বাঙালির ইলিশ আর সিন্ধিদের পাল্লা, এক মাছে মাত দুই জাত
ইলিশ মাছের সঙ্গে বাঙালিয়ানা এক হয়ে গেছে অনেক আগেই। একবেলা পাতে ইলিশ পড়লে বাঙালি সেদিন খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। তবে ইলিশের সঙ্গে আরও একটি জাতিরও সমান বন্ধুত্ব।
পাকিস্তান ও ভারতের সিন্ধি জাতির মধ্যেও ইলিশ ভীষণ পরিচিত একটি মাছ। তারা ইলিশকে ডাকেন পাল্লা হিসেবে। সিন্ধিদের রান্না করা ইলিশ মাছকে বলা হয় 'কোক পাল্লা'। মাছের পেট কেটে তার ভেতরে টমেটো, পেঁয়াজ, তেঁতুল, মসলা ইত্যাদি পুরে রান্না করা হয়।
এ কথা সবাই জানে, বাংলাদেশ ও ভারত; দুই দেশের বাঙালিদের রান্না ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ ইলিশ মাছ। তবে একসময় পাকিস্তানের সিন্ধু নদে প্রচুর পাল্লা ধরা পড়ত। যদিও এখন আর জেলেদের জালে খুব একটা আটকা পড়ে না মাছটি।
বাঙালির কাছে ইলিশ মাছ উৎসবের অনুষঙ্গ। মাছ কেনা থেকে শুরু করে খাওয়া, ইলিশ প্রসঙ্গে প্রতিটি ধাপই আয়েশ করে উপভোগ করেন বাঙালিরা। দুর্গাপূজার দশমীর দিনে দুর্গাকে ইলিশ উৎসর্গ করেন বাঙালি হিন্দুরা।
বাঙালি শিল্প, সাহিত্য ও সিনেমাতেও স্থান পেয়েছে ইলিশ। বাঙালির বিয়ে বা অন্য অনুষ্ঠানে আর সবকিছু নিয়ে যেমন কথা হয়, তেমনি অতিথিদের খাওয়ানোর জন্য কত বড় ইলিশ মাছ কাটা হলো সেটাও দিব্যি আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে।
সিন্ধিদের কাছেও পাল্লার মর্যাদা এমনই। পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশ থেকে সিন্ধিরা যখন বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গেলেন, তখন পাল্লার স্মৃতি তাদের অনেকের কাছে অতীতের একটি ধ্রুব স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেল।
ইলিশের সিন্ধ সংযোগ
উপমহাদেশ ভাগের আগে সিন্ধের পিকনিক আর বারবিকিউ পার্টিগুলোতে পাল্লা ছিল জনপ্রিয় খাবার। সিন্ধ প্রদেশের বিভিন্ন রোডসাইড রেস্তোরাঁ আর ধাবাতে রান্না করা পাল্লার সুবাস এখনো বাতাসে ম-ম করে।
সিন্ধের গ্রামগুলোতে বিশেষ দিন বা অনুষ্ঠান উপলক্ষে পাল্লা উপহার দেওয়া হয়। আমের সঙ্গে পাল্লা মাছ উপহার দেওয়া এ অঞ্চলের একটি প্রতিষ্ঠিত প্রথা।
সিন্ধি কালচার ফাউন্ডেশন-এর প্রতিষ্ঠাতা অরুণা মাদনানি বলেন, 'আমার প্রয়াত বাবা প্রায় রোববারের নদীর ধারের পিকনিকের কথা বলতেন। পুরুষেরা মালাখ্রো (সিন্ধের নিজস্ব পদ্ধতির মুষ্টিযুদ্ধ) খেলতেন, এরপর শরীর মালিশ করে নিতেন। নারীরা নদীর নির্দিষ্ট এলাকায় স্নান করতেন। সবশেষে তখুনি রান্না করা টাটকা ইলিশ দিয়ে ভোজ সারতেন সবাই।'
প্রতি বছর বর্ষার সময় পোনা ছাড়ার জন্য সমুদ্র থেকে নদীতে চলে আসে ইলিশগুলো। কিংবদন্তি আছে, সিন্ধু নদের পাল্লা মাছগুলো সাঁতার কেটে সুক্কুর শহরে নদের ওপর অবস্থিত জিন্দা পীরের মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যায়। এ মাজার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৭ শতকে।
এ জিন্দা পীরের মাজার হিন্দু আর মুসলিম উভয়ের কাছে পরম শ্রদ্ধেয়। কিংবদন্তি থেকে আরও জানা যায়, পাল্লা প্রথমে মোটামুটি স্বাদের কালো রংয়ের মাছ হিসেবে থাকে। কেবল জিন্দা পীরের আশীর্বাদ পাওয়ার পরই এগুলো অতুলনীয় স্বাদ ও রুপালি গাত্রবর্ণ লাভ করে।
সিন্ধি দেবতা ঝুলেলাল পাল্লা মাছকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করেন। বলা হয়, জিন্দা পীরের মাজারকে যেন পিঠ দেখাতে না হয়, সেজন্য সুক্কুর শহরের উত্তরে কখনো যায় না পাল্লা।
তবে সিন্ধের জেলেজাতি মোহানাদের কাছে পাল্লার স্বাদের পেছনের কারণটা আরেকটু বস্তুগত। তাদের মতে সামুদ্রিক লোনা পানি থেকে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে নদীর মিঠা পানিতে প্রবেশ করার সময়ই পাল্লার স্বাদ ও গন্ধ বেড়ে যায়।
পাকিস্তানি জেলে গুল হাসান দেশটির গণমাধ্যম ডনকে বলেন, 'ঠাট্টায় (করাচির পূর্বে অবস্থিত একটি জেলা) রান্না করা একটি পাল্লার স্বাদ হবে স্বাভাবিক মাছের স্বাদের মতো। কিন্তু যখন আপনি জামশোরো'র পাল্লা রান্না করবেন, তখন তার সুবাস আশেপাশের বাড়িতেও চলে যাবে।'
সিন্ধি পদ্ধতিতে পাল্লা ধরা ও রান্নার পদ্ধতি
স্রোতের বিপরীতে খুব দ্রুতগতি সোজা লাইনে সাঁতার কাটতে পারে পাল্লা। ফলে গতানুগতিক পদ্ধতিতে এ মাছ ধরা বেশ কঠিন।
১৮৮০-এর দশকে সিন্ধের জেলেরা কোমরে মাটির পাত্র বেঁধে ছোট কোচ ও হাতে জাল নিয়ে পাল্লা ধরতেন। বর্তমানে মুন, দুদি, খাস, মুনো, কাচো, পাক্কো ইত্যাদি বিশেষ ধরনের জাল ব্যবহার করে পাল্লা শিকার করেন জেলে সম্প্রদায়।
দেশভাগের আগে সিন্ধে পাল্লা রান্নার একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি ছিল গরম বালিতে ডুবিয়ে। মাছ কেটে পরিষ্কার করার পর এর পেট চিরে ফেলা হতো। এরপর খানিকটা দেশীয় মদ ঢেলে দেওয়া হতো মাছের ওপর। তারপর কলাপাতায় চাটনি মিশিয়ে সে পাতায় পাল্লাকে মুড়িয়ে গরম বালির ভেতরে গর্ত তৈরি করে পুঁতে দেওয়া হতো।
করাচির একজন শিক্ষক আদীলা তারীন বলেন, 'আমাদের ছোটবেলায় রান্না করার স্টোভও ছিল না। পাল্লার পেটে টমেটো, পেঁয়াজ, লাল মরিচ, ধনেপাতা ও আমচুরের গুড়া ইত্যাদি পুরে দেওয়া হতো। এরপর সেটা হয় কাঠকয়লার আগুনে গ্রিল করা হতো, নয়তো বালিতে ডুবিয়ে রান্না করা হতো।'
ইলিশের ডিমও সিন্ধের উপাদেয় একটি খাবার ছিল। মাছের ডিমকে পেঁয়াজ ও মরিচ সহযোগে বেসনে ডুবিয়ে পাকোড়ার ভেতরে দিয়ে ভাজা হতো।
ইলিশ: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
আজকাল আর কেউ কলাপাতায় মুড়িয়ে গরম বালিতে পাল্লা মাছ রান্না করে না। কিন্তু সিন্ধের অনেক অঞ্চলে পাল্লা এখনো জনপ্রিয় একটি খাবার। করাচি থেকে এখনো মানুষজন হায়দরাবাদ, জামশোরো ও ঠাট্টা জেলায় সিন্ধু নদের পাড়ে বিভিন্ন রোডসাইড রেস্তোরাঁয় বসে আয়েশ করে পাল্লা মাছের গ্রিল, বারবিকিউ, ভাঁজা, পোলাও, তরকারি ইত্যাদি খান।
জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও সিন্ধু নদে পাল্লার সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে। সিন্ধের বেশিরভাগ পাল্লা এখন ইরান থেকে আমদানি করা হয়। এমনকি কোনো কোনো পাকিস্তানি রেস্তোরাঁ এখন বাংলাদেশের ইলিশও আমদানি করছে। এক সময় হাজার হাজার পাল্লা সিন্ধুতে ধরা পড়লেও বর্তমানে জেলেদের জালে কয়েক ডজেন পাল্লা আটকানোও বিরল ঘটনা।
অতিরিক্ত পাল্লা ধরা, নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করা, বাঁধ নির্মাণসহ আরও অনেক কারণে পাল্লা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে সিন্ধে।
কেবল পাকিস্তানের সিন্ধ নয়, ভারতের কিছু অংশেও পরিস্থিতি একইরকম। পশ্চিমবঙ্গ ও মুম্বাইয়ে বর্তমানে ইলিশের দাম পড়ে ১৮০০ থেকে ৩০০০ রুপির মতো।
কে জানে কোনো একদিন পাল্লা হয়তো সোনার মতো দামী হয়ে যাবে। এমনকি সিন্ধিদের কাছেও পাল্লা মহার্ঘ বস্তুতে পরিণত হবে।