বাঙালিরা একদিন ব্রিটিশদের হয়ে লাহোর শাসন করেছে, করেছে বিদ্রোহ আর স্বাধীকার সংগ্রাম
সে বহু বছর আগের কথা। তখন থাকতাম লাহোর সেনানিবাসের সদ্দর বাজার এলাকায়। একটি বিষয় তখনই লক্ষ করি–এখানকার অনেক বাজার আর রাস্তার নামে বাংলা অঞ্চলের ছাপ রয়েছে। প্রথমে ধরেই নেই- পূর্ব পাকিস্তান থাকাকালে হয়তো এমন নামকরণ হয়। কিন্তু আরেকটু অনুসন্ধানের পর জানতে পারি- আমার ধারণা ভুল ছিল। আসলে এসব নামকরণ হয়েছে ১৮৫০ এর দশকের ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষিতে।
একটু গবেষণা করে জানতে পারলাম, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর এখানেই সবচেয়ে বেশি 'বাংলা' অঞ্চল থেকে আসা সেপাইদের হত্যা করা হয়। ব্রিটিশ শাসনের বৈশিষ্ট্যই ছিল- বিভাজনের মাধ্যমে শাসন, যাকে আজ আমরা বলি– 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি'।
ব্যতিক্রম হয়নি এক্ষেত্রেও। সেসময় বেশিরভাগ বাংলা অঞ্চলের সেপাইদের নিয়ে গঠিত পদাধিক রেজিমেন্টকে এখানেই মোতায়েন করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তারা গোরা অফিসারদের সাথে থাকতো এই সদ্দর কলোনি ও আশেপাশের এলাকায়।
সিপাহি বিদ্রোহের সময় এই সদ্দর কলোনিতেই তারা দুজন ব্রিটিশকে গুলি চালিয়ে প্রথমে হত্যা করে। তাদের একজন ছিলেন মেজর, অন্যজন চিকিৎসক।
সে ইতিহাসের সূত্রেই আজ তুলে ধরতে চাই সেসব বাঙালি অভিজাতের কথা যারা শুধু সেপাই ছিল না, তাদের বেশিরভাগই ভারতবর্ষের এই পশ্চিমাংশে এসেছিল নব্য-ব্রিটিশ শাসকদের প্রশাসনিক শক্তি হয়ে। কখনো নিরক্ষর সেনা, কখনোবা তারা ছিল পশ্চিমা শিক্ষায় দীক্ষিত আর্দালি, কেরানি ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নানান পদের কর্মচারী।
আগে সেপাইদের আগমনের ইতিহাসই তুলে ধরা যাক। সূত্রপাতটা হয়েছিল ১৮৪৯ সনের ২৯ মার্চ। শিখ সাম্রাজ্যকে যুদ্ধে হারানোর পর এদিন আনুষ্ঠানিকভাবে লাহোর দখল করে নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এর মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে সম্পূর্ণ হয় ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিস্তার।
অবিভক্ত পাঞ্জাবসহ লাহোরের সমাজ কাঠামোয় বিশাল পরিবর্তন আনে এ ঘটনা। এই সময় কোম্পানির বিশ্বস্ত কর্মচারী ও সেনারা তাদের ব্রিটিশ প্রভূদের সাথে লাহোরে এসে বসবাস শুরু করে।
উপমহাদেশে প্রথম যে ভারতীয়রা কোম্পানির ব্যবসা, বাণিজ্য ও প্রশাসনে যুক্ত হয়ে আপিসের বাবু বনে বসেছিলেন–তারা হলেন পশ্চিমা শিক্ষায় দীক্ষিত বাঙালিরা। লাহোরেও তার ব্যতিক্রম হওয়ার সুযোগ ছিল না। আসলে পলাশীর যুদ্ধের পর লাহোর দখলের আগেই প্রায় ১০০ বছর বাংলা শাসন করেছে কোম্পানি-রাজ। আর এসময়ে কোম্পানি তাদের সেবক হিসেবে এই শ্রেণিটির জন্ম দিয়েছে, পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। সর্বোচ্চ ও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলিতে ব্রিটিশ অফিসার থাকলেও, দেখা যেতো–বেশিরভাগ অধস্তন কর্মকর্তা ও কেরানি, আর্দালি হলেন বাঙালি।
১৭৫৭ সনের পলাশীর যুদ্ধের সময়ে অবিভক্ত বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা মিলে ছিল তৎকালীন বাংলা। মোগল শাসকদের দুর্বলতার সুযোগে শেষদিকে যা প্রায় স্বাধীনভাবেই পরিচালনা করতেন নবাবরা। পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তনমিত হওয়ার পর ব্রিটিশরা এই প্রদেশ নিয়ে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি গঠন করে। রাজধানী করা হয় কোম্পানির প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র– কলকাতাকে।
