ফিদেল ক্যাস্ত্রো ও তার অলৌকিক গাভী!
দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের প্রতি কিউবানদের বেশ দুর্বলতা থাকলেও, একটা সময় এসেছিল যখন তারা দুধের অভাবে দিন কাটিয়েছে। ইতিহাসের সেই ক্ষুদ্ধ-অস্থির সময়ে, কিউবানদের প্রয়োজনের সময়ে কোনো বিজ্ঞানী বা উদ্যোক্তা দেশকে বাঁচাতে পারেননি; পেরেছিল শুধুমাত্র একটি গাভী! দেশের লাখো মানুষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সাথেও জড়িয়ে ছিল এই প্রাণীটির নাম। সে কারণেই এখনো কিউবার ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণ করা হয় সেই অলৌকিক গাভীকে!
'উবরে ব্লাংকা' নামক এই গাভীটি ছিল পৃথিবীর অন্য সব গাভীর চাইতে আলাদা। কিন্ত কেন? কারণ নিজের উৎপাদিত দুধের মাধ্যমে একাই কিউবার ডেইরি সংস্কৃতিতে বিপ্লব ঘটিয়েছিল উবরে ব্লাংকা; যদিও তা ছিল সাময়িক।
'উবরে ব্লাংকা' কেন বিশেষ গাভী?
'উবরে ব্লাংকা'র বিখ্যাত হওয়ার পেছনে রয়েছে লম্বা ইতিহাস। ১৯৫৯ সালের জানুয়ারির দিকে ফিদেল ক্যাস্ত্রো হয়ে ওঠেন কিউবার প্রতিচ্ছবি। তিনি ছিলেন একজন তুখোড় রাজনীতিবিদ, চিন্তাধারায় সমাজতান্ত্রিক এবং যা সিদ্ধান্ত নিতেন তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করে দেখাতেন। কিউবার ইতিহাসে তো বটেই, বিশ্বের ইতিহাসেও অত্যন্ত বিচক্ষণ এই নেতা ছিলেন দুগ্ধভক্ত। অর্থাৎ, সেই সাদা-পুষ্টিকর তরলটি খেতে খুব পছন্দ করতেন তিনি। শুধু তাই নয়, দুধের স্বাদের ব্যাপারেও বেশ সচেতন ছিলেন ক্যাস্ত্রো।
আর ক্যাস্ত্রোর এই দুর্বলতা ধরে ফেলে সিআইএ এবং তাকে বেশ কয়েকবার হত্যার চেষ্টা করে ঘাতকরা। ষাটের দশকে একবার হোটেল হাবানা লিবরে'র ফ্রিজারে রেখে দেওয়া হয়েছিল একটি বিষাক্ত পিল। কারণ ঐ হোটেলে প্রতিদিন চকোলেট মিল্কশেক খেতে যেতেন ক্যাস্ত্রো। মিল্কশেক বানানোর সময় বিষাক্ত পিলটি মিশিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল তাদের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘাতকদের এই উদ্দেশ্য সফল হয়নি, কারণ ফ্রিজারের ভেতরের দেয়ালে লেগে পিলটি ঠান্ডায় বরফ হয়ে যায় এবং বের করে আনার সময় ভেঙ্গে যায়।
প্রচুর চাহিদা, কিন্তু যোগান নেই
জনগণের চাহিদা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের একটি আলাদা শিল্প গড়ে ওঠে কিউবায়। শহরের আনাচে-কানাচে গড়ে ওঠে বড় বড় আইসক্রিম পার্লার। আর এই পরিবর্তনের জন্য ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে ধন্যবাদ দিতেই হয়।
