গাইবান্ধায় শুনানিতে চাপমুক্তভাবে বক্তব্য দিচ্ছেন কর্মকর্তারা: ইসির তদন্ত কমিটি
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেছেন, গত ১২ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ আসনের ভোটগ্রহণে অনিয়মের শুনানিতে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ অন্যান্যরা চাপমুক্তভাবে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করছেন। তারা স্বেচ্ছায় লিখিত দিচ্ছেন। এখানে চাপ দেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
বুধবার (১৯ অক্টোবর) সাঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সভাকক্ষে প্রেস কনফারেন্সে এসব কথা বলেন তিনি। অশোক গাইবান্ধা-৫ (ফুলছড়ি-সাঘাটা) উপনির্বাচনে ভোট বন্ধের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান। তিন সদস্যের এই কমিটির আরও দুজন হলেন ইসির যুগ্ম সচিব মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী এবং যুগ্ম সচিব মো. কামাল উদ্দিন বিশ্বাস। তারাও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। এর আগে সকাল নয়টা থেকে একই কক্ষে অশোক দেবনাথের নেতৃত্বে এ শুনানি চলে।
শুনানি শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, আজ ৪০ কেন্দ্রর প্রিসাইডিং ও সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে এখানে ডাকা হয়েছিল। তদন্ত হচ্ছে অনিয়মের কারণে বন্ধ হওয়া ৫১ কেন্দ্রকে ঘিরে। তদন্তের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ের কোনো প্রশ্নের উত্তর এখানে দিব না। তদন্ত করে একটি রিপোর্ট নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হবে।
'নির্বাচনের দিনে ভোট বন্ধের পর ৯১ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা লিখিত দিয়েছিলেন যে ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। এগুলো সংশ্লিষ্ট নির্বাচনের প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর করা বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। এই বিষয়টিও তদন্তে গুরুত্ব পেয়েছে। আজকের তদন্তে তাদেরকে শুনানিতে ডাকা হয়েছে'।
নির্বাচনের দিন যে কর্মকর্তারা সুষ্ঠু ভোটের কথা লিখেছিলেন- তাদের তাদের কাছ থেকে শুনানি গ্রহণের পর জোর করে কমিশনের পক্ষে কিছু লিখে নেওয়া হচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে অশোক দেবনাথ বলেন, 'প্রশ্নই ওঠে না। তারা স্বেচ্ছায় লিখিত দিচ্ছেন। তাদের কোনো ব্যাপারে প্রেসার দেওয়া হচ্ছে না'।
অনিয়মের কারণে বন্ধ হওয়া ৫১ ভোটকেন্দ্রের একটি হলো- সাঘাটার দহিচড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই কেন্দ্রের প্রিসাইডং কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন, বাদিনারপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাশিদুল ইসলাম। এই কর্মকর্তা বুধবার সকাল নয়টার দিকে সাঘাটা উপজেলা চত্বরে যান। তার শুনানি শুরু হয় বেলা দুইটার দিকে।
শুনানিতে তার কাছে কোন কোন বিষয় জানতে চাওয়া হয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে রাশিদুল বলেন, 'ভোটের দিনে আমার কেন্দ্রের অনিয়মের সিসিটিভির ভিডিওচিত্র দেখানো হয়। কেন এমন হয়েছিল, সে প্রশ্নের জবাবে আমি বলেছি, ঘটনার সময়ে পুলিশ, আনসারের সহযোগিতা চেয়েছি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সহযোগিতা চেয়েছি। কিন্তু, সাধারণ মানুষের ক্ষোভের কারণে উপস্থিত চারজন পুলিশ টিকতে পারেনি। ভিডিও থাকার পর আমার আলাদা ব্যাখ্যা দেওয়া কিছু নেই। এরপর ওই দিনের (ভোটের) ঘটনার বিবরণ লিখে দিয়ে চলে আসি'।
