মোহাম্মদ শামছুদ্দোহা যেভাবে ‘বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন’ খুঁজে পেলেন
পিএইচডি শেষ করলেন ২০১১ সালে মোহাম্মদ শামছুদ্দোহা, শামস বলেই যাকে পরিবারের লোকেরা ডাকে। গবেষণাপত্রের একটি নির্বাচিত অংশ প্রকাশিত হলো পানিবিশেষজ্ঞদের আন্তর্জাতিক সংঘের বিখ্যাত সাময়িকী হাইড্রোজিওলজি জার্নালে। এতে বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন কথাটি ছিল না, তবে ভাবনাটি বিস্তারিত বলা হয়েছিল। কারণ তখনো শামসের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত (অন্তত তিন দশকের) ছিল না যা দিয়ে মেশিনটি কোথায় কতটা কাজ করে নিশ্চিত করে বলা যেত।
শামস পড়েছেন ভূতত্ত্বে। তবে ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে তাঁর আগ্রহ তৈরি হয়নি স্নাতকোত্তর শেষ করার আগে। সুযোগটা আসে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে আমেরিকার কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একদল বিজ্ঞানী আর্সেনিক নিয়ে গবেষণা করতে এলে। তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদের কাছে—যিনি শামসের শিক্ষকও—গবেষণা সহকারী হিসাবে একজন ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েটের সন্ধান চেয়েছিলেন।
তখন শামস এক মাস দলটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন আর শেখেন কীভাবে ওয়াটার স্যাম্পল (নমুনা) নিতে হয়, বোরহোলে পানির স্তর মাপার পদ্ধতিসহ আরো অনেক কিছু।
কলাম্বিয়ার দলটি ফেরত গেলে এবং ভূগর্ভস্থ পানি গবেষণায় শামসের আগ্রহ ও আন্তরিকতা টের পেয়ে মতিন স্যার ফিল্ড হাইড্রো জিওলজিস্ট হিসাবে তাঁকে নিজের দলে অন্তর্ভুক্ত করেন। সেটা ২০০১ সাল হবে।
তারপর থেকে দুই দশকেরও বেশি সময় হতে চলল শামস কখনো লন্ডনে, কখনো আফ্রিকায়—এবং দেশে তো বটেই—কাজ করছেন ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে।
২০০৭ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে তিনি বৃত্তিসহ (ডরোথি হজকিন পোস্টগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ড) পিএইচডি করার সুযোগ পেলেন। বিষয় নির্ধারণ করেছিলেন 'গ্রাউন্ড ওয়াটার ডাইনামিকস অ্যান্ড আর্সেনিক মবিলাইজেশন ইন বাংলাদেশ'। এটা করতে গিয়েই তিনি ও তাঁর তত্ত্বাবধায়ক রিচার্ড টেইলর অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, দশ বা বিশ বছর ধরে চাষের জন্য পাম্প দিয়ে ভূতলের নিচ থেকে পানি তোলা হলে তা যতটা নিচে নেমে যাওয়ার কথা সব জায়গায় তার হার সমান নয়।
তারা পানি রিচার্জ (পুনঃপূরণ) হওয়ার ব্যাপারটি নিয়ে ভাবলেন। এমনিতে প্রাকৃতিকভাবেই বর্ষা মৌসুমে রিচার্জ হওয়ার ঘটনা ঘটে—কিন্তু তাঁরা দেখলেন রিচার্জের পরিমাণটা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি। তখনই বুঝতে চাইলেন এই বাড়তি রিচার্জ হচ্ছে কীভাবে?
