চার বছর পর বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৪% ছাড়ালো
একদিকে যেখানে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি কঠোর করছে, সেখানে বাংলাদেশে আগস্ট মাসে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ অতিক্রম করেছে, যা চার বছরের সর্বোচ্চ।
জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও, ক্রেডিট বৃদ্ধির কারণে পণ্য ও পরিষেবার দাম বাড়ছে।
আগস্টে ক্রেডিট প্রবৃদ্ধি ১৪.০৭ শতাংশে পৌঁছেছে যা বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে চলতি অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত ১৪.১ শতাংশের আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
উচ্চ আমদানি ব্যয়ের ফলে অর্থায়ন ব্যয় বেড়েছে, যা বেসরকারি খাতের ঋণ বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে বলে জানিয়েছেন শিল্পের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা।
সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাফর আলম টিবিএসকে বলেন, "কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি বছরের মুদ্রানীতিতে প্রাইভেট সেক্টের ক্রেডিট গ্রোথ কিছুটা কমালেও ব্যাংক ঋণের সুদহার একই রেখেছে। তাই গ্রাহকরা স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ায় ঋণের গোথ বাড়ছে।"
সুদের হার বর্তমানে প্রায় ৯ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই হার আরও বেশি হওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, "সকল ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে অতিরিক্ত মূল্য খরচ করতে হচ্ছে যার কারণে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে।"
সামগ্রিকভাবে, পাঁচ মাসের তীব্র বৃদ্ধির পর জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি ০.০৮ শতাংশ পয়েন্ট কমেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৮.১৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, জুন থেকে এক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি কমেছে ০.১৮ শতাংশ পয়েন্ট।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ায় আগামী মাসে মূল্যস্ফীতি আরও কমবে বলে আশা করছে সরকার।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সম্প্রতি উল্লেখ করেছেন, সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির পতন মূলত খাদ্য মূল্যস্ফীতি হ্রাসের উপর নির্ভর করে।
তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমতে থাকায় আগামী মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতির হার আরও কমবে।
ডলারের দাম কমবে বলে আশা প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও বলেছেন, আগামী এক থেকে দুই মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি স্বাভাবিক হতে পারে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কোভিড পরবর্তিতে দেশের আমদানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোতে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এছাড়া প্রতি ডলারে দাম বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। যার কারণে অতিরিক্ত মুল্য খরচ করতে হওয়ায় ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "ব্যাংকগুলোতে ঋণের সুদহার খবই কম। গ্রাহকরা সহজেই ঋণ পাচ্ছে যার কারণে ঋণের পরিমাণটা বেড়ে যাচ্ছে। এখন দেখতে হবে গ্রাহকরা কোন খাতে এ ঋণগুলো খরচ করছে। সেগুলো বিবেচনা করে ঋণ দেওয়া উচিত।"
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশে ডলারের মুল্য ছিল ৮৫ টাকা। এরপর থেকে দেশের আমদানি বাড়তে থাকায় রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি শুরু হয়। নিয়মিত ডলার বিক্রির কারণে কমতে থাকে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ। এছাড়া চলতি বছরে ৯ জানুয়ারি ডলারের দাম এক টাকা বেড়ে ৮৬ টাকা হয়।
চলতি বছরে এপ্রিল থেকে ডলারের সংকট আরও বাড়তে থাকে যার ফলে দামও বাড়তে থাকে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারি আমদানি বাবদ প্রতি ডলার বিক্রি করছে ৯৬ টাকা। তবে ব্যাংক টু ব্যাংক ডলারের রেট সর্বোচ্চ ১০৫ টাকা ৩৫ পয়সায় লেনদেন হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতির বিবৃতি অনুসারে, অর্থ প্রবাহকে শক্ত করার অংশ হিসেবে বেসরকারি খাতের ঋণ বৃদ্ধির সীমা ২০২২ অর্থবছরের ১৪.৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০২৩ অর্থবছরে ১৪.১ শতাংশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, "আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে এখন মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এই মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে টাকার সাপ্লাই কমাতে হবে। মানুষের হাতের টাকার সাপ্লাই বাড়তে থাকলে তাহলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে।"
"এখন বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে তবে এটা যদি উৎপাদন খাতে ব্যয় হয় তাহলে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পরবে না, কারণ উৎপাদন বাড়লে পণ্য মানুষের নাগালে থাকবে তখন মূল্যস্ফীতি কমতে থাকবে," যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্টে দেখা যায়, দেশের ব্যাংকিং খাতে গত জুন মাসে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। এক মাসের ব্যবধানে জুলাইতে এসে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। যার ফলে দেখা গেছে বেসরকারি খাতের ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকায় ব্যাংকগুলোর অ্যাকসেস লিকুইডিটি কমছে।
গত অর্থবছরের আগস্টে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। তবে বিদায়ী অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি ও আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণে ব্যাংকগুলোর কাছে ৭.৬ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে।
এছাড়া চলতি বছরের এখন পর্যন্ত ৩ বিলিয়নের বেশি বিক্রির ফলে গত ২১ সেপ্টেম্বর রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৬.৯৭ বিলিয়ন ডলার।
বিদায়ী অর্থবছরে রপ্তানির তুলনায় আমদানির ব্যয় ও পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে দেশের ইতিহাসে ২০২১-২২ অর্থবছরে সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ৩৩.২৫ বিলিয়ন ডলার।
একই সময় বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট) ঘাটতিও সাড়ে ১৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
যদিও চলতি অর্থবছরে শুরু থেকে আমদানি ব্যয় কমে আসায় ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণে কিছুটা দেশের ডলার মার্কেট কিছুটা স্বাবাবিক অবস্থানে রয়েছে। এখন ডলারের দাম নির্ধারণ হচ্ছে চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে।
গত দুই মাস যাবৎ আমদানির পরিমাণ কমছে। এলসি (লেটার অফ ক্রেডিট) নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আমদানি আগের মাসের তুলনায় আগস্টে ২০ শতাংশ কমেছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বাজারকে স্থিতিশীল করতে এলসি মার্জিনকে শতভাগে উন্নীত করার মতো বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলেই তা সম্ভব হয়েছে। এমনকি এলসি খোলার ক্ষেত্রেও নিম্নমুখী প্রবণতা ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগস্টে এলসি পেমেন্ট হয়েছে ৫.৯৩ বিলিয়ন ডলার, যা আগের মাসের ৭.৪২ বিলিয়ন ডলার থেকে কমেছে।