যত দিন যাচ্ছিলো ততই কিউবানদের দুধের চাহিদা বেড়ে চলছিল। কিন্তু এই বিপুল চাহিদার যোগান দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না দেশটিতে। কিউবার দেশি 'সেবু' প্রজাতির গাভী যে পরিমাণ দুধ দিত, তাতে জনগণের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব ছিল না। এরই মধ্যে ক্যাস্ত্রো কানাডা থেকে উচ্চ-উৎপাদনশীল হলস্টেইন প্রজাতির গরুও এনেছিলেন, কিন্তু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুর মধ্যে সেগুলো টিকে থাকতে পারেনি।
সব রকম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ক্যাস্ত্রো একটি নতুন কিউবান জাতের গরু তৈরি করার উদ্দেশ্যে গরুর কৃত্রিম ক্রস প্রজননের নির্দেশ দেন, যেগুলো হবে উচ্চ-উৎপাদনশীল। এই প্রক্রিয়ার ফলাফল দাঁড়ায় এই- একটি দেশীয় 'সেবু' জাতের গাভী যেখানে দৈনিক দেড় লিটার দুধ দেয়, সেখানে গাভীটি এমন বাছুর প্রসব করবে যা বড় হলে ১০ লিটার দুধ দিতে পারবে! ক্যাস্ত্রোর দূরদর্শী চিন্তা ছিল- এই গাভীগুলোর শত শত প্রজনন করা হবে এবং শীঘ্রই এগুলোর সংখ্যা বেড়ে লাখে পৌঁছাবে।
কথায় বলে, বুদ্ধিমানের জন্য একটি ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়াই যথেষ্ট। ক্যাস্ত্রো ছিলেন তেমনই একজন মানুষ। ১৯৭২ সালে কৃত্রিম ক্রস প্রজননের পরীক্ষা চালানোর পর একমাত্র যে সফল গাভীটির জন্ম হয়েছিল, তার নাম উবরে ব্লাংকা। শীঘ্রই গাভীটি ক্যাস্ত্রোর পোষা প্রাণীর মতো হয়ে ওঠে। নিউভা জিরোনাতে ক্যাস্ত্রোর সরাসরি তত্ত্বাবধানে একটি আস্তাবলে গাভীটি লালন-পালন করা হয়। বলাই বাহুল্য, গাভীটির জীবনযাপনের পরিবেশ ছিল অধিকাংশ কিউবানের চাইতে উন্নত! প্রতিনিয়ত নতুন নতুন খাবার দেওয়া হতো 'উবরে ব্লাংকা'কে। এমনকি গাভীটির যেন অস্বস্তি না হয় এবং দুশ্চিন্তায় না থাকে, তার জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্থানে এটির দুধ দোয়ানো হতো এবং সেসময় মৃদু সঙ্গীত ছেড়ে রাখা হতো।
ক্যাস্ত্রো তার এই আদরের গাভীর মাধ্যমে বিশ্বরেকর্ড গড়ার পরিকল্পনা করেন। ১৯৭৫ সাল থেকে ৮০ লিটার করে দুধ দিয়ে যে রেকর্ড নিজের দখলে রেখেছিল আমেরিকান গাভী আরলিন্ডা এলেন, সেই রেকর্ড ভেঙ্গে দেয় উবরে ব্লাংকা। ক্যাস্ত্রো তার কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, প্রতিদিন ছয়বার করে যেন উবরে ব্লাংকার দুধ দোয়ানো হয় এবং প্রতিবার কি পরিমাণ দুধ দিচ্ছে তার হিসাব রাখা হয়। এমনকি উবরে ব্লাংকা কতখানি দুধ দিচ্ছে তা গণমাধ্যমের সংবাদেও প্রচার করা হতো প্রতিদিন!
শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, কৃত্রিমভাবে প্রজনন করা এই গাভী ১৯৮২ সালের জুলাই মাসে মোট ১০৯.৫ লিটার দুধ দিয়েছে। এরপরেই ৩০৫ দিনের একটি চক্রে মোট ২৪,২৬৯ লিটার দুধ দিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে উবরে ব্লাংকা।
উবরে ব্লাংকা ততদিনে বিশ্বব্যাপী এক রাজনৈতিক প্রতীক। ক্যাস্ত্রো তার জাতীয় বক্তৃতায় প্রায়ই উবরে ব্লাংকার উদাহরণ দিতেন এবং তিনি কমিউনিস্টদের ভালো মানের দুধ উৎপাদন ও প্রজনন ক্ষমতার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এখানেই শেষ নয়, উবরে ব্লাংকার দৈনন্দিন জীবন অনেকটা সোপ অপেরার মতো করেই টেলিভিশনে প্রচারিত হতো যা স্থানীয় জনসাধারণকে মুগ্ধ করতো। সমগ্র দেশবাসী এই বিখ্যাত গাভীটিকে ভালোবাসতো। এমনকি অলৌকিক স্তন্যপায়ী প্রাণীটিকে এক নজর দেখতে ভিড় জমাতেন দেশ-বিদেশের কূটনীতিবিদ ও সাংবাদিকরা!
কিন্তু একটা গাভীর পক্ষে পুরো দেশবাসীর প্রয়োজন মেটানো অসম্ভবই বটে! যেহেতু অন্য কোনো গাভীই তার সমপরিমাণ দুধ দিতে পারতো না, তাই একাই সব ধকল সহ্য করতে হতো উবরে ব্লাংকাকে। এভাবে প্রায় ১৩ বছর দৈনিক চার বার (কখনো তারও বেশি) করে দুধ দেওয়ার পর গাভীটির স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। ১৯৮৫ সালে তৃতীয় বাছুরের জন্ম দেওয়ার সময় গাভীটির শারীরিক জটিলতা দেখা দেয় এবং তাকে মায়াবেকিতে অবস্থিত ন্যাশনাল সেন্টার ফর এগ্রিকালচারাল হেলথ-এ নেওয়া হয়। ভবিষ্যতে কাজে লাগানোর জন্য এখানে গাভীটির ডিম্বাণু হিমায়িত করে রাখা হয়।
কিন্তু এ প্রক্রিয়ার ফলে গাভীটির নিতম্বে একটি টিউমার হয়ে যায় এবং অল্প কিছুদিন পরেই তাকে যন্ত্রণাহীন মৃত্যুবরণ (ইউথানাইজড) করতে হয়। উবরে ব্লাংকার দেহের অবশিষ্টাংশ এখনো ঐ কেন্দ্রে কাচের জারের মধ্যে সংরক্ষিত রয়েছে।
উবরে ব্লাংকা যেদিন মারা যায়, তাকে উৎসর্গ করে দীর্ঘ স্তুতি প্রকাশিত হয় সংবাদপত্রে। গাভীটির মৃত্যুতে শোক প্রকাশের জন্য বরাদ্দ ছিল সংবাদপত্রের পুরো এক পৃষ্ঠা। এছাড়াও, মৃত্যুর পর সামরিক মর্যাদায় বিদায় জানানো হয়েছিল প্রাণীটিকে। এর অল্প কিছুদিন পরেই নিউভা জিরোনা শহরে নিজের প্রিয় গাভীর একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করান ক্যাস্ত্রো।
উবরে ব্লাংকা সংক্রান্ত উত্তেজনা ম্লান হওয়ার সাথে সাথে আবারও খবরের শিরোনামে উঠে আসে কিউবায় দুধের ঘাটতির প্রসঙ্গ। পরবর্তী বছরগুলোতেও এ সংকট শুধু বাড়তেই থাকে। সেসময় কিউবায় দুগ্ধজাত পণ্য ছিল একটি বিলাসিতা; তখন শুধুমাত্র শূন্য থেকে সাত বছর বয়সী শিশু, গর্ভবতী মহিলা এবং অসুস্থদের জন্য দুগ্ধজাত পণ্য ভর্তুকি ছিল।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের চেষ্টা করা হলেও তা ব্যর্থ হয়। ২০০২ সালে উবরে ব্লাংকার জেনেটিক উপকরণ থেকে উন্নত গরু ক্লোন করার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু উচ্চমানের খাদ্যের অভাবে, কৃষকেরা শুধু কম চর্বিযুক্ত, কম ফলনশীল দুধ উৎপাদন করতে পেরেছিল।
সূত্র: অ্যামিউজিং প্লানেট