পট্টির শহর কুমিল্লা এখন শুধুই শহর
পট্টি। শৃঙ্খলাবদ্ধ সারিসারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এক ব্যবসার সাথে অন্য ব্যবসার সংমিশ্রণ নেই। গোছানো পরিপাটি ব্যবসায়িক কেন্দ্র বলতে যা বোঝায়। কুমিল্লা নগরীর রাজগঞ্জ বাজারের পূর্বাংশে গড়ে ওঠে ছোট ছোট শৃঙ্খলাবদ্ধ এসব ব্যবসায়িক অঞ্চল। ব্যবসায়িক অঞ্চল সমূহকে নামকরণ করা হয় পট্টি নামে। যেমন, দেশওয়ালি পট্টি। ভারতের রাজস্থান থেকে আসা দেশওয়ালদের বসবাস ছিল এ অঞ্চলে।
দেশওয়ালদের এক সময় দারুণ প্রতিপত্তি ছিল। শহরের অনেক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে তারা। তাদের পর গিরিধারি ও ক্ষৈত্রীয়রা এই অঞ্চলে বসবাস করেন। কুমিল্লা নগরীর রাজগঞ্জ বাজারের দক্ষিণাংশে দেশওয়ালি পট্টি নামে একটি পট্টির নাম থাকলেও দেশওয়ালদের বসবাস নেই এই পট্টিতে। কাপড়িয়া পট্টিতে কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলাসহ নানা অঞ্চলের থান কাপড় আনা হতো। ওই সময়ে রেডিমেড বলতে শুধুমাত্র স্যান্ডো গেঞ্জি ছিল। ছেলেরা নিমা আর ফতুয়া পরতো।
হাফ শার্ট, ফুল শার্ট, পাঞ্জাবি ছিল। শার্ট, ফতুয়া এসব ছিল তিন পকেটের। ওপরে একটি বুক পকেট, নিচের দিকে দুই হাত বরাবর দুই পকেট রাখা হতো। কুমিল্লাতে এখনও কাপড়িয়া পট্টি নামে একটি অঞ্চল আছে। আগের জৌলুস নেই, তবে কাপড়িয়া পট্টি ছাড়াও বস্ত্রের দোকান নগরীর অলিগলি ছেয়ে গেছে। পট্টির কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে অগোছালোভাবে।
আর স্বর্ণপট্টি। স্বর্ণপট্টির নাম পূর্বে আঞ্চলিক ভাষায় হোনারু পট্টি ছিল। পরে সোনারু, বর্তমানে এর নাম হয় স্বর্ণপট্টি। কুমিল্লা নগরীর রাজগঞ্জ বাজারের পূর্ব দিক লাগোয়া এই অঞ্চলটি এখনও শৃঙ্খলিত ব্যবসায়িক অঞ্চলের একটি। আগেকার দিনে উঁচু বংশীয় লোকজনই ভারী গহনা পরতো। বেশিরভাগ মানুষ ছিল দরিদ্র শ্রেণির। বিয়েশাদি ব্যতীত তারা স্বর্ণ খুব কম ব্যবহার করতো। দোকানগুলোতে তেমন চাকচিক্য ছিল না। বর্তমানে স্বর্ণপট্টির দোকানগুলোতে চাকচিক্য বেড়েছে। প্রচুর ভারী ভারী গহনা আছে। এসবের চাহিদা তুমুল।
রাজগঞ্জ বাজারের দক্ষিণে গোয়ালপট্টি। কুমিল্লার মিষ্টি, রসমালাইয়ের যে ঐতিহ্য তার ধারাপাত হয় এই গোয়ালপট্টি থেকেই। এখনও দধি-মিষ্টির বেশকিছু দোকান আছে গোয়াল পট্টিতে। এটি আরও সম্প্রসারিত হয়ে চলে গেছে নগরীর কান্দিরপাড় ও রাজগঞ্জ বাজারের মাঝামাঝি মনোহরপুরে। গোয়াল পট্টিতে ঘোষরাই বংশ পরম্পরায় তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন। মনোহরপুরে ঘোষরা ছাড়াও অন্য সম্প্রদায় এবং মুসলিমরা মিষ্টান্ন উৎপাদন করছেন।
