একজন রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষ ও তাঁর তোলা কিছু দুর্লভ আলোকচিত্রের কথা
অনেকেই জানেন যে, প্রখ্যাত ফরাসি কল্পবিজ্ঞান লেখক জ্যুল ভের্ন এর কিংবদন্তিতুল্য গ্রন্থ 'অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ' অবলম্বনে ১৯৫৬ সালে হলিউডে একই নামে একটা ছবি হয়েছিল যেটি সে বছর অস্কারে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কারও পেয়েছিল।
তবে এই ছবির বেশকিছু অংশের শ্যুটিং যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে করা হয়েছিল, প্রধানত সিলেটের শ্রীমঙ্গল ও চট্টগ্রামের বাড়বকুণ্ড এলাকায়, এই তথ্যটি সম্ভবত বহুজনেরই জানা নেই। আর তার পূর্ব পাকিস্তান অংশের শ্যুটিংয়ের প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন ছত্রিশ বছর বয়সী এক অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় তরুণ শিকারী, শৌখিন ফটোগ্রাফার ও পর্যটক জনাব জি. এম. এম. ই. করিম (১৯১৯-১৯৯৯)।
তিনি ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী ও বর্ণাঢ্য চরিত্রের মানুষ,পরবর্তীকালে যাঁর তত্ত্বাবধানেই মূলত আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (ডব্লিউডব্লিউএফ) এর উদ্যোগে পাকিস্তানের প্রথম দুটি বন্যপ্রাণী জরিপ পরিচালিত হয়েছিল ১৯৬৬ ও ১৯৬৭ সালে।
তাঁর এই অসামান্য কৃতিত্বের জন্য তাঁকে ১৯৭৩ সালে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের বাংলাদেশ অধ্যায়ের সাম্মানিক উপদেষ্টা করা হয়েছিল। তিনি একইসঙ্গে ওয়াইল্ডলাইফ অ্যান্ড নেচার কনজারভেশন সোসাইটি অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ট্যুরিজম বোর্ড, বাংলাদেশ শুটিং ফেডারেশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন এই উদ্যমী ও স্বপ্নবান মানুষটি।
লেখক হাসনাত আবদুল হাইয়ের সঙ্গে এই মানুষটির পরিচয় ছিল। তাঁর কাছ থেকে জেনেছি, জনাব করিমের পুরনো ঢাকার বাড়িতেই নাকি একসময় অনেক ধরনের পশু, পাখি ও প্রাণীর অবস্থান ছিল। বাংলাদেশের ট্যুরিজম বোর্ড প্রতিষ্ঠা এবং দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে তাঁর নিরলস পরিশ্রম ও অবদানের কথাও তিনি উল্লেখ করতে ভোলেননি।
সম্প্রতি ঢাকার অন্যতম প্রধান শিল্পতীর্থ বেঙ্গল গ্যালারিতে তাঁরই তোলা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানের নগর, গ্রাম, মানুষ, প্রাণ, প্রকৃতি ও দৈনন্দিন জীবনযাপনের দামি ও দুর্লভ কিছু ছবি নিয়ে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। বিস্ময়কর হলেও সত্য এতে শুধু কেবল স্থিরচিত্র নয়, তাঁর নিজস্ব হাতে-দম-দেওয়া ৮ মিলিমিটার মুভি ক্যামেরায় তোলা কিছু রোমহর্ষক ভিডিও ফুটেজও রয়েছে।
সেখানে আমরা ১৯৪৬-৪৭ সালে সড়কপথে তাঁর পূর্ববাঙলার প্রকৃতি দর্শন অভিযান, যাতে অন্তর্ভুক্ত ছিল সুন্দরবন, কক্সবাজার সিলেট, জয়দেবপুর এমনকি জলপাইগুড়ি ভ্রমণ; প্রায় একইসময়ে ট্রেনে চড়ে কলকাতা, নাগপুর, দিল্লি, আগ্রা, পেশোয়ার, মাদ্রাজ ভ্রমণ; ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় সমুদ্রদর্শন, ১৯৪৮-৪৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চল রামগড় ভ্রমণের বেশকিছু সচল ছবি দেখতে পাই।
প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্ত তাঁর ব্যবহৃত রোলিফ্লেক্স ক্যামেরা; পূর্বপাকিস্তানের প্রথম বন্যপ্রাণী সমীক্ষাপ্রসূত পুস্তক 'দ্য ভ্যানিশিং জাঙ্গল: টু ওয়াইল্ডলাইফ এক্সপিডিশনস টু পাকিস্তান'; আটের দশকের গোড়ার দিকে 'দ্য বাংলাদেশ অবজার্ভার' দৈনিক পত্রিকার একটি সংখ্যায় 'অ্যারাউন্ড দা ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ' চলচ্চিত্রে তাঁর ভূমিকার ওপর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন '২২ ডেজ অব ৮০'স ডেজ' (22 Days of '80 Day'স) এর কাটিং; সিনেমায় দেখতে পাওয়া সেই হাতিগুলোর যোগানদার সিলেটের প্রিতিমপাশা জমিদারির নবাবের চিঠি; ছবির ক্যামেরাম্যান জি. ডব্লিউ. কেলির দুর্দান্ত একটি প্রশংসাপত্র ইত্যাদি দুর্লভ ঐতিহাসিক দলিলসমূহের উপস্থিতিও এই প্রদর্শনীর মূল্য বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
এখানে কেলির সেই চিঠিটিতে জনাব করিম সম্পর্কে লেখা একটি বাক্যের উদ্ধৃতি দেওয়ার লোভ সামলানো গেল না। কেলি লিখছেন: 'His knowledge of the jungle gained through many tiger shooting expeditions, and his amateur but better than average 8 m.m. colour film records of his trips, give him the ability to understand a film unit's problems and requirements better than almost
anyone I have met outside the professional motion picture field and quite a few inside it.'
