নোবেল শান্তি পুরস্কারের অবমূল্যায়ন
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ক্রমাগত এর জৌলুস হারাচ্ছে। এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার যৌথভাবে পেয়েছে বেলারুশের মানবাধিকার কর্মী আলেস বিয়ালিয়াৎস্কি এবং ইউক্রেন-রাশিয়ার দুটি মানবাধিকার সংগঠন। পুরস্কার প্রদানের প্রক্রিয়াটিতে যে রাজনৈতিক কারণও কিছুটা জড়িত, তা এখন অনেকেই স্বীকার করবেন। বিয়ালিয়াৎস্কির সঙ্গে শান্তিতে নোবেল পেয়েছে রাশিয়ার মানবাধিকার সংস্থা মেমোরিয়াল এবং ইউক্রেনীয় মানবাধিকার সংস্থা সেন্টার ফর সিভিল লিবার্টিজ।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ, এবং জেলেনস্কির সরকারকে রণসজ্জায় সাজিয়ে রাশিয়ার বাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্য পশ্চিমাশক্তি তথা ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বেশকিছু সরকারের বিশেষ ঔৎসুক্য—এসব বিবেচনায় এটা এখন স্পষ্ট যে পশ্চিমা রাজনীতিবিদদের ঠিক করে দেওয়া প্যাটার্ন অনুযায়ীই দেওয়া হয়েছে নোবেল শান্তি পুরস্কার।
এছাড়া আছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতাও। আমাদের জীবদ্দশাতেই অনেকগুলো বিতর্কিত লরিয়েট নির্বাচন করা নোবেল কমিটিকে আরও ভালো কাজ করে দেখাতে হবে। বিশেষত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মানুষ ও সংস্থার কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে এ কমিটিকে।
জাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হাকাইন্ডে হিশিলেমা'র মতো ব্যক্তি, যিনি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে তার দেশে একটি নতুন যাত্রার সূচনা করেছেন, তিনিও হতে পারতেন শান্তিতে নোবেলের একজন অবিসংবাদিত দাবিদার। পাকিস্তানের কয়েক লাখ দারিদ্র্যপীড়িত মানুষকে কয়েক দশক ধরে সহায়তা দিয়ে যাওয়া ইদি ফাউন্ডেশন হতে পারত আরেকটি প্রার্থী।
মিশরের মতো বিভিন্ন দেশে মত প্রকাশের জন্য কারাভোগ করা সাংবাদিকদেরকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য। সৌদি আরবে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নিরন্তর দুর্ভোগ লাভ করা সৌদি নারীদেরও উপেক্ষা করা হয়েছে। কারণ এসব দেশের সরকারগুলো পশ্চিমাদের মিত্র বলে? এরপর আছে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ঘটনাটি। তাকে কেন উপেক্ষা করা হবে?
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়াদের তালিকা এ পুরস্কারের জন্য নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি নিয়ে বেশকিছু প্রশ্ন তৈরি করে। ১৯৭৩ সালে হেনরি কিসিঞ্জার ও লি ডাক থোকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয় ভিয়েতনামে শান্তি প্রতিষ্ঠার ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ তখনো চলছিল। লি ডাক থো নৈতিক দিক বিবেচনায় পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। অন্যদিকে সানন্দে পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন কিসিঞ্জার। এ পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল দৃষ্টিকটু কারণ কম্বোডিয়ায় বোমাবর্ষণে কিসিঞ্জারের ভূমিকা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার আক্রমণাত্মক মনোভাব, চিলির সালভাদর আলেন্দের সমাজতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাতে তার সক্রিয় সমর্থন; সবকিছুকেই পরিষ্কারভাবে অগ্রাহ্য করেছিল নোবেল কমিটি।
মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টার জন্য মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে পুরস্কার দিয়ে সঠিক কাজটি করেছে নোবেল কমিটি। সাদাত রাষ্ট্রনায়কোচিতভাবে শান্তির আমন্ত্রণ নিয়ে জেরুজালেমে গিয়ে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
কিন্তু মেনাখেম বেগিনের সাথে তার পুরস্কার ভাগ করে নেওয়ায় পুরস্কারের গুরুত্ব কমে যায়। তাকেই এককভাবে পুরস্কারটি দেওয়া উচিৎ ছিল। সবাইকে খুশি রেখে পুরস্কার দেওয়া উচিৎ নয়।
বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে না হতেই তাকে নোবেল দেওয়া হয়, সারা বিশ্বের মানুষ তখন হতবাক হয়ে গিয়েছিল, এমনকি ওবামা নিজেও এ খবরে অবাক হন।
কিসের ভিত্তিতে নোবেল কমিটি ওবামাকে পুরস্কার দিল তার ব্যাখ্যা কখনোই পাওয়া যায়নি। হোয়াইট হাউজে অশ্বেতাঙ্গ নেতার আগমন নিয়ে উদ্ভূত আবেগ কাজ করে থাকতে পারে এর পেছনে।
মাও সেতুং এবং ঝো এন-লাই-এর মতো ব্যক্তিদের কখনোই শান্তি পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করেনি নোবেল কমিটি।
সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন নিশ্চিত হওয়ার পরই মিখাইল গর্বাচেভকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। কমিউনিজমের পতন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার জন্য এটি ছিল তার পুরস্কার। মাও আর ঝোয়ের আমলে চীনে ভাঙন ধরলে তারাও কি পুরস্কারের জন্য যোগ্য বিবেচিত হতেন?