কামারপট্টি। চকবাজারের উত্তরে আমির দিঘি সংলগ্ন স্থানে কামারট্টির অবস্থান আজও আছে। তবে চীনা ও স্টিলের পণ্যের কারণে কামাররা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। পট্টির বাইরেও শহরের নানা প্রান্তে কামাররা ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছেন। যা প্রকৃত কামারদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তেরিপট্টি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য মেলেনি। সাধারণত নগরীর মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনের বাসস্থান ছিল চকবাজার, মোগলটুলি, চর্থা, সংরাইশ এলাকায়। তাদের পছন্দের খাবার ছিল তেহারি। সে থেকেই এই নামের উৎপত্তি হতে পারে বলে মনে করেন কুমিল্লার ইতিহাস-ঐতিহ্য গবেষক আহসানুল কবির। আরেক গবেষক অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক মনে করেন চাল, ডাল, বুট, বাদাম, পেঁয়াজ, মসলাসহ পাইকারি পণ্য বিক্রির কেন্দ্রবিন্দু এই চকবাজার। নানা রকম পণ্যের সমাহারের কারণে এর নাম তেরি পট্টি।
একসময় কুমিল্লায় ছনের ঘর ছিল বেশি। ছনের ঘরে বাঁশ ও বাঁশজাত পণ্যের চাহিদা ছিল। ছনের ঘরের পর টিনের ঘরেও এর চাহিদা ছিল। এখনও এর চাহিদা আছে। তবে কম। সে কারণে বাঁশপট্টির পরিধিও ছোট হয়ে এসেছে।
কাঁসারি পট্টির খুব নামডাক ছিল। কমদামি অ্যালুমিনিয়ায়ের বিস্তারের কারণে কাঁসার পণ্য বিলীন প্রায়। কাঁসার হাঁড়ি-পাতিল, কলসি, পূজার সামগ্রীর কদর ছিল কুমিল্লায়। কাঁসারিপট্টি নামে থাকলেও কাঁসার দোকানপাট তেমনটা দেখা যায় না।
অবিভক্ত ভারতবর্ষের অন্যতম ব্যবসায়িক কেন্দ্রবিন্দু ছিল এসব পট্টি। দেশ ভাগের পরও ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত এসব পট্টির আধিপত্য ছিল। ৬৫ পরবর্তীতে ব্যবসায়িক অঞ্চল সীমিত হয়ে আসে। পরবর্তীতে নব্বইয়ের দশকে আরও সংকুচিত হয়ে আসে।
সাহা সম্প্রদায় ছাড়াও কর্মকার, মোদক বা কুড়ি, স্বর্ণকার, ঘোষ, কুমার, তেলি, নাপিত ইত্যাদি সম্প্রদায়ের লোকজন ব্যবসাপাতির নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। ব্যবসার সাথে সম্পৃক্তদের জন্য ছিল পানশালা। মনোরঞ্জনের জন্য সিনেমা হল আর আমোদ-ফুর্তির জন্য বর্তমানে চকবাজার বাসস্ট্যান্ডের পাশে একটি পতিতালয় ছিল।
১৯৬৫ সালে আইয়ুব সরকার কিছু বিষয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ওই সময়েই অনেক বণিক বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। তাছাড়া সময়ের বিবর্তনে কিছু ব্যবসাপাতির প্রয়োজন ফুরিয়ে আসে। যার কারণে পট্টি অঞ্চলও ছোট হয়ে আসে। কিছু কিছু পট্টি আবার বিলীনও হয়ে যায়।
বিলীন হওয়া পট্টির মধ্যে অন্যতম হলো তামাক পট্টি। তামাক পট্টি ছিল পান পট্টি লাগোয়া। পাশে ছিল রূপালী সিনেমা হল। যা আজও চালু আছে। এর পাশেই বর্তমান চকবজার বাসস্ট্যান্ডের পাশে ছিল বেশ্যালয়টি। মুচি পট্টি ও মেথর পট্টিতে চোলাই মদ পাওয়া যেতো। বাবু সাহেবরা বেশ্যালয়ে নেশাজাতীয় সুগন্ধি তামাক সেবন করতেন। সাথে থাকতো হুক্কা। বংশানুক্রমে হুক্কার রং সংরক্ষিত ছিল।
ছেলেরা এ রং তৈরি করতে পারতো। মেয়েদের তা শেখানো হতো না। কারণ স্বামীর পরিবারে গেলে কাজটি অন্য কেউ শিখে ফেলার শঙ্কা থাকতো।
পানশালার বৈধ মদ ছাড়াও চোলাই মদ পান করতেন বাবু সাহেবরা। কালের বিবর্তনে পানপট্টি, তামাকপট্টি দুটিই বিলীন হয়ে যায়। যদিও চকবাজারের ওই অঞ্চলে পান-তামাকের ব্যবসা আছে। তবে তা সীমিত।
