চুরি হয়, তদন্ত হয় না, আসামিও ধরা পড়ে না!
গত বছরের ২৯ অক্টোবর অধ্যাপক জাহানারা বেগমের বনানীর বাসা থেকে ছয়-সাত ভরি সোনা চুরি হয়। এ ঘটনায় ৭ ফেব্রুয়ারি বনানী থানায় একটি মামলা হয়। এর সপ্তাহখানের মধ্যেই গুলশানের শাহজাদপুর এলাকার একটি গয়নার দোকান থেকে সেসব স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় চোর চক্রের দুই সদস্যকে।
ওই সময় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) জানায়, অধ্যাপক জাহানারা বেগম ডিএমপি কমিশনার মো. শফিকুল ইসলামের শিক্ষক ছিলেন। চুরির পর তিনি কমিশনারকে বিষয়টি জানান। পরে কমিশনারের নির্দেশে গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা চোর চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করেন। পরে ১৬ ফেব্রুয়ারি ডিএমপি কমিশনার তার শিক্ষককে ডিএমপি সদর দপ্তরে ডেকে ঘটা করে উদ্ধার হওয়া স্বর্ণ বুঝিয়ে দেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সেসময় জানান, চুরির শিকার হওয়া ব্যক্তি ডিএমপি কমিশনারের শিক্ষিকা হওয়ায় তারা গুরুত্বের সাথে অভিযান পরিচালনা করে চোর চক্রকে ধরতে সমর্থ হন, এ কারণেই মাত্র এক সপ্তাহেই তারা ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে সমর্থ হন।
এদিকে এ বছরের ২২ আগস্ট রাজধানীর ইস্কাটন এলাকায় পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোজাম্মেল আহমেদের বাসার চারতলার গ্রিল কেটে চুরির ঘটনা ঘটে। জানালার গ্রিল কেটে চোরেরা ভেতরে প্রবেশ করে প্রায় ৪০ লাখ ৬৫ হাজার টাকার (৪৪.৯৫ ভরি) স্বর্ণের গহনা নিয়ে যায়। এমন ঘটনার প্রায় ১ মাস পেরিয়ে গেলেও চুরির সাথে জড়িতদের শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।
এ বিষয়ে রমনা থানার ওসি মো. আবুল হাসান টিবিএসকে বলেন, "সাবেক অতিরিক্ত আইজিপির বাসায় চুরির ঘটনার পর থেকেই আমরা কাজ করছি। এখনো কাউকে শনাক্ত করতে পারিনি। আমাদের সাথে ডিবি রমনা বিভাগও কাজ করছে। আশা করি খুব শিগগিরই জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে পারবো।"
তবে এই ঘটনায় ভুক্তভোগী পুলিশের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হওয়ায় বেশ তোড়জোড় চলছে। নিয়মিত বিরতিতে গোয়েন্দা পুলিশ ও রমনা থানা পুলিশের সদস্যরা বাড়িটিতে আসছেন, তদন্তের অগ্রগতি জানাচ্ছেন। একই সাথে, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন যুগ্ম কমিশনারও বাড়িটিতে গিয়েছেন, সিআইডি ক্রাইম সিনের সদস্যরাও আলামত নিয়ে গেছেন, যেটা সচরাচর অনান্য চুরির ঘটনায় খুব একটা দেখা যায় না বলে অভিযোগ করেছেন প্রতিবেশিরা।
বিপরীতে রাজধানীর সাধারণ নাগরিকদের বাসায় চুরির ঘটনা ঘটলে খুব একটা তোড়জোড় দেখা যায় না। পুলিশের কর্মকর্তারাই বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ কিংবা সম্মানিত ব্যক্তিদের বাড়িতে চুরির ঘটনা ঘটলে তারা গুরুত্ব দিয়ে দেখেন। সম্প্রতি ঢাকায় চুরি বেড়ে যাওয়ার পর বেশকিছু ঘটনার খোঁজ নিয়ে তার প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে।
রাজধানীর পশ্চিম রামপুরা এলাকায় এক দশকের বেশি সময় ধরে থাকছেন বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সঙ্গীতশিল্পী মার্শিয়া লিলি মৃধা। চলতি বছর তার বাসায় মোট ৪ বার চুরি হয়েছে। প্রতিবার একধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করে তালা খুলে তার বাসার মালামাল লুটে নেয়া হয়েছিল বলে দাবি তার। এর আগেও বেশ কয়েকবার একইভাবে তার বাসায় চুরি হয়েছে বলে জানান তিনি। মার্শিয়া লিলি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন, এমন চুরির ঘটনায় ওই ভবনসহ আশেপাশের এলাকায় প্রায়ই ঘটে। শুরুর দিকে পুলিশ ঘটনায় তেমন একটা গতি না করতে পারায় পরে আর তিনি মামলা করেননি।