তাঁদের হাতে দেশের উত্তর, পূর্ব, পশ্চিম বা মধ্যাঞ্চলের বিভিন্ন বছরের যত উপাত্ত (ডাটা) ছিল, তা আরো জানাচ্ছে, সব জায়গায় রিচার্জ সমানভাবেও হয় না। রিচার্জ হয় সাধারণত বর্ষাকালে; আর পানির স্তর তলানিতে গিয়ে ঠেকে শুকনো মৌসুমের শেষ, মানে মার্চ-এপ্রিল মাসে।
তাঁরা বুঝলেন, ঘটনাটি চক্রাকারে ঘটে, চলে আর এর প্রভাবক হিসাবে কাজ করে বোরো মৌসুম (শীতকাল)। কারণ তখন পাম্প করে কৃষক ভূগর্ভ থেকে পানি তোলে। পাম্প করে পানি তোলার কারণে মাটিতে অতিরিক্ত ফাঁকফোকর তৈরি হয়। আর সে ফাঁক গলেই বর্ষাকালে ঢুকে পড়ে অতিরিক্ত পানি। এটাকেই বলা হচ্ছে বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন।
উল্লেখ্য, রিচার্জিংয়ের ঘটনা উত্তরাঞ্চলে যতটা ঘটে, পূর্ব-দক্ষিণাঞ্চলে ততটা ঘটে না। এটুকু বুঝতে সময় লাগল তিন বছরেরও বেশি। আর এর মধ্য দিয়ে শেষ হলো শামসের পিএইচডি। তবে শামস ও রিচার্ড দুজনেই একমত হলেন, এ নিয়ে অধিকতর গবেষণার প্রয়োজন আছে; আর তা ভবিষ্যতের জন্য তোলা রইল।
কিশোরগঞ্জে বড় হওয়া
পাঁচ ভাইবোন তাঁরা। শামসের বড় দুই বোন আর ছোট দুই বোন। বাবা কাজ করতেন কিশোরগঞ্জের যক্ষ্মা হাসপাতালে। বড় সংসার, বাবার একলার উপার্জন, সব প্রয়োজন মিটত না। শামস আর তাঁর বোনেরাও চাহিদা কমিয়ে এনেছিলেন, নইলে যে বাবার ওপর চাপ বাড়ে।
শামসের জন্ম ১৯৭৬ সালে। কিশোরগঞ্জ বয়েজ হাই স্কুলে পড়ত শামস। এসএসসিতে পুরো জেলায় সবচেয়ে ভালো ফল করার স্বীকৃতিস্বরুপ পেয়েছিল রায়সাহেব স্মৃতি পদক নামের একটি গোল্ড মেডেল।
তারপর গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে ভালো ফল করেই এইচএসসি পাশ করেছেন ১৯৯৩ সালে। ঢাকায় এসে বিবিএ কোচিং করতে শুরু করেন, কারণ সবাই বলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে পড়লে ভালো চাকরি মেলে।
টানাটানির সংসারে একটু স্বাচ্ছন্দ্য আনতেই শামস বিবিএ পড়তে চেয়েছিলেন। ভর্তি পরীক্ষার আগে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তাই পরীক্ষা ভালো হয়নি, আর ভর্তিও হতে পারেননি শামস। এর মধ্যে বিজ্ঞান অনুষদের ভর্তি পরীক্ষারও সময় এগিয়ে আসে। মৃত্তিকা বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে ভূতত্ত্বও দিয়েছিলেন পছন্দের তালিকায়। যদিও ভূতত্ত্ব বিষয়ে জানা ছিল না কিছুই।
একদিন ভূতত্ত্বের এক সিনিয়র ভাই বললেন, বছরে আমরা দু-তিনবার ফিল্ডে যাই। তখন শামস ভাবলেন, বেশ মজা হয় তবে। তাই চান্স পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিতে বেশি সময় লাগেনি শামসের।
প্রথম বছরে তাঁরা সিলেটের সীমান্ত এলাকা জাফলং, তামাবিলে ফিল্ড স্টাডিতে গিয়েছিলেন, কারণ সেখানে শিলাস্তর দৃশ্যমান। পরে সীতাকুণ্ড পাহাড়েও গিয়েছেন। তবে ফার্স্ট ইয়ারের ফলাফল তাঁর বেশি ভালো হয়নি, কারণ হলে সিট পাননি, মেসে থাকতে হয়েছিল ইত্যাদি।
যাহোক পরের দুই বছর জোর খাটুনি দিয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে স্নাতক পর্ব উত্তীর্ণ হলেন শামস। আর এই সময়ের মধ্যে ভূতত্ত্ব বিষয়টি তাঁর ভালোও লেগে গিয়েছিল খুব। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে থিসিস হিসাবে নিয়েছিলেন গড়াই অববাহিকার স্যাটেলাইট ইমেজ স্টাডি।
এই প্রথম ভূতত্ত্ববিদ্যার ছাত্র শামসের পানির সঙ্গে সম্পৃক্তি তৈরি হলো। তবে ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্গে যুক্ত হতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল, ওই কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী দলটির আড়াইহাজারে আসা পর্যন্ত।
বিদেশ থেকে ডাক এল
অসএইডের বৃত্তি নিয়ে দ্বিতীয় মাস্টার্স করতে ২০০৩ সালে গেলেন অস্ট্রেলিয়ায়। নিউ সাউথ ওয়েলসের ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনিতে (ইউটিএস) পড়া শুরু করলেন। বিষয় নির্বাচন করলেন, হাইড্রোজিওলজি অ্যান্ড গ্রাউন্ডওয়াটার ম্যানেজমেন্ট।
তারপর ২০০৪ সালে দেশে ফিরে এসে এসএনইসি নামের একটি কনসাল্টিং ফার্মের হয়ে দিনাজপুরের ফুলবাড়ি গেলেন শামস। কয়লাখনিতে হাইড্রো জিওলজিস্ট হিসাবে কাজ করলেন এক বছরের বেশি সময়।
তারপর ডাক এলো আমেরিকার অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেখানে একজন বাংলাদেশি অধ্যাপক ছিলেন। আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন এই বলে যে, এখানে (অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়) আমরা পিএইচডি কোর্স চালু করতে যাচ্ছি, আপনি মাস্টার্স থেকে পিএইচডি প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবেন।
খুশি হয়েছিলেন শামস। নতুন করে আর মাস্টার্স করতে চাইছিলেন না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অবার্নে পিএইচডি চালু হলো না। ২০০৫-এ গিয়ে তৃতীয়বারের মতো মাস্টার্স শেষ করতে হলো। তবে এবার আর পানি নয়, আবার ভূবিজ্ঞান।
২০০৭ অবধি আমেরিকায় থাকার সময় তিনি পিএইচডি করার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে থাকেন। শেষে ইউসিএল থেকে ডাক পেলেন পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে পিএইচডি করার জন্য, যা ২০১১ সালে শেষ হয়।
গবেষণায় অনেক সময়
পিএইচডি শেষ হওয়ার পর শামস ইউসিএলের ইনস্টিটিউট ফর রিস্ক অ্যান্ড ডিজাস্টার রিডাকশনে (আইআরডিআর) রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসাবে যোগ দিলেন। বিষয় ছিল, বাংলাদেশে আর্সেনিকমুক্ত ও টেকসই ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহের উপায় অনুসন্ধান। ইউসিএলের ধরিত্রী বিজ্ঞানের অধ্যাপক উইলিয়াম বার্জেস ছিলেন গবেষণা প্রধান।
এরপর তিনি ইউসিএলের ভূগোল বিভাগে টিচিং ফেলো হিসাবে স্নাতকোত্তর পর্বের শিক্ষার্থীদের জলবায়ু পরিবর্তনের মডিউল শিক্ষা দিয়েছেন। পরে আবার আইআরডিআর বিভাগে জলবাহিত দুর্যোগে স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে গবেষণা সহযোগী হন।
প্রায় সাড়ে সাত বছর শামস গবেষণা কাজে যুক্ত ছিলেন। এ সময়ে একটি প্রকল্পের কাজে আফ্রিকাতেও যান। এরপর ভাবলেন, কাজের টাইপ বদলাবেন। শিক্ষক হতে চেয়ে ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের ভূগোল বিভাগে আবেদন করেন তিনি। প্রভাষক হিসাবে নিয়োগও পান।
গাঠনিক ভূগোলবিদ্যায় তিনি পানি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে পড়াতে থাকেন। দুই বছর সেখানে পড়িয়ে ইউসিএলে চলে আসেন ২০২১ সালে। তিনি ইউসিএলের ইনস্টিটিউট ফর রিস্ক অ্যান্ড ডিজাস্টার রিকাডশনে সহযোগী অধ্যাপক।