এই পটপরিবর্তনকে তার লেখায় 'জাদুকরি' বলে উল্লেখ করেছেন ব্রিটিশ প্রশাসক, গবেষক ও লেখক ড্যানজিল ইবটসন।
তার সূত্রে আমরা জানতে পারি, ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাহোরের অফিস-আদালত ভরে যায় বাঙালি বাবুদের আধিক্যে। সব অফিসেই তাদের রমরমা। দিল্লি থেকে পাঞ্জাবি 'বলনেওয়ালা' কিছু কর্মচারীও এসেছিল। তবে তারা সংখ্যায় কম। আকস্মিক এই পরিবর্তনের স্পষ্ট প্রতিফলন ছিল আইনি কাজে ইংরেজি ও উর্দু উভয় ভাষায় দলিল-দস্তাবেজ লেখা শুরু হওয়া। কারণ, দাপ্তরিক কাজে যুক্ত বাঙালিরা ইংরেজি ভাষাতে লিখতে ও পড়তে সমান পারঙ্গম ছিলেন।
১৮৫০ এর দশক থেকে বাংলা অঞ্চলের পদাধিক রেজিমেন্টগুলির সেপাইদের বসবাসের সূত্রেই 'সদ্দর বাজার' নামটির উৎপত্তি। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর এখানেই ১৬তম বেঙ্গল গ্রেনেডিয়ার রেজিমেন্টের সেনাদের নিরস্ত্র করা হয়। বাংলার সেপাইদের আরেকটি রেজিমেন্ট ৪৯তম গ্রেনেডিয়ার-ও ছিল এ তালিকায়।
নিরস্ত্র করার পর সদ্দর বাজার ও এর আশেপাশের এলাকায় অধিকাংশ বাঙালি সেপাইকে গুলি করে হত্যা করে ব্রিটিশ সেনারা। এসময় রাভি নদী পারি দিয়ে অনেকে পালানোর চেষ্টাও করে। তাদের কেউ কেউ সফল হয়।
দুঃখজনক হলো- এই হত্যাযজ্ঞে ব্রিটিশদের সহায়তা করে শিখ সেনাদের পুরোনো রেজিমেন্টগুলি। বিদ্রোহ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণ দেওয়া এই সেনাদের কথা ভুলে বসে আছি। অথচ আমরা মনে রেখেছি, দেশভাগের অভিজ্ঞতা আর শিখদের চলে যাওয়ার ঘটনা। আমার প্রয়াত পিতার মতে, দেশভাগের সার্বিক যে 'মনস্তাত্ত্বিক ক্ষত' –এ নাকি তারই ফসল।
তবে বাস্তবতা হলো–১৮৫৭ সনের আগে লাহোর বাঙালি দিয়ে ভর্তি ছিল। সেনানিবাস ছাড়াও এখনকার আনারকলি আবাসিক এলাকায় তাদের বসবাস ছিল বেশি। পাশাপাশি তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তিও কম ছিল না। অনেক বাঙালি শিক্ষাবিদ ও মিশনারি এসময় লাহোরে আসেন–তাতে পাঞ্জাবের ওপর বাংলার আধিপত্য আরও বেড়ে যায়।
খৃষ্টধর্ম গ্রহণকারী লালা রাধা রামের উদ্যোগে লাহোরে গড়ে ওঠে 'লাহোর রিলিজিয়াস বুক সোসাইটি'। আনারকলি বাজারের বিপরীতে তখন সদ্য-স্থাপিত পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের বহির্প্রাঙ্গণে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এরপর আসেন আরেক বিখ্যাত খৃষ্টধর্ম গ্রহণকারী কালীচরণ চ্যাটার্জি। তিনি লাহোর সরকারি কলেজের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীকালে তাকে ফোরম্যান ক্রিশ্চিয়ান কলেজের পরিচালক নিযুক্ত করা হয়।
খৃষ্টধর্মের একটি ভালো দিক হলো– এতে ধর্মান্তরিতদের আন্তঃজাত বিবাহকে নিরুৎসাহিত করা হয়নি। একথা অন্তত সেকালের উদার সংস্কৃতির লাহোরের ক্ষেত্রে জোর দিয়ে বলা যায়। তাই এখানে দ্রুত সংখ্যায় বাড়ছিল বাঙালি খৃষ্টান সম্প্রদায়।
এদের মধ্যে আরও কয়েকজনের নাম উল্লেখ না করলেই নয়, তারা হলেন- সরকারি গার্লস কলেজের প্রিন্সিপাল মোনা বোস এবং তার বোন ও শিক্ষিকা মিসেস দত্ত। তার ছেলে ড. এস.ই দত্তের সহায়তায় লাহোরে প্রতিষ্ঠিত হয়- ওয়াইএমসিএ।
আরেক বাঙালি খৃষ্টান শিক্ষাবিদ অধ্যাপক রাধা পরবর্তী সময়ে লাহোর ছেড়ে দিল্লিতে গিয়ে সেন্ট স্টিফান কলেজে অধ্যাপকের চাকরি নেন।
বাঙালি কেরানি ও শিক্ষিত ধর্মমনা খৃষ্টানরা সমাজে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। পিছিয়ে ছিলেন না অন্য ধর্মের বাঙালিরাও। ধীরে ধীরে লাহোরেও তারা ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। সংস্কারবাদী এ ধর্মের অনুসারীও বাড়তে থাকে শহরে।