অহিংসা প্রচারের জন্য খ্যাতমান মহাত্মা গান্ধীকেও শান্তির জন্য নোবেল দেওয়া হয়নি। কিন্তু লেক ওয়ালেসার মতো কেউ, পশ্চিমা সমর্থনে পোল্যান্ডে কমিউনিজমকে উচ্ছেদ করায় সহজেই পুরস্কার পেয়েছিলেন। আয়াতুল্লাহর পক্ষের বিরোধিতার কারণে ইরানের শিরিন এবাদি এই পুরস্কার পান।
চীনে ভিন্নমতাবলম্বী হিসেবে লিউ জিয়াওবোর খ্যাতি উল্লেখযোগ্য, কিন্তু তাও কি তিনি পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হয়েছেন?
জোটনিরপেক্ষ তত্ত্ব তৈরি করা নেহেরু, সুকর্ণ, নাসের এবং টিটোর মতো রাষ্ট্রনায়কদের বিবেচনায় রাখেনি নোবেল কমিটি, এনিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
মালালা ইউসুফজাইয়ের ওপর হত্যাচেষ্টার হামলায় ঘটনা সারা বিশ্বকে হতবাক করেছে। তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, তালেবানরা তার সাথে যা করেছিল তা তার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য উপযুক্ত কারণ ছিল কিনা। অং সান সু চি এবং আবি আহমেদকে পুরস্কার দেওয়া যথাযথই বলা যায়,মায়ানমারে গণতন্ত্রের পক্ষে ভূমিকার জন্য এবং ইথিওপিয়াতে গণতান্ত্রিক উত্থান নিশ্চিত করতে প্রচেষ্টার জন্য পুরস্কার পান তারা।
যদিও নোবেল পাওয়ার পর সু চি ও আবি আহমেদ এমন সব কর্মকাণ্ড করেন যা তাদের সুনামকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করে। রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের বিষয়ে সু চি মৌন ছিলেন, আর তার বিমানবাহিনীকে দিয়ে টাইগ্রের বেসামরিক মানুষের ওপর বোমাবর্ষণ করান। কোনো ব্যক্তিকে দেওয়া পুরস্কার প্রত্যাহার করার ব্যবস্থা নোবেল কমিটির নেই।
ফিদেল ক্যাস্ট্রো যে কিউবায় শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন, দুর্নীতিবাজ বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করার পর দেশবাসীকে নতুন আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছেন—তার এসব অর্জনকে কখনও বিবেচনায় নেয়নি নোবেল কমিটি।
১৯৭৪ সালে ত্রিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তির অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের নেতাদেরও বিবেচনায় নেয়ার সময় হয়নি নোবেল কমিটির। ১৯৯০ সালে অটলবিহারি বাজপেয়ী পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তির জন্য যে বাস কূটনীতি অবলম্বন করেছিলেন, সেটি থেকেও চোখ সরিয়ে নিয়েছে কমিটি।
বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত পুরস্কার যখন রাজনৈতিক বিবেচনায় বিতরণ করতে দেখা যায়, তখন তা বেশ কিছু যুক্তিসংগত প্রশ্নের জন্ম দেয়। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এ ধরনের পুরস্কারের সঙ্গে যে সম্মান জড়িয়ে থাকে, তা অনেকটাই নেমে যায়। সম্মান এতটাই কমে যায় যে, পুরস্কারগুলোকে আর গুরুত্ব দেয়া হয় না। নোবেল শান্তি পুরস্কারের সঙ্গে এমন অনুভূতি জড়িয়ে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
চিলি, পেরু, বলিভিয়া ও কলম্বিয়ার বামপন্থি সরকারগুলো সম্প্রতি দরিদ্রদের উন্নতি ও কল্যাণমুখী সমাজ গঠনের লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এসব উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়ার একটু সময় কি নোবেল কমিটির হবে?