তবে জনাব করিম স্বভাবে ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও আত্মপ্রচারবিমুখ, তাই তাঁর এই গৌরবময় ভূমিকা ও অর্জন সম্পর্কে তাঁর সমসাময়িকেরা পর্যন্ত খুব একটা জানতে পারেননি। এই প্রসঙ্গে অবর্জাভার পত্রিকার প্রতিবেদক তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, লোকেরা তাঁর সম্পর্কে এবং বিশেষ করে এমন একটি বিশ্ববিশ্রুত চলচ্চিত্রের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততার কথা সেভাবে জানে না কেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন,'সত্যি বলতে কি আমি নিজে কাউকে এ বিষয়ে কিছু বলিনি। তাছাড়া সেইসময়ে দেশে চলচ্চিত্রবিষয়ক কোনো পত্রপত্রিকাও ছিল না।'
প্রতিবেদক আরও লেখেন যে,মধ্যবয়সী,বহুবিধ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ বন্ধুবৎসল ও স্নিগ্ধ স্বভাবের এই মানুষটি, জনাব করিম, এখনও এই 'আশিদিনে বিশ্বভ্রমণ' ছবিটির সঙ্গে তাঁর জড়িত থাকার বিষয়ে তেমন মুখ খুলতে চান না। তিনি বরং তাঁর যৌবনের দিনগুলোর শিকার-অভিযানের কথা, বাংলাদেশের বন্য প্রাণী সংরক্ষন আন্দোলনের কথা এবং দেশে পর্যটন সংস্কৃতির বিকাশের বিষয়ে কথা বলতে বেশি উৎসাহ বোধ করেন।
আমাদের পরম সৌভাগ্য, জনাব করিমের সুযোগ্য পুত্র জনাব ইফতিখারুল করিম তাঁদের পারিবারিক আর্কাইভে তাঁর গুণী পিতার তোলা যাবতীয় ছবি, সচলচিত্র,বই, চিঠিপত্র, আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি, ব্যবহার্য বস্তু ইত্যাদি খুব যত্ন করে সংরক্ষণ করেছিলেন এবং একপর্যায়ে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এইসব অমূল্য রত্নের পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করেই প্রাজ্ঞ কিউরেটর জনাব সামসুল আলম হেলাল 'Random harvests' শিরোনামের এই অমূল্য প্রদর্শনীটির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছেন।
এখানে উল্লেখ্য, জনাব করিম তাঁর জীবদ্দশাতে এই নামে নিজেই একটি সুবিন্যস্ত অ্যালবাম, আলোকচিত্রসমূহের ক্যাপশনসহ, তৈরি করে রেখেছিলেন, যার একটি কপিও প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
আনন্দের বিষয়, প্রদর্শনী উপলক্ষ্যে একই নামের একটি মূল্যবান, সংগ্রহযোগ্য গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ে আগ্রহীজনদের তৃষ্ণা ও কৌতূহল মেটাতে সহায়ক হবে।
৯ই সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই প্রদর্শনীটি চলবে ১৫ই অক্টোবর পর্যন্ত। যাঁরা এটি এখনও দেখে উঠতে পারেননি তাঁদের প্রতি আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, আর কালক্ষেপণ না করে আমাদের জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সমাজজীবনের এই দুর্লভ ও মহামূল্যবান সচিত্র উপস্থাপনাটুকু দেখে আসুন দ্রুত। সবশেষে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনকে এই কষ্টসাধ্য অনন্য আয়োজনের জন্য জানাই প্রাণঢালা অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা।