাড়া এ ধরনের শ্রমিকদের কম্প্লেইন করার মতো কোনো রেগুলেটরি বডি নেই, তাই তাদেরকে সরকারের একটি পলিসির মধ্যে রাখা দরকার।"
তিনি আরও বলেন, "মূল্যবৃদ্ধির কারণে যেন শুধুমাত্র শ্রমিকরা কিংবা যাত্রীরা অতিরিক্ত ক্ষতির সম্মুখীন না হয় সেভাবেই বাস ভাড়া নির্ধারণের মতো একটি কমিটির মাধ্যমে রাইড শেয়ারের ভাড়াও নির্ধারণ করা উচিত। ক্ষতি হলে যেন সেটা মালিক পক্ষ এবং শ্রমিকদের উভয় পক্ষেই সমানভাবে হয়।"