আকবর আলি খানকে নিয়ে বিশিষ্টজনদের স্মৃতিচারণ
৭৮ বছর বয়সে চলে গেলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আকবর আলি খান। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বর্ণাঢ্য জীবনে আকবর আলী খানের কর্ম ও ভাবনার পরিধি ছিল বিস্তৃত। তিনি একাধারে যেমন একজন নিষ্ঠাবান সরকারি আমলা ছিলেন, তেমনি কাজ করেছেন অর্থনীতি নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ায় পাকিস্তান সরকার তাকে কারাদণ্ডেও দণ্ডিত করে। ইতিহাসের ছাত্র আকবর আলী খান শিক্ষকতার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন, করেছেন গবেষণা এবং প্রচুর লেখালিখিও। সামগ্রিকভাবেই তিনি নিজেকে একজন বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।
আলি আকবর খানের মৃত্যু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশিষ্টজনেরা তাঁর স্মৃতিচারণ করেছেন।
অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ লিখেছেন, 'আমার শ্রদ্ধাভাজন ডক্টর আকবর আলি খানের মৃত্যুতে গভীর শোক জানাই। তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি বাংলাদেশের সুধী সমাজকে অনেক সমৃদ্ধ করেছিল। বিদায় আকবর ভাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার চার বছরের সিনিয়র ইতিহাস বিভাগের প্রবাদতুল্য মেধাবী ছাত্র। একাধারে দক্ষ নীতিবান সরকারি কর্মকর্তা, ইতিহাস ও অর্থনীতির গবেষক, রাজনীতির নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক, সুলেখক, শিক্ষক, নাগরিক সংগঠক ও সমাজচিন্তক।'
লেখক ও প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আরিফ লিখেছেন, 'কিছু কিছু মানুষের চলে যাওয়া এক বিপুল জনগোষ্ঠীর সমূহ ক্ষতির কারণ হয়। একটা অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি করে। আকবর আলি খানের প্রয়াণে অমন কিছু হলো। সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভুদের রাণীর প্রয়াণে মাতম করা অজকুলের তৃতীয় সন্তানরা কি সেটা বুঝতে পারে? মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার অপরাধে পাকিস্তানের আদালতে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাটির জন্য আমরা কী শোক প্রকাশ করলাম!'
প্রাবন্ধিক গবেষক ও কবি মোরশেদ শফিউল হাসান লিখেন, 'যে-দেশে ও যে-সময়ে বিদ্বান মানুষরা সাধারণত 'নীরবতাকেই স্বর্ণ' জ্ঞান করেন, সে-দেশে ও সমাজে ড. আকবর আলি খান কথা বলে গেছেন। এটাকেই আমি তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ বলে মনে করি।'
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, 'ড. আকবর আলি খান- বুদ্ধিজীবী, ইতিহাসবিদ, অর্থনীতিবিদ, সরকারি কর্মচারী, মুক্তিযোদ্ধা এবং আইনের শাসন, নাগরিক অধিকার ও জনসাধারণের জবাবদিহিতার পক্ষে সরব এক সাহসী কণ্ঠস্বর আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। বাংলাদেশ তাঁর মতো বড়মাপের একজন মানুষের অভাব বোধ করবে। কথা বলতে তিনি সর্বদাই নির্ভীক ও বিচক্ষণ ছিলেন। তাঁর চির শান্তি কামনা করছি'।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ও লেখক আলী রিয়াজ লিখেছেন, 'আকবর আলি খান-এর জীবনাবসান কেবল একটি যুগেরই অবসান ঘটালো তা নয়, এর মধ্য দিয়ে এই সময়ের সম্ভবত সবচেয়ে সাহসী কন্ঠস্বর নিরব হয়ে গেলো। যে কোনো মৃত্যুই অপূরণীয়, কিন্ত কিছু মৃত্যু সমস্ত জাতির জন্যে তৈরি করে অপূরণীয় শূন্যতা আকবর আলি খানের মৃত্যু এই দুঃসময়ে গোটা জাতির জন্যে এক অভাবনীয় শূন্যতা তৈরি করে দিলো।
পেশাগত জীবনে তিনি সরকারি কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন, শিক্ষকতা করেছেন। ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান এবং অর্থনীতির জগতে তাঁর বিচরণ ছিলো সমানভাবে, সাহিত্যে তাঁর আগ্রহ সকলের জ্ঞাত। তাঁর গবেষণাভিত্তিক লেখা, এমন কি আত্মজীবনী পাঠেও আমার কাছে মনে হয়েছে তিনি একটি পথের সন্ধান করছেন – তাঁর একার জন্যে নয়, বাংলাদেশের জন্যে, বাংলাদেশের মানুষের জন্যে। 'অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনা জালে রাজনীতি' গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন তাঁর ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে একটি বই লেখার, ভেবেছিলেন ইংরেজিতে লিখবেন; কিন্ত শেষ পর্যন্ত তিনি বাংলায় খানিকটা রম্য ভাবেই লিখলেন; কিন্তু উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট – 'আমি চাই বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে চিন্তা করুক এবং নিজেরাই সংস্কারের পথ বেছে নিক'। তাঁর একটি গ্রন্থের শিরোনাম হচ্ছে 'অন্ধকারের উৎস হতে'; এই বইয়ের উপশিরোনাম হচ্ছে 'সাহিত্য, সমাজ, পরিবেশ ও অর্থনীতি সম্পর্কে আলোর সন্ধান'। এই আলোর সন্ধানে তিনি সচেষ্ট থেকেছেন।
পেশাগত জীবনের শেষ হবার পর তিনি উপহার দিয়েছেন অসামান্য কিছু গ্রন্থ। বাংলাদেশের ব্যুরোক্রেসি বোঝা এবং তার সংকট কোথায় তা উপলব্ধি করার জন্যে আমাদের অবশ্য পাঠ্য হচ্ছে ২০১৫ সালে প্রকাশিত গ্রেশাম'স ল সিনড্রোম: অ্যান অ্যানালাইসিস অব দ্য বাংলাদেশ বুরোক্রেসি!
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেবে একজন পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান মানুষের কথা, একজন জ্ঞানী মানুষের অবদানের কথা, মনে করিয়ে দেবে কী করে প্রচলিত চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করতে হয়। আমরা এই বইগুলো বারবার পাঠ করবো। কিন্তু তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানানোর প্রকৃত উপায় হচ্ছে অকুণ্ঠ চিত্তে সত্য প্রকাশ করা, কেননা আকবর আলি খান সেই কাজটিই করছিলেন - তাঁর লেখায়, তাঁর কথায়, তাঁর সক্রিয়তায়। তাঁর কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এখন আমাদের।'
পিপিআরসি'র নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান লিখেন, 'ড. আকবর আলি খান এখন অন্যলোকে। ইন্না লিল্লাহী ওয়া ইন্না ইলাহী রাজিউন। গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। নিজ গুণে তিনি এক অনন্য ব্যক্তিত্বে উপনীত হয়েছিলেন। নির্ভীক, নিষ্ঠাবান ও জন কল্যাণে মনোযোগী আমলা। পরিশ্রমী গবেষক ও সফল লেখক। নাগরিক পরিসরে বিবেকের কন্ঠস্বর। আজকের বাংলাদেশে যেখানে রোল মডেলের হাহাকার, সেখানে ড. আকবর আলি খান এক অনন্য ব্যতিক্রম। পরলোকে তাঁর চির শান্তি কামনা করছি।'