চিতাবাঘ নয় চিতা
চিতা এখন বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশেই আলোচনায়। প্রথম কথা, ভারত বন্য পরিবেশে আবার চিতা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রজেক্ট চিতা নামের বড় এক কর্মযজ্ঞে হাত দিয়েছে। সে লক্ষ্যে নামিবিয়া থেকে আটটি আফ্রিকান চিতা আনা হয়েছে। মধ্যপ্রদেশের কুনো জাতীয় উদ্যান এগুলোর নতুন আবাসস্থল।
এদিকে কয়েকদিন আগে টাঙ্গাইলের সখিপুরে চিতাবাঘ দেখা গিয়েছে বলে গুজব উঠেছিল যে ছবির কারণে, সেটি আদপে একটি চিতার ছবি। ফটোশপের কারসাজিতে সেটি সফিপুরের জঙ্গলে হাজির হয়ে গিয়েছিল! তো সবকিছু মিলিয়ে আমার মনে হয় চিতা প্রাণীটি নিয়ে কয়েক অনুচ্ছেদ পড়তে খারাপ লাগবে না পাঠকের।
'কেবল সকালের নাস্তা শেষ করেছি, এমন সময় আমার শিকারি (স্থানীয় গাইড এবং ট্র্যাকার) তাঁবুতে এসে হাজির। মুখে চওড়া হাসি। বলল, "সাহেব, শেষ পর্যন্ত তোমার জন্য বড় সিংহটাকে খুঁজে পেয়েছি আজ। চার মাইল দূরে বড় একটা জন্তুকে এক গাছের নিচে শুয়ে থাকতে দেখেছি, তবে ওটা কী বলতে পারব না।" কর্নেল ঘটনাস্থলে হাজির হলেন দ্রুত। গজ ত্রিশেক দূর থেকে তার মনে হলো গাছের নিচে আসলেই বিশালাকায় জানোয়ার শুয়ে আছে। গুলি করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে চমকে দিয়ে লাফিয়ে উঠল ওগুলো, একটা নয় দুটো নয়, ছয় ছয়টা চিতা। ওগুলো ঘটনার আকম্মিকতায় গর্জাচ্ছে। বুড়ো শিকারি চেঁচাল, "সাহেব, তাড়াতাড়ি এসে ঘোড়ার পিঠে চড়।…সবগুলোকে মারতে পারব আমরা।" ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত কর্নেল ই.এ.হার্ডির 'আওয়ার হরসেস' বইয়ে মিলে এই বর্ণনা। সত্যি বলতে, বইটি প্রকাশের আশি বছরের মধ্যেই শিকারিরা ভারতের সব চিতাই মেরে ফেলেছে।
আমার ধারণা, অনেক শিক্ষিত মানুষই চিতা এবং চিতাবাঘকে গুলিয়ে ফেলেন। এমনকি অনেক বইয়ে ডাঙার দ্রুততম জন্তু হিসাবে চিতাবাঘের ছবি ছেপে দেয়া হয় অবলীলায়। অথচ খেতাবটা চিতার প্রাপ্য। মোটামুটি এক মাইল পর্যন্ত দূরত্ব ১২০ কিলোমিটারের কাছাকাছি গতিতে অতিক্রম করতে পারে চিতারা।
চিতা সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা আছে এমন অনেকে আবার ভাবেন যে চিতা শুধু আফ্রিকায় আছে। সত্যি হলো, অল্প কিছু এশীয় চিতা এখনো টিকে আছে, সেটা ইরানে। ভারত একসময় এশীয় চিতাদের চমৎকার বিচরণক্ষেত্র ছিল। বিলুপ্তির প্রায় দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এই হতভাগ্য জানোয়ারটিকে নিয়ে লিখতে বসেছি।
চিতাবাঘের ইংরেজি নাম লেপার্ড, আর চিতাকে ইংরেজিতে বলে চিতাহ। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে হান্টিং লেপার্ড নামেও বেশ পরিচিতি পায়। এর কারণ, একসময় ভারতীয় অভিজাতরা চিতা পোষ মানিয়ে তা দিয়ে অ্যান্টিলোপ শিকার করতেন। ওই চিতারা মায়ের থেকে আগেই অ্যান্টিলোপ শিকারের বিদ্যা শিখে আসত। দেখতে হরিণের সঙ্গে মিল থাকলেও অ্যান্টিলোপরা বরং ভেড়া ও ছাগলদের বেশি কাছের প্রজাতি।
ভারত থেকে এশীয় চিতা বিলুপ্ত হওয়ার একটা বড় কারণ বন্য চিতা ধরা। অপর কারণ, বন্দি অবস্থায় এদের বংশ বৃদ্ধি না হওয়া। ১৬১৩ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর প্রথম কোনো পোষা চিতার বাচ্চা দেওয়ার ঘটনা বর্ণনা করেন তার 'তুজাক-ই-জাহাঙ্গিরি' বইয়ে।
অ্যান্টিলোপ ধরার জন্য চিতা পোষ মানানোর প্রথম রেকর্ড পাওয়া যায় কালিকিনির রাজার রাজসভার বারো শতকের বিবরণীতে। মধ্যযুগে ভারতজুড়ে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে স্পোর্টটি। ওই সময় চিতার সাহায্যে কৃষ্ণসার মৃগ শিকারের ধুম পড়ে যায়। 'একটা প্রশিক্ষিত চিতার দাম পড়ত দেড়শ থেকে আড়াইশ রুপি'—জানান ১৮৪০ সালের আশপাশের সময় নাগপুর অনিয়মিত ফোর্সের কমান্ডার মেজার হেনরি শেকস্পিয়ার।
বাদশাহ আকবর তার ৪৯ বছরের শাসনামলে আনুমানিক ৯ হাজার চিতা বন্দি করেন। বন্য চিতা ধরার হারটা আঠারো শতকের কোনো এক সময়ে একেবারে চূড়ায় পৌঁছে যায়।
জঙ্গল থেকে চিতা ধরে আনতে আনতে জঙ্গলে এদের সংখ্যা একেবারে কমে যায় বিংশ শতকের গোড়ার দিকে। অ্যান্টিলোপ শিকারের খেলাটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ভারতীয় রাজারা ১৯১৮-৪৫ সালের মধ্যে আফ্রিকা থেকে চিতা আনার খবর মেলে।
চিতারা একেবারেই শান্ত গোছের প্রাণী। ভারতীয় চিতার দ্বারা কেবল একবারই প্রাণহানির রেকর্ড পাওয়া যায়, সেটা ১৮৮০ সালের ঘটনা। পরিবেশবাদী ঐতিহাসিক মহেশ রানগর্জন 'জার্নাল অব মুম্বাই ন্যাচারাল হিস্ট্রি'র ১৯৯৮ সালের সংখ্যায় লেখেন, ১৮৭১ সালে প্রাপ্তবয়স্ক ও বাচ্চা চিতা জীবন্ত উদ্ধারের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। উপমহাদেশে চিতার ভাগ্য নির্ধারণে কফিনে শেষ পেরেক হিসাবে কাজ করে এই ঘোষণা।
যতদূর জানা যায় ভারতের শেষ তিনটি চিতা শিকার করেন সারগুজার মহারাজা, ১৯৪৮ সালে। তবে ১৯৫১ সালে ছত্তিশগড়ের উত্তর-পশ্চিমে একটি মাদী চিতা দেখার রেকর্ড আছে। ১৯৫১-৫২ সালের দিকেই ভারত থেকে চিতাকে বিলুপ্ত বলে ঘোষণা করা হয়। তবে এরপরও চিতা দেখার বিশ্বাসযোগ্য তথ্য মেলে, ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালে মধ্যপ্রদেশের করিয়া এবং সুরগুজার জঙ্গলে, তারপর ১৯৭৫-এ হাজারিবাগ জেলার দান্তো কালান গ্রামে।
সর্বশেষ ২০১৩ সালে উড়িষ্যার সিমলাপালের জঙ্গলে চিতা দেখার দাবি করেন টাইগার প্রজেক্টের দুজন কর্মকর্তা। তবে গবেষকরা এই দাবিকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। তাঁদের ধারণা, অ্যালবিনো চিতাবাঘকেই চিতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন কর্মকর্তারা।
শিকার ও বন-জঙ্গল নিয়ে প্রচুর বই পড়লেও চিতার কথা খুব বেশি পাইনি। ব্যতিক্রম এ. মারভিন স্মিথের 'অ্যাডভেঞ্চার ইন দি ইন্ডয়ান জাঙ্গল'। সেবা প্রকাশনীর জন্য অনুবাদ করেছিলাম এটি।
মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার মারভিন স্মিথ পেশাগত কারণ ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত ভারতের গভীর জঙ্গলে কাটিয়েছেন। ওই সময় চিতা নিয়ে কয়েকটি অভিজ্ঞতা হয় তাঁর। জানান, ভারতের নাগপুরের সারান্ডার গহীন অরণ্যেও তখন কিছু চিতা ছিল। বাংলা-নাগপুর রেলওয়ের কাছে জেরাইকেলা নামের এক গাঁয়ের এক লোকের একটা পোষা হরিণ ছিল। এক পূর্ণিমার রাতে লোকটা কুঁড়ের সামনে একটা চৌকিতে ঘুমাচ্ছিল। তখন একটা চিতা চৌকির তলা দিয়ে গুটিসুটি মেরে কুঁড়েতে প্রবেশ করে হরিণটাকে মেরে যে পথে এসেছিল সে পথেই জঙ্গলে ঢুকে যায়। লেখকের বাংলো থেকে আঠারো মাসে এভাবে সাতটি কুকুর লোপাট করে চিতারা। এমনকি গুদামের লোহার গরাদ ভেঙে ভেতরে ঢোকার চেষ্টাও করে একটা চিতা। চিতা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত চিত্ররকা থেকে, যার অর্থ ফোঁটা।
১৯৩৫ সালে বোম্বাই ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির এক জার্নালে চিতার এলাকা হিসাবে বাংলা থেকে মধ্যপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও রাজপুতানা (বর্তমান রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাটের আংশিক) এবং মধ্যপ্রদেশ থেকে ডেকানের (দক্ষিণের ভারতের বড় একটি অংশ ডেকান মালভূমির অংশ) কথা বলা হয়েছে। এর কোনোটির সঙ্গে বাংলাদেশের সীমানা নেই। সে হিসাবে ধরে নেওয়া যায় বাংলাদেশের সীমানায় পড়া কোনো এলাকায় নিকট অতীতে অন্তত এই জন্তুটি ছিল না।
এবার বরং চিতাবাঘ বা লেপার্ডের সঙ্গে চিতা বা হান্টিং লেপার্ডদের পার্থক্যটা একটু জানার চেষ্টা করি। চিতাবাঘের নখ বিড়ালের মতো, চিতার নখ কুকুরের মতো। অনেক শিকারিরই ধারণা, হায়েনার নিকট কোনো গোত্র থেকে এসেছে চিতা। চিতাবাঘ আর চিতা দুটোর চামড়ার বেলায় হলদে-বাদামি জমিনে কালো ফোঁটা আছে। তবে একটু ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখবেন চিতাবাঘের কালো ফোঁটাগুলো মাঝখানে হলুদ রেখে অনেকটা বলয়ের রূপ নিলেও চিতার বেলায় মাঝখানের হলুদ চিহ্ন ছাড়া কেবলই কালো ফোঁটা। চিতার উচ্চতা চিতাবাঘের চেয়ে বেশি হলেও এরা অনেক হালকা-পাতলা, ওজনে কম, এটা একে দ্রুত ছুটতে সাহায্য করে।
এশীয় এবং আফ্রিকান দুই ধরনের চিতাই বিদ্যুৎগতির জন্য বিখ্যাত, তবে এশীয় চিতারা আফ্রিকান ভাইদের থেকে একটু পাতলা, রংটাও হালকা।
একসময় এশীয় চিতা ছিল মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং আরব উপদ্বীপে। পাকিস্তানে বেলুচিস্তানে ১৯৯০-এর দশকেও ছিল, শেষটি মারা পড়ে ১৯৯৭ সালে চাগাইয়ে। কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান থেকেও ১৯৮০ সালের পরে বিদায় নেয়। তবে ২০১৪ সালে হঠাৎই তুর্কমেনিস্তানের বাধিজ স্টেট ন্যাশনাল পার্কে একটা চিতার দেখা মেলে। হয়তো ওটা ইরান থেকে এসেছে।
এবার এশীয় চিতার একমাত্র আবাসস্থল ইরানের দিকে নজর দেওয়া যাক। ইরানের বিস্তৃত মালভূমিতে এখন ৫০টির কম চিতা টিকে আছে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা দ্রুত পদক্ষেপ ছাড়া এদের টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কয়েকটি এলাকায় থাকলেও তুরান আর মিয়ানদাশতের আশপাশে বাস করা চিতাগুলোই শেষ আশার আলো হিসাবে টিমটিম করে জ্বলছে।
চিতাদের বড় সমস্যা রাখালরা। কালেভদ্রে ভেড়া বা ছাগল শিকারের অপরাধে তারা ফাঁদ পেতে কিংবা কুকুর দিয়ে তাড়িয়ে চিতা শিকার করে। আবার রাস্তা পেরোতে গিয়ে ভারী যানবাহনের ধাক্কায়ও মারা পড়ে অনেক চিতা।
গত ১৫ বছরে চিতার সংখ্যা দুনিয়াজুড়ে শতকরা ৫৩ ভাগ কমেছে বলে জানিয়েছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক। বিচরণের এলাকার ৯১ ভাগই হারিয়েছে চিতারা। ইরানের ওই চিতাসহ গোটা পৃথিবীতে এখন সাকল্যে ৭ হাজার ১০০ চিতা আছে। আফ্রিকান চিতারা মহাদেশের অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা, জিম্বাবুয়ে ও নামিবিয়া এই ছয়টি দেশে আটকে গেছে।