কুমিল্লা, বাংলাদেশ এমনকি গোটা ভারতবর্ষে ৫০ বছর পূর্বেও বলার মতো স্যানিটারি ল্যাট্রিন ছিল না। সেসময়ে কুমিল্লায় সার্ভিস ল্যাট্রিন নামে এক প্রকারের ভ্রাম্যমাণ ল্যাট্রিন ছিল। রাত ১০টার পর মেথরপট্টির মেথররা এসব পরিষ্কার করতো। সময়ের দাবিতে মেথরপট্টি হারিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
বিলীন হয়ে যায় কসাই পট্টি ও মুচি পট্টি। ঋষিপট্টির সামান্য অস্তিত্ব এখনো চোখে পড়ে। মুচি কসাইরা গেছেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। ছাতিপট্টিতে তেমন কোনও ছাতার দোকান নেই। খড়মপট্টিতে তৈরি হয় না জুতা।
কুমিল্লার ইতিহাস-ঐতিহ্য গবেষক আহসানুল কবির মনে করেন, কুমিল্লাতে কমপক্ষে তিনশ বছর পূর্বে এসব পট্টির সম্প্রসারণ শুরু হয়। তিনি বলেন, কুমিল্লাতে ১৪৫৮ সালে মহারাজা ধর্মমাণিক্য বাহাদুর ধর্মসাগর দিঘি খনন করেন। এ থেকে বোঝা যায়, তারও পূর্ব থেকে কুমিল্লা নগরকেন্দ্রিক মানুষের বসবাস ছিল। যেহেতু ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ অবিভক্ত ছিল, সেহেতু এটা স্পষ্ট যে এই পট্টি শুধুমাত্র পূর্ববাংলার ব্যবসায়িক কেন্দ্রবিন্দু ছিল না, এটা ছিল গোটা ভারতবর্ষের অন্যতম ব্যবসায়িক কেন্দ্রবিন্দু।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এখানে দিল্লি, রাজাস্থানের বণিকরা, মোগলরা, সুফিরা তাদের বাসস্থান গড়ে তুলেছিলেন। তাছাড়া নৌপথে বাংলাদেশ ও ভারতে যাতায়াতের জন্য মেঘনা, ডাকাতিয়া ও গোমতীর সংযোগ ছিল এই কুমিল্লায়। বাংলাদেশের সকল জেলার মানুষের সহজ যাতায়াতের সুযোগ ছিল। বোঝাই যায়, চকবাজার কেন্দ্রিক এই পট্টি কতটা গুরুত্ববহ ছিল।
আহসানুল কবির বলেন, কুমিল্লাতে জিলা, ফয়জুন্নেছা স্কুল ও ভিক্টোরিয়া কলেজের মতো প্রতিষ্ঠান ছিল। যার কারণে অন্য জেলার মানুষরাও এখানে আবাসন গাড়া শুরু করেন। ধীরে ধীরে কুমিল্লা মানুষে ভরপুর হয়ে যায়। ব্যবসার ধাঁচ পাল্টে যায়। আর পট্টিগুলো চলে যায় অন্ধকারে।
নজরুল গবেষক ও কুমিল্লার ইতিহাস নিয়ে একাধিক গ্রন্থ প্রণেতা অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক বলেন, কুমিল্লা ছিল পরিপাটি গোছালো শহর। শহর ছিল দুই ভাগে বিভক্ত। রাজগঞ্জের পশ্চিমে আবাসন পূর্বদিকে ব্যবসা। উত্তরে সরকারি অফিস, আদালত ইত্যাদি। দক্ষিণাংশে স্থানীয় আদিবাসীদের বসবাস ছিল। শহরে তেমন কোনো ট্রাক ছিল না। ট্রেন ও নদীপথে কুমিল্লায় মালামাল আনা-নেওয়া হতো। একসময় শহর রাজগঞ্জের পশ্চিম দিকে ধাবিত হয়। নতুন নতুন পাড়া, তলা, গাঁও ইত্যাদি নাম দিয়ে মানুষের আবাসন শুরু হয়। ভবন ওঠা শুরু হয়। ব্যবসাপাতিরও আর শৃঙ্খলা থাকে না। পট্টির শহর হয়ে যায় শুধুই শহর।
অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন মনে করেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বে দূরদর্শিতা থাকলে চকবাজার কেন্দ্রিক এই বাণিজ্য কেন্দ্রটি বাংলাদেশের জন্য মডেল হতে পারতো। কিন্তু সুদূরপ্রসারী চিন্তা করার মতো মানুষের জন্ম খুব কমই হয়েছে।