মার্শিয়া লিলি টিবিএসকে বলেন, "গত দুই বছরে অন্তত ৭ বার আমার বাসায় চুরি হয়েছে। মোবাইল ফোন ও স্বর্ণালঙ্কারসহ মূল্যবান অনেক জিনিসপত্র চুরি হয়। একবার আমার ফোন চুরি হয়েছিলো পুলিশকে জানানোর পর হারানোর জিডি নিয়ে সেটি আর উদ্ধার করতে পারেনি।"
তিনি দাবি করেছেন রামপুরা এলাকায় চুরির বিষয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করে তেমন একটা ফল পাওয়া যায় না, পুলিশ চুরির বিষয়ে উদাসীনতা দেখায়। অনেক ক্ষেত্রে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ থাকলেও তারা চোর ধরতে পারে না, উল্টো অভিযোগ করলে সিসিটিভি নষ্ট বলে অজুহাত দেখান।
"চুরির ঘটনা নিয়মিতই ঘটে কিন্ত পুলিশ কোন কূলকিনারা করতে পারে না বলে শুধু শুধু মামলা করে ভোগান্তি পোহাতে চাই না", বলেন মার্শিয়া।
হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রশিদের কাছে ওই এলাকায় নিয়মিত চুরির ঘটনার অভিযোগ ও থানা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
অন্যদিকে রাজধানীর তেজকুনিপাড়াসহ আশেপাশের এলাকার বহু বাসায় চুরির খবর পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন তাদের বাসা থেকে মোবাইলসহ বিভিন্ন মূল্যবান জিনিস চুরি হয়েছে। এমনই একজন রিজভী। তিনি তেজকুনিপাড়ার কমিশনার গলির একটি বাসায় থাকেন।
রিজভী টিবিএসকে বলেন, "আমার বাসায় কৌশলে তালা খুলে চুরির ঘটনা ঘটে। আমি ঘটনার বিস্তারিত লিখে তেজগাঁও থানায় মামলা দায়ের করতে গেলে তারা মামলা নেয়নি। চুরির ঘটনাকে হালকা করে দেখে 'হারিয়েছে' উল্লেখ করে জিডি নিয়েছে। কিন্ত জিডি নেয়ার পরও পুলিশের পক্ষ থেকে কোন তৎপরতা দেখা যায়নি, আমি নিজে থেকে কয়েক দফা যোগাযোগ করলেও তারা কোন তদন্ত করেনি। এই এলাকায় আমার পরিচিত অনেকের বাসায় এভাবে চুরি হয়েছে, কেউই আর মামলা বা পুলিশি সহায়তার জন্য উদ্যোগ নেয়নি।"
গত বছরের তুলনায় এই বছর চুরি বেড়েছে। তবে পুলিশ সেসব চুরির ঘটনা গুরুত্ব দেয়না। উল্টো ভুক্তভোগীরা মামলা করতে গেলে মামলা না নিয়ে 'হারিয়েছে' মর্মে জিডি নেয় থানা পুলিশ, এমন অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে যেসব ঘটনায় মামলা নেয়া হয় সেগুলোও দীর্ঘ সময় ধরে তদন্তাধীন দেখানো হয়। এতে করে চোর চক্র ধরাছোয়ার বাইরে থাকে, বাড়ে চুরির ঘটনা।
জানতে চাইলে বেশ কয়েকটি চুরির মামলার তদন্ত তদারককারী ডিএমপির একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেছেন, "চুরির মামলার তদন্ত বেশিরভাগ সময়েই হত্যা মামলার তদন্তের চেয়ে দুরূহ। হত্যার ঘটনায় আসামিরা কোন না কোন ক্লু রেখেই যায়, সেই ক্লু ধরে হত্যাকারীদের শনাক্ত করা সহজ হয়। তবে অধিকাংশ চুরির ঘটনায় কোন ক্লু পাওয়া যায় না, চোররা বিচ্ছিন্নভাবেই বাড়ি টার্গেট করে চুরির ঘটনা ঘটায়, যার সাথে তাদের কোন যোগসূত্রই থাকে না। তারা ঘুরে ঘুরে যখন যেখানে সুযোগ হয় চুরি করে চলে যায়। এজন্য চুরির মামলার তদন্তে দীর্ঘ সময় লেগে যায়, থানা পুলিশের অন্যান্য কাজে ব্যস্ততা থাকায় তারাও অনীহা দেখায়। অনেক সময় চুরির শিকার পরিবারও অসহযোগিতা করে।"
এদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধ পর্যালোচনা সভায় চুরি বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে। এতে বলা হয় জুলাই মাসে সারাদেশে ৫১৬টি চুরির মামলা হয়েছিলো সেটি আগস্টে বেড়ে ৬১৮ হয়েছে। সভায় চুরির বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করে বলা হয়, সম্প্রতি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে চুরির ঘটনা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।