লন্ডনে তখন বিকাল হবে
আগে থেকেই ড. শামসের সঙ্গে কথা বলার সময় ঠিক হয়েছিল। হোয়াটসঅ্যাপে ফোন দিতেই ধরতে বেশি দেরি করলেন না, তবে বললেন, একটু ফোনটা ধরে থাকুন আমি কনফারেন্স রুমে যাচ্ছি। ইউসিএল সেন্ট্রাল লন্ডনে হওয়ায় সবকিছুরই খরচ বেশি। শামস তাঁর অন্য তিনজন সহকর্মীর সঙ্গে একটি অফিস ঘর শেয়ার করেন। তাই নিরিবিলি কথা বলার জন্যই কনফারেন্স রুমের দরকার পড়ল।
তাঁর কাছে প্রথম জানতে চেয়েছিলাম: প্রায় দশ বছর ধরে বেঙ্গল ওয়াটার মেশিনের গবেষণাটি চলে শেষে গেল ১৬ সেপ্টেম্বর আমেরিকার সায়েন্স ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হলো। এই দীর্ঘ সময়ের বিভিন্ন ধাপ সংক্ষেপে বলুন।
ড. শামছুদ্দোহা: শুরুর দিকে আমাদের কাছে ২০০৭ পর্যন্ত ডাটা ছিল। পুরো দেশ আমাদের স্টাডির আওতায় আসতে বাকি তখনো। আমাদের জানা দরকার ছিল কৃষকরা কী পরিমাণ পানি রিচার্জ করে মানে পাম্পিংয়ের ফলে এক্সট্রা রিচার্জ হয়। ২০১৪ সালে বুয়েট থেকে সারা নওরীন পিএইচডি করতে ইউসিএলে আসেন। তিনি রিচার্ড এবং আমার সঙ্গে বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এবং রিচার্জ প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করতে থাকেন।
তারপর ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইজাজুল হক ইউসিএলে এলে আমাদের কাজে গতিবৃদ্ধি হয়। তিনি বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) থেকে হালনাগাদ উপাত্ত সংগ্রহ করেন। ফলে দীর্ঘ সময়ের (টাইম সিরিজ) ডাটা আমাদের হাতে চলে আসে।
ইতিমধ্যে পাউবোর ড. আনোয়ার জাহিদও আমাদের দলে যোগ দেন। আমি আমার পুরনো শিক্ষক অধ্যাপক কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদকেও দলে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানালাম। তিনি বহু বছর আগে ইউসিএলে তাঁর পিএইচডি করার সময় বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।
এরপর ২০২০ সালের মার্চ মাসে লন্ডন কোভিডে বন্দি হয়। এ সময়টা আমাদের জন্য শাপে বর হয়ে দাঁড়াল। ঘরবন্দি আমি 'আর' নামের একটা প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজে ডাটা ইনপুট দিতে থাকলাম। আর দলবদ্ধভাবে বিশ্লেষণও চালিয়ে গেলাম।
সব বিশ্লেষণ সম্পন্ন হলে গবেষণাপত্রটি আমাদের সন্তুষ্টির স্তরে পৌঁছাল। আমরা ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এটি সায়েন্স ম্যাগাজিনে (জার্নাল) জমা দিলাম। কোনো গবেষণাপত্র জমা পড়লে ম্যাগাজিন কর্তৃপক্ষ তা নিরীক্ষার (রিভিউ) জন্য বিশেষজ্ঞদলের কাছে পাঠায়। এতে ছয় মাসও লেগে যায়। সব যাচাই-বাছাই শেষে ম্যাগাজিন কর্তৃপক্ষ আমাদের গবেষণাপত্রটি গ্রহণ (অ্যাকসেপ্ট) করে জুলাই মাসে। আর তা অনলাইনে প্রকাশ করে ১৫ সেপ্টেম্বরে এবং ছাপা হয়ে বের হয় ১৬ সেপ্টেম্বর।
লেখক: ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়া বিষয়ক আশঙ্কা ও বিপদের কথা প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় দেখা যায়। আপনাদের গবেষণা ফলাফল কি ওই কথার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়?
ড. শামছুদ্দোহা: জি না, বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন ভূগর্ভস্থ পানির সঞ্চয় হ্রাসের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে না। সাধারণভাবে এটাই সত্য যে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। তবে মনোযোগের সঙ্গে যদি খেয়াল করেন, তবে দেখবেন শুধু শুকনো মৌসুমে পানির স্তর নেমে গেছে কিন্তু বর্ষায় এ প্রবণতা দেখা যায় না। এতে বোঝা যাচ্ছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পানির রিচার্জ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে অবশ্যই দেশের সর্বত্র এ ঘটনা ঘটে না। আমরা ৪৬৫টি বোরহোল রেকর্ড অধ্যয়ন করেছি তার মধ্যে ১৫৩টিতে (৩৫ শতাংশ) দেখেছি রিচার্জ বৃদ্ধি পেয়েছে মানে বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন কাজ করেছে। বাকিগুলোতে সঞ্চয়ের হ্রাস-বৃদ্ধির মাত্রা বিভিন্ন, এমনকি কোনো কোনো বোরহোল রেকর্ড দেখে আতঙ্কিত হলাম, কারণ ওই সব জায়গায় পানির সঞ্চয় বলতে গেলে শূন্যের কোঠায়।
লেখক: বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন কাজ করেছে আর কোথায় পানির স্তর হ্রাস পাচ্ছে?
ড. শামছুদ্দোহা: ওয়াটার মেশিন ভালো কাজ করেছে উত্তরবঙ্গ, মানে দিনাজপুর, রংপুরে। রাজশাহীতেও ভালো। মধ্যাঞ্চল, মানে বৃহত্তর ময়মনসিংহেও ভালো কাজ করেছে। কারণ এসব অঞ্চলের মাটি বেলেমাটি ধরনের যার পানিশোষণ ক্ষমতা অধিক। বোরো চাষও হয় প্রচুর পরিমাণে।
মধ্যাঞ্চলে হওয়া সত্ত্বেও ঢাকায় কিন্তু ওয়াটার মেশিন কাজ করছে না, কারণ মধুপুর গড় এলাকার মাটি আঠালো। সিলেট, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ভোলা বা বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলেও ওয়াটার মেশিন কাজ করছে না। কারণ এসব অঞ্চলের মাটি কর্দমাক্ত আর বোরো চাষও অনেক জায়গায় হয় না।
লেখক: তাহলে বেঙ্গল ওয়াটার মেশিনের কৃতিত্ব কৃষককেই দেয়া যায়?
ড. শামছুদ্দোহা: আসলে তারা তো পাম্প ব্যবহার করে প্রয়োজনে। ভূগর্ভস্থ পানির সঞ্চয় তারা জেনেশুনে করছে ব্যাপারটি তেমন নয়, তবে পাম্প করেছে বলেই ফাঁকফোকর অধিক তৈরি হয়েছে আর এক্সট্রা রিচার্জও হয়েছে। তাই কৃতিত্ব তাদেরকে দেয়াই যায়, আর সরকারকেও কিছু কৃতিত্ব দিতে হয়।
নব্বইয়ের আগপর্যন্ত ডিপ টিউবওয়েল ব্যবহার করেই কেবল সেচ দেওয়ার কাজ করা যেত। নব্বইয়ের পর পাম্প মেশিন ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়, আর তা ডিজেল দিয়ে চালানোর অনুমতিও দেওয়া হয়। ফলে পাম্প মেশিনের ব্যবহার বেড়ে যায় বহুগুণে।
লেখক: আপনাদের গবেষণার সুফল কী পাব আমরা?
ড. শামছুদ্দোহা: পলিসি তৈরিতে সুবিধা হবে। এখন জায়গা চিহ্নিত করা সহজ হবে, মানে যেখানে ওয়াটার মেশিন কাজ করে, সেখানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে না। আর যেখানে করে না, সেখানে ভূগর্ভস্থ পানির সঞ্চয় বৃদ্ধির জন্য অথবা পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ঠেকাতে প্রয়োজনীয় প্রকল্প হাতে নিতে হবে।
লেখক: সেল্ফ-সাসটেইনিং এ চক্র কি আগামী সকল সময় ধরে বহাল থাকবে?
