চা শ্রমিকদের ২৫ টাকা মজুরি বৃদ্ধি একটি প্রহসন
আধুনিক দাসত্ব তত্ত্বটি বাংলাদেশের চা-শ্রমিকদের জন্য অনেকাংশেই প্রযোজ্য, কেননা আজকের এই আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় যেখানে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ ডিজিটাল প্রযুক্তি অর্জন করতে কাজ করছে সেখানে ১২০ টাকা মজুরি চা-শ্রমিকের প্রতি শোষণের একটা রূপ।
উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক বৈশ্বিক অস্থিরতার মুহূর্তে বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর অবস্থাই যখন নাজেহাল, সেখানে ১২০ টাকা দৈনিক মজুরি পাওয়া একজন চা-শ্রমিকের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
কাজেই এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন শ্রমিকদের মজুরি দৈনিক ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে গত ৮ আগস্ট থেকে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতির ডাক দেয়। দাবি আদায়ে কোনো ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় চা-শ্রমিক ইউনিয়ন গত ১৩ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের সকল চা-বাগানে লাগাতার ধর্মঘট ঘোষণা করে।
যদিও আটদিন ধর্মঘট করে চা শ্রমিকদের একটা ইতিবাচক ফল হিসেবে মজুরি বেড়েছে দৈনিক ২৫ টাকা, যা কিনা বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরির দাবির কাছে সত্যিই হাস্যকর।
সর্বশেষ খবর হলো, আমাদের চা-শ্রমিকরা দৈনিক ২৫ টাকা মজুরি বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের ধর্মঘট চলমান রেখেছেন।
চা-শ্রমিকরা যখন ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলন করছেন, ঠিক তখন মালিকরা বলছে তারা নাকি চা শ্রমিকদের ৪০২.৮৮ টাকা মজুরি দেয়। তাদের এই তথ্য দিয়ে 'এখন টিভি' একটি প্রতিবেদন করেছে। যা পুরোই ভুল তথ্য।
এখানে মালিকপক্ষের প্রদত্ত সেবার কিছু বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হলো।
বাগান মালিকরা বলছেন, তারা দৈনিক ঘরভাড়া বাবদ ৭৬.৯২ টাকা, চিকিৎসা বাবদ ৭.৫০ টাকা, ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ ০.০২ টাকা এবং বাসাবাড়িতে উৎপাদিত ফলমূল বাবদ ১৪.০০ টাকা শ্রমিকদের দেন। যা হিসাব করলে দৈনিক ৯৮.৪৪ টাকা দাঁড়ায়। তবে এটি বাস্তবতা নয়। শ্রম আইনের ২(৪৫) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, বাসস্থান, আলো, পানি, চিকিৎসা সুবিধা, অবসর ভাতা বা ভবিষ্যৎ তহবিলে মালিক কর্তৃক দেয়া টাকা মজুরির অন্তর্ভুক্ত হবে না। ফলে মালিকরা উপরোক্ত খাতগুলিতে যে টাকা মজুরি বাবদ প্রদান করছে বলে দেখাচ্ছে, তার কোনো আইনি ভিত্তি নেই। তাছাড়া চা শ্রমিকরা নিজেদের বাসা-বাড়ি নিজেরাই নির্মাণ করেছেন ও রক্ষণাবেক্ষণ করছেন।
রেশন বলতে সাড়ে তিন কেজি নিম্নমানের আটা দেয়া হয়।
স্বাস্থ্যসুবিধা দেয়ার নামে চা বাগানে চলছে শুভংকরের ফাঁকি। বাগানগুলোতে এমবিবিএস ডাক্তার তো থাকেই না, উপরন্তু সকল প্রকার অসুখের একটাই দাওয়াই—প্যারাসিটামল।
চা বাগানের তথাকথিত প্রাইমারি স্কুলে নেই কোনো অভিজ্ঞ শিক্ষক, নেই শ্রেণিভিত্তিক কক্ষ, নেই অন্যান্য সুবিধা।
শ্রম আইনে (৯৬নং ধারা) স্পষ্ট নির্দেশ আছে, চা শ্রমিকদের গৃহায়নের সুবিধা নিশ্চিত করবে মালিকরা। এখানে মনে রাখতে হবে চা শিল্প অন্য শিল্পের মতো নয় যে বাইরে থেকে শ্রমিক এনে কাজ করানো যায়। চা শিল্পের বিশেষ ধরনের কারণেই শ্রমিকদের বাগানেই থাকতে হয়। আর এই বাগানও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চাষ করছেন চা শ্রমিকরা। মালিক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু শ্রমিকরা সেখানেই আছেন। ফলে চা শ্রমিকদের গৃহে উৎপাদিত কাঁঠাল বা পেঁয়ারা জাতীয় ফলের মূল্য মজুরিতে দেখানো হাস্যকর যুক্তি ছাড়া আর কী হতে পারে?
চা-শ্রমিকরা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছেন। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে বারবারই তাদের অধিকার আদায়ে আন্দোলন করতে হচ্ছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ১৯, ২৭, ২৮ ও ২৯ নং অনুচ্ছেদে সমতা, সমান সুযোগ এবং বৈষম্যহীনতাবিষয়ক সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সাংবিধানিক বিধানাবলী এবং সকল প্রকার জাতিগত বৈষম্য বিলোপ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদে এটি সুষ্পষ্ট যে নাগরিকদের অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে কোনো ধরণের বৈষম্য গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু চা-শ্রমিকের ক্ষেত্রে এর বাস্তব চিত্র ভিন্ন।
বাংলাদেশে ফাঁড়িসহ ২৪১টি চা বাগান রয়েছে, যেখানে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে প্রায় ৫ লাখ চা শ্রমিক বর্তমানে মাত্র ১২০ টাকা দৈনিক মজুরিতে কাজ করছেন। প্রতি দুই বছর পরপর চা বাগান মালিকপক্ষের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদ ও চা শ্রমিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে মজুরি বৃদ্ধি করা হয়। দীর্ঘ ২২ মাস কালক্ষেপন করে সর্বশেষ চুক্তি (২০১৯-২০) সাক্ষরিত হয় ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর (কার্যকর হয় ১৯ অক্টোবর), যার মেয়াদ শেষ হয়ে যায় একই বছরের (২০২০) ৩১ ডিসেম্বর। সেই চুক্তিতে চা শ্রমিকদের মজুরি ১০২ টাকা থেকে উন্নীত করে 'এ' শ্রেণির চা বাগানের জন্য মাত্র ১২০ টাকা, 'বি' শ্রেণির জন্য ১১৮ টাকা এবং 'সি' শ্রেণির জন্য ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
আইন অনুযায়ী ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর ও কার্যকর করার কথা থাকলেও চা বাগান মালিকরা এখন পর্যন্ত (১৫ আগস্ট ২০২২) এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন মালিকপক্ষের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে মজুরি বৃদ্ধির জন্য ১৩টি বৈঠকে অংশগ্রহণ করে এবং দৈনিক মজুরি বৃদ্ধি করে ৩০০ টাকা করার দাবি জানায়। কিন্তু মালিকরা দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির সময়ে মজুরি মাত্র ১৪ টাকা বাড়িয়ে দৈনিক ১৩৪ টাকায় চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য চা শ্রমিক ইউনিয়নকে প্রস্তাব দেয়। চা শ্রমিক ইউনিয়ন এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে গত ৮ আগস্ট (২০২২) থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ২৪১ চা বাগান একযোগে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালনের পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করছে।
২০১৪ সালে যেখানে চায়ের উৎপাদন ছিল ৬ কোটি ৩৮ লাখ ৮০ হাজার কেজি, সেখানে ২০১৯ সালে উৎপাদন এসে দাঁড়ায় ৯ কোটি ৬০ লাখ ৭০ হাজার কেজিতে। অথচ ২০১৯ সালে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৭ কোটি ৪১ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা। ওই বছর চা শ্রমিকরা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চা উৎপাদন করে দিলেও তাদেরকে এক পয়সাও প্রণোদনা বা লাভের সিকি অংশও দেয়া হয়নি, যা অমানবিক ও বেআইনি।
করোনা মহামারির এক পর্যায়ে যখন দেশের সব শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, তখনও চা বাগান চালু ছিল এবং পুরোদমে চায়ের উৎপাদন হয়েছে। যেহেতু মসলা চা করোনা প্রতিরোধে কার্যকর বলে মনে করা হতো, সে কারণে ওই সময়ে চা বিক্রিও হয়েছে অনেক চড়া দামে। পুরো করোনাকালজুড়ে (২০২০-২১) এক দিনের জন্যও চা ফ্যাক্টরি বন্ধ ছিল না। উপরন্তু অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে ২০২১ সালে চায়ের উৎপাদন হয় ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি, যেখানে ২০২১ সালের চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ কোটি ৭৮ লাখ কেজি।
বর্তমানে দেশের প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরদিকে দীর্ঘ ১৯ মাস ধরে আটকে থাকা চুক্তি স্বাক্ষরিত না হওয়ার কারণে চা শ্রমিদের মজুরি বাড়েনি। তাই এখন চা শ্রমিকরা কোনোভাবেই চলতে পারছেন না। দুই কেজি চাল কিনতেই তাদের সব টাকা শেষ হয়ে যায়; তার উপর পরিবারের অন্যান্য খরচ, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ইত্যাদি তো আছেই। মোটকথা, বর্তমানে এই ১২০ টাকা মজুরি দিয়ে চা শ্রমিকরা কোনো অবস্থাতেই চলতে পারছেন না।
চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনটি মূলত বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটি, ভ্যালি কমিটি, চা বাগান পঞ্চায়েত কমিটির নেতৃত্বে সংগঠিত হচ্ছে। এতে ২৪১টি চা বাগানের সকল চা শ্রমিক, ছাত্র-ছাত্রী সবাই একযোগে কাজ করছেন। সিএসও-র নেতৃবৃন্দ নিজ নিজ এলাকার চা বাগানের চা শ্রমিকদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রতিদিনই চা ফ্যাক্টরির গেটে অবস্থান নিচ্ছেন, বক্তব্য রাখছেন ও বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিচ্ছেন। তাছাড়া কর্ম-এলাকায় নিয়োজিত বিভিন্ন চেইঞ্জ এজেন্টগণ এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আছেন ।
এই পর্যায়ে, চা শ্রমিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশীয় চা সংসদ (চা কোম্পানিদের সংগঠন) ও শ্রম অধিদপ্তরের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয় এবং পরবর্তীতে মাত্র ২৫ টাকা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত আসে, যা সাধারণ চা-শ্রমিক প্রত্যাখ্যান করে বর্তমানে তাদের আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। বাংলাদেশের অন্যতম অনগ্রসর জনগোষ্ঠী চা-শ্রমিকের প্রতি মজুরি বৈষম্য নিরসন ও তাদের অধিকার রক্ষায় সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
- মোহন রবিদাস: বিভাগীয় সমন্বয়কারী, নাগরিক উদ্যোগ