পুলিশের এ পর্যবেক্ষণের সাথে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক গবেষণালব্ধ তথ্যের মিল রয়েছে। গবেষণালব্ধ তথ্য জানিয়ে তিনি টিবিএসকে বলেন, "নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় ও জীবনযাত্রার মান উন্নত না হওয়ায় চুরির মতো অপরাধ এখন বেশি ঘটছে।"
তবে চুরির ঘটনায় নাগরিকদেরও দায় আছে বলে মনে করেন তিনি।
অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক বলেন, "পুলিশ মূলত জনবল কম থাকার কারণে, অন্য অপরাধের পেছনে বেশি তৎপর হওয়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চুরির মামলা না নিতে অনীহা দেখা যায়। পুলিশের উচিত চুরির ঘটনা ছোট হলেও গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা, একই সাথে গ্রেপ্তার হওয়া চক্রদের বিশদ তথ্য সংগ্রহ করা ও তাদের নজরদারিতে রাখা। অনেক সময়, চুরির ঘটনা থেকে অনেকে ডাকাতি ও হত্যা-ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।"
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের মামলার তথ্যে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১ হাজার ৫৮০টি মামলা রেকর্ড হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বাসায় চুরি, জানুয়ারিতে ছিলো ৪৯টি এবং আগস্টে ৭৩টি হয়েছে। এরপরেই রয়েছে মোটরসাইকেল এবং গাড়ি চুরি, জানুয়ারিতে ছিলো ৩১টি, আগস্টে ৪২টি মামলা হয়েছে। তবে মামলার পরিসংখ্যান থেকে আসলে চুরির ঘটনার সত্যিকারের চিত্র পাওয়া যায় না। চুরির ঘটনা ঘটলেও অনেকেই মামলা করেন না, অনেকে করতে চাইলে শুধু জিডি নেয় পুলিশ। তবে, চুরির পরপর জাতীয় জরুরি সেবা হটলাইন ৯৯৯ এ সারাদেশ থেকে সাহায্য চেয়ে ফোন করেন ভুক্তভোগীরা। জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৭ হাজার ৫০৩টি কল এসেছে তাদের কাছে। এতে দেখা যায় জানুয়ারিতে ৯২৫টি ঘটনা থেকে বেড়ে আগস্টে ১ হাজার ১০৪টি চুরির ঘটনা ৯৯৯-এ রেকর্ড করা হয়েছে।
এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এ কে এম হাফিজ আক্তার নিজেই বলেছেন, সেপ্টেম্বর মাসে বিভিন্ন থানায় ৭৩টি চুরির মামলা হয়েছে। বাস্তবিক চিত্র এরচেয়েও বেশি। অল্প চুরির ঘটনায় আইনি জটিলতা ভেবে ভুক্তভোগীরা মামলাই করেন না। চুরির ঘটনা কমাতে চোরের ডাটাবেজ তৈরি করা হচ্ছে। ঢাকার চার হাজারের বেশি চোরের ডাটাবেজ তারা সংরক্ষণ করেছেন বলেও জানান।
তিনি বলেন, "যখনই কোনো একটি ঘটনা বাড়তে থাকে তখনই তা কমানোর জন্য চেষ্টা করে ডিএমপি। এখন আমরা বিশেষভাবে চুরির ঘটনা মনিটরিং করছি। এটা নিয়ে কাজ করছি। চুরির ঘটনায় আমরা একটি ডাটাবেজ ডেভেলপ করেছি। ঢাকার চার হাজারের বেশি চোরের ডাটাবেজ আমাদের কাছে আছে। মনিটরিং করা হয়েছে, কে কীভাবে কোথায় চুরি করছে। কখনো দিনে, কখনো রাতে চুরি হচ্ছে। ফাঁকা বাসাতে চুরি হচ্ছে। দিনের বেলা ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস বেশি চুরি হয়। আর রাতে ফাঁকা বাসায় কাউকে স্পর্শ না করেই চুরি হচ্ছে।"
তিনি বলেন, "ঢাকা শহরে মার্ডার কখনো বাড়ে কখনো কমে। আবার ডাকাতিও কখনো বাড়ে। ইদানিং ডাকাতির চেয়ে চুরি বেশি হচ্ছে। অপরাধীরা হয়তো মনে করছে চুরিটা বেশি নিরাপদ। চুরির পর ধরা পড়লেও দ্রুত জামিন পেয়ে যায়। তাছাড়া অল্প চুরির ঘটনায় থানায় রিপোর্টও করেন না অনেক ভুক্তভোগী।"