ড. শামছুদ্দোহা: অনেকগুলো ফ্যাক্টর (উপাদান) এ চক্রের নিয়ামক হিসাবে কাজ করছে। যেসব জায়গায় দুই-তিন দশক ধরে বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন কাজ করছে সেসব জায়গায় জলবায়ু, ভূজলতত্ত্ব এবং সেচ প্রকল্প একইসঙ্গে একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে।
কিন্তু আমরা লক্ষ করেছি এমনও জায়গা আছে, যেখানে ওয়াটার মেশিন কয়েক বছর কাজ করেছে তারপর বর্ষা এবং শুকনো উভয় মৌসুমেই জলের স্তর নেমে গেছে। এটা কয়েকটা ব্যাপারে ইঙ্গিত করছে—যেমন উপরিভাগে পর্যাপ্ত পানি জমতে পারেনি, বর্ষা পেরিয়ে যাওয়ার পরও ফাঁকফোকর দিয়ে পর্যাপ্ত পানি প্রবেশ করতে পারেনি, কৃষি অঞ্চলে নতুন কোনো পরিস্থিতি অথবা জলবায়ু পরিস্থিতির পরিবর্তন।
তাই কিছু জায়গা নির্দিষ্ট করে কিছু গবেষণা প্রকল্প হাতে নেওয়া দরকার। তাহলে অঞ্চলভিত্তিক কারণগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব হবে আর এ চক্রও আগামী অনেক সময় ধরে বহাল রাখার উপায় বের করা যাবে।
লেখক: এ ব্যাপারে আরো গবেষণার কি অবকাশ আছে?
ড. শামছুদ্দোহা: এখন পর্যন্ত আমরা জানতে পেরেছি কোথায় কোথায় ওয়াটার মেশিন কাজ করছে। আমরা গত ৩০ বছর জুড়ে এক্সট্রা কত পরিমাণ পানি রিচার্জ হয়েছে, তা-ও জানতে পেরেছি। আরো জানা গেছে, স্থানভেদে এর কার্যকরিতার মাত্রা আলাদা।
এসব ফলাফল জলবায়ু পরিবর্তন ও জমির ব্যবহার বৈচিত্র্যের প্রেক্ষিতে ভূগর্ভস্থ পানির সঞ্চয় সম্পর্কে আরো নতুন নতুন প্রশ্ন সামনে এনেছে। আগামীতে আমাদের জানতে হবে, কোন কোন বিষয় ওয়াটার মেশিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে এবং কোনগুলো সীমিত করে। বৃষ্টিপাতের ধরন ও পরিমাণ নিয়েও গবেষণা হওয়া দরকার আর ভূগর্ভস্থ পানির গুণমানও জানা দরকার।
লেখক: লন্ডনে আপনার ছাত্র-ছাত্রীরা কেমন? দেশে ফিরবেন না?
ড. শামসুদ্দোহা: ইউসিএল পৃথিবীর দশটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি। এখানে সবকিছুই গ্লোবাল। এখানকার হিউম্যানিটেরিয়ান প্রোগ্রামে ২৫টি দেশের ছাত্র-ছাত্রী যুক্ত রয়েছে যার নেতৃত্ব দিই আমি। আর বাংলাদেশ নিয়েই তো কাজ করি যেখানেই থাকি না কেন। দেশে প্রায়ই যাই। এখানে আমি ভবিষৎ বিজ্ঞানী গড়ে তোলার ব্রত নিয়েছি। বাংলাদেশ থেকে যারা এখানে পড়তে আসে তাদের আমি প্রোগ্রামিংও শেখাই। এটা তো মানবেন, ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানী গড়ে তোলার সুযোগ ইউসিএলেই বেশি।
শেষ করতে হয় এবার
ইংলিশ চ্যানেলের ধারের ব্রাইটনে পরিবার নিয়ে থাকেন শামস। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করেন ট্রেনে। তাঁর একমাত্র ছেলের বয়স ৮ হবে শীঘ্র, স্ত্রী একটি ই-কমার্স বিজনেস পরিচালনা করেন। বাবা মারা গেছেন ২০১০ সালে। মা এখন ঢাকায় ছোটবোনের (এবি ব্যাংকে কর্মরত) সঙ্গে থাকেন। আরো দুই বোন ঢাকায়ই থাকেন। কেবল বড় বোন কিশোরগঞ্জ থাকেন, সেখানে তিনি সরকারি হাসপাতালের গ্রন্থাগারিক।