বাণিজ্য তথ্যের নেপথ্য কাহিনি
২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো বছরের আমদানি ও রপ্তানির তথ্যে দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দেখা যায়। প্রথমত, ডলার সংকটের সঙ্গে জ্বালানি আমদানি বিলের তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। স্পষ্টতই দেশের বাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির অনেক আগে থেকেই এবং সব সূচকই যখন জ্বালানির চাহিদা বৃদ্ধির দিকে ইঙ্গিত করছিল, তখন থেকেই জ্বালানি আমদানি ব্যাপকভাবে কমে যায়।
দ্বিতীয়ত, সুতি কাপড়ের বৈশ্বিক চাহিদা বাড়ার সময়ে দেশে তুলা সংকটের শিকার হয় স্থানীয় স্পিনিং মিল ও তাঁতগুলো। তারা স্থানীয়ভাবে যথেষ্ট উৎপাদন করতে পারেনি। আপাতদৃষ্টিতে এটাই পোশাক খাতের 'অতিরিক্ত' আমদানির কারণ– যা তখন রপ্তানিকে চাঙ্গা করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে সাহায্য করেছিল।
তেল আমদানি বিল কমেছে!
ডলার ও জ্বালানি ঘাটতি নিয়ে মোটের ওপর যা বলা হয়, তার একাংশ হলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির কারণে জ্বালানি আমদানির পেমেন্ট বিল বেড়েছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, কথাটা সত্য নয়। ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট তেল আমদানি বিল ৯৯২ মিলিয়ন ডলার কম ছিল!
এক বছরে অপরিশোধিত তেলের পেমেন্ট কমেছে ৬৪ শতাংশ, অথচ এই সময়ে অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ বা তার বেশি। পেট্রোলিয়াম পণ্যের পেমেন্ট বেড়েছে মাত্র ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। শোধিত পেট্রোলিয়ামের মূল্যবৃদ্ধি বিবেচনায় শতাংশের হারে যা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। ডিজেলের দাম ২০২১ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২২ সালের জুনে দ্বিগুণের বেশি ছিল, আর অকটেনের দাম ছিল ৭৪ শতাংশ বেশি।
স্পষ্টতই জ্বালানি আমদানির পরিমাণ কমেছে। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি ক্রয় বন্ধের সিদ্ধান্তের সঙ্গে এই আমদানি হ্রাসের তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। সরকার ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে স্পট মার্কেট থেকে চড়ামূল্যে এলএনজি আমদানি না করার সিদ্ধান্ত নেয়। সরকার সর্বশেষ স্পট এলএনজি কার্গো কিনেছিল জুনে ডেলিভারির জন্য। প্রধান কারণ ছিল- ডিজেল আমদানি কম হওয়া। প্রসঙ্গত, দেশে মোট ব্যবহৃত জ্বালানির দুই-তৃতীয়াংশই ডিজেল।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করা কঠিন। গত ৬ আগস্টের আগপর্যন্ত দেশের বাজারে ডিজেলের দাম বাড়েনি। এছাড়া অর্থবছরের শেষ দিকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক চাপের নেতিবাচক প্রভাব শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে অর্থনীতি স্বাভাবিক হওয়ার পথেই ছিল। চাহিদার ওপর ভিত্তি করে দেওয়া কোনো ব্যাখ্যা হালে পানি পাবে না, কারণ সম্ভাব্য সব চাহিদাই বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে কেবল ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে।
তেল আমদানিতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) একচেটিয়া আধিপত্য রয়েছে। লোকসান দিতে শুরু করার কদিন আগপর্যন্তও বিপিসি সরকারের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল। কাজেই বিপিসির কাছে ২২ হাজার কোটি টাকা স্থায়ী আমানত থাকা সত্ত্বেও এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে, তহবিল সমস্যার কারণে আমদানি কমাতে হয়েছিল।
পর্যাপ্ত ডিজেলের মজুত নেই, এটা বুঝতে পারার আগপর্যন্ত সারা বছর ব্যাপারটি সবার অগোচরেই ছিল মনে হচ্ছে। ডিজেল আমদানি শৃঙ্খলে উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি। অন্য কোথাও একটা গলদ হয়েছে, যার সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি বা বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক জ্বালানি সরবরাহ চক্র থাকার সুফল সম্পর্কে আমরা আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশীর কাছ থেকে দু-একটি জিনিস শিখতে পারি। ভারতের অপরিশোধিত তেল আমদানি বিল ২০২২ সালের মার্চে শেষ হওয়া অর্থবছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ১১৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ২০২২ সালে দাম তুলনামূলক বেশি থাকতে পারে, তা আঁচ করতে পেরে ভারতীয় রিফাইনারি শিল্প কম ঘনত্বের ক্রুড তেল আমদানি বাড়িয়েছে।
২০২০ সালে ভারত ছিল পঞ্চম বৃহৎ পেট্রোলিয়াম পণ্য রপ্তানিকারক। তারপরও ২০২২ সালের জুনে ভারতের এই পণ্যগুলোর আমদানি মাসে সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চে পৌঁছে। এই অস্বাভাবিক উত্থানের কারণ স্থানীয় ঘাটতি, কেননা বেসরকারি পরিশোধনাগারগুলি বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধি থেকে লাভবান হওয়ার জন্য তাদের রপ্তানি বাড়িয়েছিল। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক দুর্দশার নতুন নতুন উৎসের মধ্যে জ্বালানি থাকায়– ভারতের অর্থনীতি এনিয়ে ভোগান্তিতে পড়েনি।
বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিতে জ্বালানি নিরাপত্তা এবং উচ্চ মানের, নির্ভরযোগ্য বিদ্যুতের সর্বজনীন সংযোগ সুবিধার সহায়তা প্রয়োজন। গত কয়েক দশকে বিদ্যুতের সিস্টেম লস কমাতে এবং সিস্টেমের নির্ভরযোগ্যতা (সময়কাল ও কত ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়, তা দিয়ে পরিমাপ করা হয়) বাড়ানোর বড় বড় পদক্ষেপগুলোকে ভঙ্গুর মনে হচ্ছে। গোটা বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ বিদ্যুৎহীনতার বিপর্যয় সহ্য করছে। গ্যাস ঘাটতি এর অন্যতম কারণ হতে পারে, কিন্তু একমাত্র কারণ নয়।
১ হাজার ২৯০ মেগাওয়াট সক্ষমতার দশটি ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যার ফলে সারা দেশে প্রতিদিন অনিয়মিত ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। এগুলো কারখানার উৎপাদন ব্যাহত করছে, ব্যয় বাড়াচ্ছে এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সেবা দানে বাধা দিচ্ছে। রাত ৮টার মধ্যে শপিংমল ও মার্কেট বন্ধ করতে হচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ বিদ্যুৎ না থাকায় ডিজেল জেনারেটরের ব্যবহার বেড়েছে।
সরকারি যুক্তি হলো, বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে সরকার কি পর্যাপ্ত মজুত না থাকায় জ্বালানি ফুরিয়ে আসার কারণে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে? বিপিসি কীভাবে কাজ করছে এবং অর্থনীতিতে এর প্রভাব কেমন—তার ভিত্তিতে এই দুটোর মধ্যে বিস্তর তফাত রয়েছে।
পোশাক-সংক্রান্ত 'অতিরিক্ত' আমদানি?
আগের অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ, এক দশকেরও মধ্যে যা সর্বোচ্চ উল্লম্ফন। আর পোশাক-সংক্রান্ত আমদানি বেড়েছে ৫৮ দশমিক ২ শতাংশ। সাধারণত, যদি আমদানি ও রপ্তানি মূল্য উভয়ই স্থিতিশীল থাকে এবং রপ্তানি ঝুড়ির পণ্য সমাহার একই থাকে– তাহলে উভয়ের প্রবৃদ্ধি হারও কাছাকাছি থাকে। যেমনটা দেখা গিয়েছিল, ২০২১-২২ অর্থবছরে, যখন মোট পোশাক রপ্তানিতে নিট পোশাক ও উভেন পোশাকের হিস্যায় পরিবর্তন আসেনি।
২০১৮ থেকে ২০২১ অর্থবছরের ৪৪ শতাংশ থেকে ৪৭ শতাংশ হিস্যার তুলনায় ২০২২ অর্থবছরে আরএমজি-সংক্রান্ত আমদানি অত্যধিক দেখায়। ২০২১ অর্থবছরে এই আমদানি ছিল ৪৫ শতাংশ, যা ২০২২ অর্থবছরে ৫২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০২২ অর্থবছরে ৪৫ শতাংশ হিস্যায় এই 'অতিরিক্ত' আমদানির পরিমাণ প্রায় ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে সুতা (৬৬ শতাংশ), বস্ত্র সামগ্রী (৩২ শতাংশ) ও কাঁচা তুলা (২ শতাংশ) আমদানিতে। পোশাক প্রস্তুতকারকরা চীন থেকেও নিট ফ্যাব্রিক আমদানি করেছেন।