নির্বাচনে ৯৪ নম্বর কেন্দ্র অর্থাৎ রামনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রামনগর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ভোটের শুরু থেকেই অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এই কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধও করে ইসি। কিন্তু, ভোট বন্ধের পর এই কেন্দ্রের প্রিসাইডং কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম একটি চিঠি দিয়েছেন বেনামী ঠিকানায়। চিঠিতে ভোট সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি। বুধবার শুনানিতে তাকেও ডাকা হয়েছিল।
শুনানিতে তার কেন্দ্রের ভোট নিয়ে কী বলেছেন, কিংবা শুনানিতে তাকে কী কী প্রশ্ন করা হয়েছে এমন বিষয়ে জানতে তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। সাংবাদিক পরিচয় শুনেই তিনি বলেন, 'ব্যস্ত আছি পরে ফোন করেন।' এরপর একাধিকবার ফোন করার হলেও তিনি আর ফোন ধরেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রিটানিং কর্মকর্তা বলেন, শুধু ৫১ কেন্দ্র নয়, ভোটের পর যে ৯১ প্রিসাইডিং কর্মকর্তা 'সুষ্ঠু ভোট হয়েছে' বলে চিঠি দিয়েছেন- এসব কেন্দ্রের অনেক কর্মকর্তাকে ডাকা হয়েছে শুনানির জন্য। তার কেন্দ্রে ভোট বন্ধ করা হয়নি জানিয়ে এই কর্মকর্তা আরও বলেন, 'যেখানে অনিয়মের ভিডিও আছে, সেখানে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের কী বলার থাকতে পারে।'
বুধবার দিনভর শুনানিতে অংশগ্রহণকারী কোনো কর্মকর্তা গণমাধ্যমে সরাসরি কথা বলেনি। তবে শুনানিতে অংশগ্রহণ শেষে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিলেন ভোটের দিনের ঘটনা নিয়ে। তাদের মধ্যে অনেকে বলছেন, কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারা কতটা অসহায় থাকে বোঝানো যাবে না। এখন শাখের কড়াতে পড়েছেন। কার বুকে এত পাটা আছে যে সরকারি দলের মর্জির বাইরে যায়। ভোটের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এখন চাকরি হারাতে হয় কিনা- তা নিয়েই সংশয়ে আছেন তারা।
বুধবার ৪০ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, ২৭৮ জন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, ২০০ জন পোলিং এজেন্ট (প্রত্যেক প্রার্থীর পক্ষে), সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, সাঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরদার মোস্তফা শাহিন, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমানসহ ৫২২ জনের শুনানি হওয়ার কথা ছিল। তবে সবার শুনানি নেওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু কতজন অংশগ্রহণ করেছেন তাও তদন্ত কমিটি সাংবাদিকদের বলেনি।
আগামী বৃহস্পতিবার (২০ অক্টোবর) গাইবান্ধা সার্কিট হাউজে পাঁচ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, ১৭ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, বিজিবি ও র্যাবের দুই কমান্ডিং অফিসার, রিটার্নিং অফিসার সাইফুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম এবং জেলা প্রশাসক মো. অলিউর রহমানসহ ২৭ জনের শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। শুনানির প্রথম দুই দিন স্থানীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্বরাও উপস্থিত থাকবেন বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে ইসি।
সর্বমোট ৬৮৫ জন ব্যাক্তিকে শুনানির আওতায় নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে এ আসনের উপ-নির্বাচনের 'ব্যাপক অনিয়ম' খতিয়ে দেখতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে গত ১২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত গাইবান্ধা-৫ উপ-নির্বাচনের ভোট বন্ধ করে দেয় নির্বাচন কমিশন। ঢাকার নির্বাচন ভবনে সিসিটিভি ক্যামেরায় ভোট পর্যবেক্ষণ করে ক্রমাগতভাবে ৫১টি ভোটকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরে ভোট পুরো ভোট বন্ধের সিদ্ধান্ত আসে। এ ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়।