এপ্রিল-জুনে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সুদ মওকুফ বেড়েছে ১২ গুণ
হঠাৎকরেই বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদ মওকুফের প্রবণতা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা অনাদায়ী ঋণের আসল টাকা আদায়ে সুদ মওকুফের পরিমাণ বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণের সুদ মওকুফ করেছে ২ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। যা আগের (জানুয়ারি-মার্চ) প্রান্তিকে ছিল মাত্র ১৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ হিসাবে দেখা যায়, ব্যাংকগুলো আগের প্রান্তিকের তুলনায় ২ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা বেশি সুদ মওকুফ করেছে, যা প্রায় ১২ গুণ বেশি।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে যে ঋণগুলো আদায় হচ্ছে না, সেসব ঋণ আদায়ে কিছুটা সুদ মওকুফ স্বাভাবিক ব্যাপার।
কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যাংকগুলো এখন অন্যান্য ব্যাংকের পরিচালকদের সঙ্গে মিলে যোগসাজশের মাধ্যমে সুদ মওকুফ করছে, যা মওকুফকৃত ঋণের সুদের পরিমাণ বৃদ্ধিতে ব্যাপকভাবে অবদান রাখছে বলে মন্তব্য করেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, গত দুই বছরে ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায়ে নানান ধরনের ছাড় ছিল। আগের সময়ে অনেক গ্রাহকের ঋণ মন্দমানে থাকতে পারে। তাদের থেকে মূল আদায় করতে গিয়ে ব্যাংকগুলো কিছুটা সুদ মওকুফ হয়তো করেছে, যার কারণে চলতি বছরের জুনে এর পরিমাণটা বেড়ে গেছে।
ঋণের সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে কোন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা রয়েছে। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান নীতিমালা পরিপন্থী উপায়ে সুদ মওকুফ করে থাকে, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে এবং একইসঙ্গে গ্রাহকের সুবিধা কর্তন করা হবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় থাকাকালীন ২০১৯ সালে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদ মওকুফ করেছে ২ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। কোভিডের বছর, ২০২০ সালে করেছে ১ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা এবং বিদায়ী ২০২১ সালে ব্যাংকগুলো ১ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা ঋণের সুদ মওকুফ করেছে।
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, গ্রাহকের সার্বিক অবস্থা খারাপ থাকলে এবং দীর্ঘদিন ধরে খেলাপি রয়েছে, এমন ঋণকে স্বাভাবিক রাখতে ঋণের সুদ মওকুফ করা হয়। ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের বাস্তবতার নিরিখে এটি করে থাকে, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি হয়ে থাকে চতুরতার মাধ্যমে। এর ফলে প্রভাবশালী গ্রাহকরা সহজে এই সুবিধার সুযোগ নেয়।
এমন কাজ অন্যদের ঋণ পরিশোধে নিরুৎসাহিত করবে, একইসঙ্গে ব্যাংকগুলোর আয় কমাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর চলতি বছরের জুন মাস শেষে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫২ হাজার টাকা। এরমধ্যে ৫৫ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা খেলাপি রয়ে গেছে, যা মোট ঋণের ২১.৯৩ শতাংশ।
একইসময়ে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬২ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা।
সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় কাছাকাছি থাকলেও সুদ মওকুফে এগিয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। চলতি বছরে (এপ্রিল-জুন) সরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে ৮২২ কোটি টাকা, এরমধ্যে সুদ মওকুফ হয়েছে ১৯ কোটি টাকা। এছাড়া, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে ২ হাজার ২১১ কোটি টাকা, অথচ তারা সুদ মওকুফ করেছে ২ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, ব্যাংক গ্রাহকের ঋণের সুদ তখনই মওকুফ করে, যখন দেখে ঋণের বিপরীতে জামানতের পরিমাণ কম। আদালতের প্রক্রিয়ায় টাকা পেতে দীর্ঘ সময় লাগে, তাই সুদ মওকুফ করে আসলটা আদায় করার চেষ্টা করা হয়।