তুলার মূল্যবৃদ্ধি, তুলার সরবরাহে উত্থান-পতন ও গ্যাসের ঘাটতি স্থানীয় স্পিনার ও তাঁতিদের সক্ষমতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। সাধারণত স্থানীয় স্পিনাররা নিটওয়্যারের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ৮৫ শতাংশ এবং ওভেন রপ্তানিকারকদের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ৪০ শতাংশ সরবরাহ করে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে, গত ২৩ মাসের মধ্যে ২০ বার বৃদ্ধির পর ২০২২ সালের মার্চে তুলার দাম ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে পৌঁছে। তুলার দাম বেড়ে যাওয়ায় সুতা ও ফ্যাব্রিকের দেশীয় উৎপাদকদের সমগ্র শিল্প চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৈশ্বিক কনটেইনার সংকটের কারণে তুলা সরবরাহ বিলম্বিত হয়েছে। গ্যাসের ঘাটতি টেক্সটাইল মিলারদের পুরোদমে সুতা ও ফ্যাব্রিক উৎপাদন করার সক্ষমতাকে চাপে ফেলেছে।
রপ্তানিকারকরা স্থানীয় সরবরাহের অনিশ্চয়তা মোকাবিলায় আমদানিতে বিদ্যমান লজিস্টিক বাধাগুলো অপসারণের দাবি করেছেন। আরএমজি রপ্তানিকারকরা শুল্কমুক্ত বন্ডেড ওয়্যারহাউসের সুবিধা কাজে লাগিয়ে মূলত ভারত, চীন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তান থেকে সুতা ও ফ্যাব্রিক সংগ্রহ করে। শুল্ক রেয়াত ও প্রত্যাবর্তন সুবিধার আওতাতেও তারা আমদানি করতে পারেন।
বর্তমানে বেনাপোল দিয়ে তুলা, সুতা, ফ্যাব্রিক ও অন্যান্য জিনিস আমদানি করা হয়; অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আংশিক আমদানি করা যায়। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা ধরে রাখার জন্য রপ্তানিকারকরা সমস্ত স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি করাসহ আংশিক শিপমেন্ট আনার অনুমতি দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
স্থানীয় তাঁতি ও স্পিনারদের সুরক্ষা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) এসব দাবির বিরোধিতা করেছে। বন্ডেড ওয়্যারহাউস 'লিকেজ', ত্রুটিপূর্ণ ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন, মিথ্যা পণ্য স্পেসিফিকেশন এবং ভারত থেকে চোরাচালানের সুবাদে ইতিমধ্যে আমদানিকৃত সুতা ও ফ্যাব্রিক যথাক্রমে ৯১ দশমিক ৪ শতাংশ ও ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক ফাঁকি করে দেশীয় বাজারে প্রবেশ করছে। স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি খতিয়ে দেখতে এবং সব ধরনের ফাইবারের শুল্কমুক্ত আমদানির অনুমতি দিতে বিটিএমএ একটি স্থায়ী মনিটরিং কমিটি গঠনের পরামর্শ দিয়েছে।
অনিশ্চিত সরবরাহ এবং ঢিলেঢালা নীতিমালার কারণে বৈদেশিক বাণিজ্যের ভরকেন্দ্র আমদানির দিকে হেলে গেছে। বিটিএমএ স্বীকার করেছে যে, স্থানীয় কারখানা থেকে সময়মতো সরবরাহ—যা রপ্তানি আদেশ পূরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ—নিশ্চিত করা হয়নি বলেই আপাতত আমদানির মাধ্যমে মাধ্যমে রপ্তানিকারকদের চাহিদা মেটানো উচিত।
২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানিকারকরা মৌলিক নিটওয়্যারের জন্য সর্বোচ্চ ওয়েস্টেজ রেট ১৬ শতাংশ থেকে ২৯ শতাংশে, স্পেশাল আইটেমের জন্য ৩২ শতাংশে এবং সোয়েটার ও মোজার জন্য ৪ শতাংশ থেকে থেকে ১৬ শতাংশে উন্নীত করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে রাজি করাতে সমর্থ হয়। এসব কাঁচামালের যতটুকু নষ্ট হয়, সেই পরিমাণই ওয়েস্টেজ রেট। উল্লেখ্য, কাঁচা তুলা বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার আওতায় আমদানি করা হয় না। এ কারণে উচ্চ ওয়েস্টেজ রেট পোশাক প্রস্তুতকারকদের কাঁচা তুলার বিপরীতে বেশি পরিমাণে সুতা ও ফ্যাব্রিক আমদানি করতে উৎসাহিত করে।
'অতিরিক্ত' আমদানি বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়িয়েছে!