বাঙালিদের নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্ম সমাজ ছড়িয়ে পড়ছিল লাহোর থেকে পাঞ্জাবের অন্যান্য শহরে। তবে ভাষার দিক দিয়ে উদার ছিলেন ব্রাহ্মরা। তারা অন্যান্য ভাষাকেও সমানভাবে অফিসে-আদালতে চর্চা করার পক্ষে ছিলেন।
ড. জি ডব্লিউ লিটনার যখন লাহোরে ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন– তার সাথে এই ভাষার ইস্যুতেই দ্বন্দ্বে জড়ান ব্রাহ্মরা। লিটনার চেয়েছিলেন ভারতের ঐতিহ্যবাহী ভাষার শিক্ষা। কিন্তু, ব্রাহ্মরা এর বিপক্ষে যুক্তি দেন, এই শিক্ষা ছাত্রদের সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুত করবে না। তখন লিটনার জানান, তিনি আমলা নন বরং বিদ্বান তৈরি করতে চাইছেন।
লাহোরের গণ্যমান্য বাঙালিদের মধ্যে আরও ছিলেন, শিবনাথ শাস্ত্রী ও প্রতাপ মজুমদার।
এক সময় এসে লাহোরের পাঞ্জাবি ও ইংরেজিভাষী অভিজাতদের সাথে ইংরেজি চর্চায় এগিয়ে থাকা বাঙালি কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতাও তৈরি হয়।
ইবটসনের লেখা 'আউটলাইন্স অব পাঞ্জাব এথনোগ্রাফি' পড়লে আমরা দেখব, ১৮৮১ সন নাগাদ পাঞ্জাবে বাঙালি কর্মকর্তা ছিলেন ২ হাজার ৮৯১ জন। ১৯২১ সনে এসে যা ৪ হাজার ৮৫২ জনে পৌঁছে গিয়েছিল। মাত্র ৪০ বছরের ব্যবধানে সরকারি এই কর্মকর্তার সংখ্যা বাড়ে দ্বিগুণ হারে। প্রতি দশকে বেড়েছে ২৫ শতাংশ করে।
তাই স্থানীয় পাঞ্জাবিদের সাথে বাঙালিদের প্রতিযোগিতার সম্পর্ক বেশ দৃশ্যমানই ছিল। পরবর্তীকালে পাঞ্জাবের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তির ভূমিকা আমাদের সেদিকটি জানতে সাহায্য করবে। যেমন বিখ্যাত স্বাধীনতাকামী ভগত সিংয়ের সাথে ছিলেন বটুকেশ্বের দত্ত-সহ আরও দুই বাঙালি। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যেন প্রতিযোগিতা করেই অগ্রভাগে ছিল বাঙালি ও পাঞ্জাবিরা।
যেমন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র বা 'পূর্ণ স্বরাজ' এই লাহোরের রেট্টিগান রোডের ব্রডলগ হলে পাস হয়েছিল ১৯৩০ সনে। ১৯৪০ সনের মার্চে এ শহরেরই মিন্টো রোডে পাস হয় আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব। উভয় প্রস্তাবই প্রণয়ন করেছিলেন বাঙালি নেতারা।
প্রতিযোগিতা কি ইতিহাসকে সংঘাতের দিকেই ঠেলে দিয়েছিল? ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরুঙ্কুশ জয় হলে তা মেনে নিতে চায়নি পাঞ্জাবি নেতারা। সুষ্ঠু এ নির্বাচনের ফলাফল বর্জনই পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রাখে। এই ঘটনা খুবই দুঃখজনক। কারণ আমাদের মনে রাখা উচিত ছিল- ১৯৪৭ সনে বাংলা ও পাঞ্জাব উভয় প্রদেশকে ভাগ করা হয়েছিল, যা হৃদয়বিদারক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্ম দেয়। সংস্কৃতিকে, সম্প্রীতিকে রিক্ত করে।
বাংলা ও পাঞ্জাবের সাম্প্রদায়িকতাই ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে আজন্ম শত্রুতার বীজ বুনে দিয়ে গেছে। বর্জিত হয়েছে যৌক্তিক বৈজ্ঞানিক শিক্ষা। যুক্তি চলেছে শুধু ধর্মের। সহমর্মিতা, সহনশীলতা হয়েছে বর্জিত। কিন্তু, ইতিহাসের সমাদর করলে একদিন তা কাটিয়ে ওঠাও সম্ভব বলে আমাদের বিশ্বাস রাখা উচিত। তার আগে পর্যন্ত আমাদের যুক্তি ও মানবতার পক্ষে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
- নিবন্ধটি (আংশিক সংক্ষেপিত) পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম দ্য ডনে চলতি বছরের ২১ আগস্ট প্রকাশিত হয়