পৃথক ব্যাংকের পরিচালকদের সঙ্গে যোগসাজশে সুদ মওকুফের বিষয়ে তিনি বলেন, "আমি এতে কোনো সমস্যা দেখছি না, তবে এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে অবশ্যই বিচক্ষণ হতে হবে।"
কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত মে মাসে ঋণের সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে স্পষ্ট করে জানায়, ব্যাংকগুলো ঋণের সুদ মওকুফ করতে পারবে। তবে জালিয়াতির মাধ্যমে সৃষ্ট ঋণ এবং ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের সুদ এবং মূল মওকুফ করা যাবে না।
একইসঙ্গে, ঋণের সুদ মওকুফ অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে।
এদিকে, চলতি বছরের জুন প্রান্তিকে ৩ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ব্যাংকগুলো। আগের প্রান্তিক, মার্চে ব্যাংকগুলোর ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে পুনঃতফসিলের পরিমান বেড়েছে ৬৪ শতাংশ।
প্রায় দুইমাস আগে, জুলাইতে ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদেরও একই ক্ষমতা দেওয়া হয়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ বাড়ছে।
এদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে আরও দেখা গেছে, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৫২৯ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ হয়েছে জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে। একই সময়ে লিখিত ঋণ আদায় হয়েছে ২০৭ কোটি টাকা।
এছাড়া, চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিকে ৬ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা ব্যাংকিং খাতে খেলাপি হয়েছে। তবে, এ সময়ে আদায় হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ অবলোপন ও খেলাপি বৃদ্ধির মার্চের প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১০টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর কারণ জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছে।
চলতি বছরের জুন প্রান্তিকে দেখা যায়, সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে অবলোপনকৃত ঋণ থেকে আদায়ের হারে অগ্রগতি হয়েছে। এ সময়ে নতুন করে ঋণ আবলোপন করা হয়েছে ৫৪৪ কোটি টাকা। একই সময়ে আদায় হয়েছে ৩৫৭ কোটি টাকা।
তবে, জুন প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এই তিন মাসে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৫ হাজার ৪৯০কোটি টাকা। একই সময়ে আদায় হয়েছে ৩ হাজার ৮৫৭ কোটি টাক।
ব্রাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সেলিম আরএফ হোসেইন টিবিএসকে বলেন, ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী ঋণের সুদ মওকুফ করবে, এটি দোষের কিছু নয়। তবে যোগসাজশে যদি কেউ ঋণের সুদ মওকুফ সুবিধা পায়, তাহলে এটি কোনভাবেই ব্যাংকিং খাতের জন্য কাম্য নয়। এ বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের খতিয়ে দেখা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০০৩ সাল থেকে ব্যাংকিং খাতে ঋণ অবলোপন পদ্ধতি চালু করেছে। ব্যাংকগুলোকে তাদের নিয়মিত ঋণের ০.২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হয়। কিন্তু খেলাপি ঋণের শ্রেণীভেদে এই পরিমাণ ২০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
তবে, ঋণ বাতিলের ক্ষেত্রে পুরো ঋণের পরিমাণ প্রভিশন হিসেবে রাখতে হবে।
কোভিডের প্রভাবের কারণে দেশের ব্যবসায়ীদের কথা মাথায় রেখে ২০২০ সালে গ্রাহকদের ঋণের এক টাকাও শোধ করতে হয়নি। পরের বছর, ২০২১ সালে ঋণের মাত্র ১৫ শতাংশ পরিশোধ করে খেলাপি হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছেন ঋণগ্রহীতারা।
তবে, চলতি বছরে এভাবে ঢালাও সুযোগ না দিয়ে ঋণের ২৫ থেকে ৭৫ শতাংশ কিস্তি পরিশোধের মাধ্যমে খেলাপি হওয়া থেকে বাঁচার সুযোগ দেওয়া হয় ঋণগ্রহীতাদের।