২০২০-২১ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজনের পরিমাণ ছিল ১৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে যা বেড়ে ২০ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পোশাকের বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলি মূল্য পুনঃসমন্বয় করতে দেয়নি। রপ্তানিকারকরা স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সঙ্গে কার্যাদেশ নিয়ে আলোচনার সময় সুতি পোশাকের দামের সঙ্গে সুতার বেড়ে যাওয়া মূল্য যোগ করতে পারেননি। তবু কার্যাদেশের পরিমাণ বাণিজ্য লোকসানের চেয়ে বেশি ছিল বলে মোট মূল্য সংযোজন বেড়েছে।
দিনশেষে নেট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের জন্য আমদানির তুলনায়– স্থানীয় অর্থনীতিতে সংযোজিত মূল্যের আকারই গুরুত্বপূর্ণ, মূল্য সংযোজিত অংশ নয়। স্থানীয় ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ সাপ্লাই চেইনে সক্ষমতার ঘাটতির কারণে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তা পূরণ হয়েছে আমদানির মাধ্যমে। যার মাধ্যমে বর্ধিত রপ্তানি আদেশের সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে।
মহামারির আগের বাংলাদেশের পুরোনো দুর্বলতা ছিল কটন কাপড় রপ্তানির ওপর নির্ভরশীলতা। আন্তর্জাতিক পোশাক বাণিজ্যে কটন কাপড়ের হিস্যা খুবই সামান্য। এই দুর্বলতাই মহামারির পর বাংলাদেশের জন্য শক্তিতে পরিণত হয়, যদিও তা খুব অল্প সময়ের জন্য। ভোক্তার পছন্দ 'বিজনেস লুক' থেকে 'আরামে'র দিকে চলে যাওয়ায় প্রাকৃতিক ফাইবারের কাছে কৃত্রিম ফাইবার জায়গা হারাতে শুরু করে। ভোক্তাদের মধ্যে বিশেষত স্পান কটনের তৈরি পোশাকের চাহিদা দেখা দেয়। এসময়ে তুলার সুতা ও ফ্যাব্রিক আমদানি করা না গেলে তুলা সংকটকালে বর্ধিত চাহিদা মেটানো সম্ভব হতো না। আসলে স্থানীয় উৎস থেকে যে সরবরাহ পাওয়া সম্ভব ছিল না, মূলত তাই পোশাক খাতের আপাতদৃশ্যমান 'অতিরিক্ত' আমদানির একটি বড় অংশ হয়েছে।
আমদানির সুবিধা অবারিত থাকার কারণেই মহামারির পর রপ্তানি বাজারে যে সুযোগগুলি তৈরি হয়– দেশের পোশাক খাত তা থেকে লাভবান হতে পেরেছে। নাহলে দেশের বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রা সংকট আরও খারাপ দশায় থাকতো। তবে, এ প্রশ্ন রাখতেই হয়, আমরা কী আরও ভালো করতে পারতাম না? উত্তর হলো- অবশ্যই হয়তো পারতাম।
আমরা যদি, রপ্তানির কার্যাদেশ কমবে না এমনভাবে বায়ারদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে উৎপাদন উপকরণের বাড়তি আমদানি মূল্য তাদের কাছে করা রপ্তানিতে পার করতে পারতাম– তাহলে তা অবশ্যই সম্ভব ছিল। গুরুতর মনোযোগ দিলে– জ্বালানি ক্রয়, বিদ্যুৎ উৎপাদনের অবকাঠামো এবং সহজে ব্যবসা করার নানান সুবিধা যেমন নিবন্ধন, আইন, কর এবং নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সাথে কমপ্ল্যায়েন্স নিশ্চিত করাসহ আরও অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের আরও ভালো করার সুযোগ ছিল।
- লেখক: জাহিদ হোসেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