ছয় সপ্তাহের প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস, আরো কম সময় ক্ষমতায় ছিলেন যেসব বিশ্বনেতা
অভ্যুত্থান, হত্যা, পদত্যাগ, আত্মহত্যা, অসুস্থতা—ইতিহাসের সবচেয়ে স্বল্পায়ু নেতৃত্বের কারণ এসব। তবে যুক্তরাজ্যের সদ্যসাবেক প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের ক্ষেত্রে এসব কারণের কোনোটিই প্রযোজ্য নয়।
অথচ মাত্র ৪৫ দিন দায়িত্ব পালনের পরই প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে কম সময়ের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অপ্রীতিকর রেকর্ডের অধিকারী হয়ে গেলেন।
বর্তমানে রক্ষণশীল দলের রাজনীতি করলেও ট্রাসের মা-বাবা ছিলেন বামপন্থী। ট্রাস ছিলেন মধ্যপন্থী লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের কিশোরী সদস্য।
মাত্র ১৯ বছর বয়সে রাজতন্ত্রের বিলুপ্তির আহ্বান জানিয়ে আলোচনায় আসেন লিজ ট্রাস। এরপর ২০১০ সালে এমপি হিসেবে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে পা রাখেন তিনি। চার বছর এমপির দায়িত্ব পালন করার পর স্থান পান মন্ত্রিসভায়। ডেভিড ক্যামেরন ও টেরেসা মে সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন ট্রাস।
যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়নে থেকে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন ৪৭ বছর বয়সী ট্রাস। এজন্য ২০১৬ সালে ইইউয়ে থেকে যাওয়া নিয়ে আয়োজিত গণভোটে বরিস জনসনের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন তিনি।
বরিস জনসনের পদত্যাগের পর ঋষি সুনাককে হারিয়ে প্রধানমন্ত্রীত্ব পান লিজ ট্রাস। কিন্তু গত ২৩ সেপ্টেম্বর তার সরকারের অর্থমন্ত্রী কাওয়াসি কোয়ার্তেং সংক্ষিপ্ত বাজেট উপস্থাপন করার পরই অস্থিরতার সূত্রপাত হয়। ওই বাজেটে কর কমানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে যুক্তরাজ্যের বাজারে শুরু হয় অস্থিরতা। ব্রিটিশ পাউন্ডের দাম কমে যায়। এর জেরে কাওয়াসি কোয়ার্তেংকে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেন লিজ ট্রাস। কিন্তু তারপরও ট্রাসের পদত্যাগের দাবি জানাতে থাকেন কনজারভেটিভ পার্টির অনেক নেতা। তারই জেরে অবশেষে বৃহস্পতিবার পদত্যাগ করলেন তিনি।
ব্রিটিশ ইতিহাসে স্থায়ী আসন পেয়ে গেলেও রেকর্ডটা ট্রাসের জন্য খুব একটা সুখকর হলো না। এবার চলুন জেনে নেওয়া যাক সবচেয়ে কম দায়িত্বে থাকা নেতাদের সম্পর্কে।
স্বল্পমেয়াদি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী
ট্রাসের আগে যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে কম সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন টোরি দলের জর্জ ক্যানিং। ১৮২৭ সালে মাত্র ১১৯ দিন এ দায়িত্বে ছিলেন তিনি। যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে ১৮২৭ সালের ৮ আগস্ট মারা যাওয়ার কারণে এত অল্পকাল দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন ক্যানিং।
জর্জ ক্যানিং স্মরণীয় হয়ে আছেন নিজ দলের অন্য নেতৃত্বের সঙ্গে তীব্র বিবাদে লিপ্ত হওয়ার কারণে। তিনি পররাষ্ট্রসচিব থাকাকালে যুদ্ধ সচিব লর্ড কাসলেরিয়া-র সঙ্গে তার ছিল দা-কুমড়ায় সম্পর্ক।
ক্যানিং ও কাসলেরিয়ার মধ্যে রেষারেষি এতই বেশি ছিল যে তার জেরে সরকারই অচল হয়ে পড়ে।
দুজনের দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে ডুয়েল লড়াইয়ের মাধ্যমে। ওই লড়াইয়ে কখনও পিস্তল না ধরা ক্যানিংয়ের উরুতে গুলি লেগে জখম হন।
তীব্র সমালোচনার মধ্যে দুজনেই পদত্যাগ করেন। তবে পরবর্তীতে ক্যানিং প্রধানমন্ত্রী হন। যদিও মাত্র পাঁচ মাস দায়িত্ব পালনের পরই তিনি মারা যান।
স্যার অ্যালেক ডগলাসও বেশিদিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। ৩৬৩ দিন দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এরপর তার জায়গায় আসেন হ্যারল্ড উইলসন।
সবচেয়ে কম মেয়াদের চ্যান্সেলর
জোসেফ গোয়েবলস কারগরি দিক থেকে এই রেকর্ডের দাবি করতে পারেন।
গোয়েবলস কার্যত মাত্র রাতের জন্য জার্মানির চ্যান্সেলর ছিলেন। ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল আত্মহত্যা করেন অ্যাডলফ হিটলার। এরপর চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পান গোয়েবলস।
কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার পরদিনই ছয় সন্তানকে বিষ খাইয়ে হত্যা করেন গোয়েবলস। তারপর আত্মহত্যা করেন তিনি নিজে এবং তার স্ত্রী ম্যাগডা।
স্বল্পমেয়াদি প্রেসিডেন্ট
যুক্তরাষ্ট্রের নবম প্রেসিডেন্ট ছিলেন উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসন। ১৮৪১ সালে ৬৮ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়। ওই সময় পর্যন্ত তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বেশি বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পাওয়া ব্যক্তি।
কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার ৩২তম দিনেই মারা যান হ্যারিসন। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে কম সময় দায়িত্ব পালন করা প্রেসিডেন্টের রেকর্ডের মালিক বনে যান তিনি।
১৮৪১ সালের ৪ মার্চের ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে দিনে শপথ নেন হ্যারিসন। ওই দিন তিনি ঘোড়ার পিঠে চড়ে দুই ঘণ্টা ধরে উদ্বোধনী বক্তৃতা দেন।
কিছু প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, কোট বা হ্যাট না পরে ঠান্ডায় বক্তৃতা দেয়ার কারণে হ্যারিসনের নিউমোনিয়া বেঁধে যায়। এর ফলে ৪ এপ্রিল মৃত্যু হয় তার। তবে অন্যান্য প্রতিবেদনে বলা হয়, তার মৃত্যুর কারণ ছিল টাইফয়েড জ্বর।
ইতিহাসবিদরা বলছেন, বিশ্বের সবচেয়ে স্বল্প মেয়াদে দায়িত্ব পালন করা প্রেসিডেন্টদের অন্যতম ছিলেন পেদ্রো লাসকুরিয়ান। ১৯১৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের প্রেসিডেন্ট বনে যান মেক্সিকো সিটির সাবেক এই মেয়র।
জেন ভিক্তোরিয়ানো হুয়ের্তার নেতৃত্বে সংঘটিত বিদ্রোহকে বৈধতা দেওয়ার জন্যই স্রেফ প্রেসিডেন্ট পদে বসানো হয় লাসকুরিয়ানকে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে লাসকুরিয়ান মাত্র ৪৫ মিনিট দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
অল্পদিনের সম্রাট
১৯১৭ সালের ১৫ মার্চ সিংহাসন ছাড়েন জার দ্বিতীয় নিকোলাস। এরপর নিকোলাসের স্থলাভিষিক্ত হন তার ভাই দ্বিতীয় মাইকেল। যদিও মাত্র ১৮ ঘণ্টাই ক্ষমতায় ছিলেন তিনি।
এরপর রাশিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। সেই সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে ম্যানিফেস্টো স্বাক্ষর করেন দ্বিতীয় মাইকেল। এর মাধ্যমে রাশিয়ায় জার সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। মাইকেলকে অবশ্য কখনও সম্রাট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর তাকে প্রথমে কয়েদ, পরে হত্যা করা হয়।
স্বল্পমেয়াদি রাজা/রানি
ট্র্যাজিক লেডি জেন গ্রে। নয় দিনের রানি। ব্রিটিশ ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন সবচেয়ে কম সময় রাজত্ব করা রানি হিসেবে। ১৫৫৩ সালে রাজা ষষ্ঠ এডওয়ার্ডের মৃত্যুর পর ১৬ বছর বয়সে ইংল্যান্ড, ওয়েলস ও আয়ারল্যান্ডের রানি হিসেবে জেন গ্রের নাম ঘোষণা করা হয়।
সিংহাসনের অধিকারী হিসেবে অগ্রাধিকারীর তালিকায় জেন গ্রে ছিলেন পঞ্চম অবস্থানে। কিন্তু প্রোটেস্ট্যান্ট ছিলেন বলে তাকে রানি করা হয়।
তবে দেশবাসী অগ্রাধিকারের তালিকায় প্রথম স্থানে থাকা মেরিকে সমর্থন দেয়। এরপর প্রিভি কাউন্সিলও মেরির পক্ষে চলে যায়। পরের বছরই জেনকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
ফ্রান্সের রাজা উনবিংশতম লুই ১৮৩০ সালে সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তিনি মসনদে থাকতে পেরেছিলেন মাত্র ২০ মিনিট। জুলাই বিপ্লবের পর ১৮৩০ সালের ২ আগস্ট তার বাবা ক্ষমতা ছাড়লে উত্তরাধিকারবলে ক্ষমতা পান লুই।
কিন্তু এর ২০ মিনিট পরই লুই ক্ষমতা ছেড়ে দেন। তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজা ঘোষণাও করা হয়নি।
গিনেস বুক অভ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের তথ্যমতে, ফ্রান্সের রাজা উনবিংশতম লুই ও পর্তুগালের রাজা দ্বিতীয় লুই ফিলিপ যৌথভাবে সবচেয়ে কম সময় রাজা হিসেবে সিংহাসনে থাকার রেকর্ডের অধিকারী। ১৯০৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পর্তুগালের তৎকালীন রাজা প্রথম ডম কার্লোসের ওপর আততায়ী হামলা হয়। হামলায় তিনি নিহত হওয়ার পর ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে ক্ষমতা পান লুই ফিলিপ। কিন্তু ওই হামলায় লুই ফিলিপও আহত হয়েছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার ২০ মিনিট পর তিনিও মারা যান। তাই কার্যত ২০ মিনিটের জন্যই রাজা হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান