একদুয়ারিয়া’র তাঁবু ট্যুর যেভাবে দেশের গ্রামীণ পর্যটনের পথিকৃৎ হয়ে উঠছে
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2022/10/23/tourists_would_actively_pparticipate_in_preparing_the_meals_so_they_get_a_taste_of_rural_lifestyle._photo_sarah_steiner.jpeg)
গ্রামের কাঁচা রাস্তায় ছোটছোট বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে, মাঝেমধ্যে রাস্তার পাশে গাছ থেকে কোনো ফল ছিঁড়ে মুখে পুরছে, অথবা জাল দিয়ে পুকুরে মাছ ধরার চেষ্টায় আছে - বাংলাদেশের যেকোনো গ্রামে এগুলো বেশ পরিচিত দৃশ্য।
কিন্তু, কেমন হবে যদি এ বাচ্চাগুলো বাংলাদেশি না হয়? বিদেশি কোনো কিশোর-কিশোরীর দল- বাংলাদেশের কোনো গ্রামের রাস্তায় হল্লা করে বেড়ালে- তাতে মানুষ যে এক-দুবার ঘাড় ঘুরিয়ে ব্যাপারটার রহস্যভেদ করার চেষ্টা করবে, সেকথা বলাবাহুল্য।
নরসিংদী'র মনোহরদী উপজেলার এক অতি-সাধারণ গ্রামে আজকাল এমন দৃশ্যই নিয়মিত দেখা যায়। একদুয়ারিয়া নামের এ গ্রামটিতে সম্প্রতি বিশ্বের উন্নত দেশ থেকে নিয়মিত পর্যটক আসছেন। আর এসবের পেছনের কুশীলব এ গ্রামেরই এক তরুণ পর্যটন উদ্যোক্তা জাফর তুহিন।
জাফর স্বশিক্ষিত ট্যুর পরিচালনাকারী। গণিত বিষয়ে স্নাতক শেষ করেছেন তিনি। 'গ্রামীণ পর্যটন বিশ্বের অনেক দেশে জনপ্রিয়। কিন্তু, বাংলাদেশে এটির বিশেষ প্রচলন ছিল না,' দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন তিনি।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2022/10/23/jafar.jpg)
'বেশ কয়েক বছর ধরে আমি একটি ট্যুর এজেন্সি পরিচালনা করছি। সেটা ছিল ঢাকাভিত্তিক। অনেক বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় ঘূরতে যেতে চাইতেন। ২০২০ সালের গোড়ার দিকে, আমি গ্রামে ফিরে আসি এবং ভাবি এ ধরনের গ্রামীণ পর্যটনের কোনো প্যাকেজ শুরু করার এটাই মোক্ষম সময়,' দূরদর্শী এ উদ্যোক্তা যোগ করেন।
জাফরের এজেন্সির নাম 'তাঁবু ট্যুর'। এটির মাধ্যমে তিনি কেবল দেশে আসা পর্যটকদের সেবা দিতেন। ২০১৩ সাল থেকেই তিনি অর্থের বিনিময়ে নিজের বাড়িতে থাকা-খাওয়ার সুবিধা (এয়ারবিএনবি) দিয়ে আসছেন। গ্রামীণ পর্যটন শুরু করতে নিজের এ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি।
'গ্রামের মানুষ সহজ-সরল। আর তারা বেশ অতিথিপরায়ণও। তারা কোনো বিদেশি অতিথিকে যেভাবে সমাদর করেন তা বিশ্বে বিরল। বিদেশি পর্যটকদের সঙ্গে দেখা করতে তারা মুখিয়ে থাকেন। তাদেরকে নিজেদের বাড়িতে ডেকে নেন, আপ্যায়ন করান,' জাফর বলেন।
'পর্যটকেরা এ সমাদরে মুগ্ধ হন। এখানে থাকার সময় তারা যেসব কাজ করার সুযোগ পান, সেগুলোতেও তারা খুশি হন। কারণ এ কাজগুলোর মাধ্যমে গ্রামের জীবনযাপনের স্বাদ পান তারা।'
নিউজিল্যান্ডের পর্যটক ও ভ্রমণ ব্লগার সারাহ স্টাইনার সম্প্রতি সপরিবারে একদুয়ারিয়া গ্রাম ভ্রমণ করেছিলেন। নিজের ওয়েবসাইটে তিনি 'আ ইউনিক ভিলেজ হোমস্টে ইন বাংলাদেশ অ্যাট তাঁবু একদুয়ারিয়া' শীর্ষক একটি ব্লগে ওই ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কথা তিনি বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2022/10/23/6_photo_sarah_steiner.jpeg)
'হোটেলে থেকে স্থানীয় কোনো পরিবারের সঙ্গে দেখা করাটা সহজ নয়। বাংলাদেশে এরকম হোমস্টে স্থানীয় কোনো পরিবারের সঙ্গে দেখা করার জন্য আপনাকে ভিন্নধর্মী সুযোগ দেবে। পর্যটনের ছোঁয়ার বাইরে থাকা তাদের পারিবারিক জীবনকে প্রত্যক্ষ করতে পারবেন আপনি,' তিনি লিখেন।
এ পর্যটকেরা খাবার তৈরির কাজেও সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। ফলে গ্রামীণ জীবনব্যবস্থার আসল স্বাদ পেতে পারেন তারা।
'সকালে আমাদের প্রথম কাজ ছিল গরুর দুধ দোয়ানো। আমরা হাঁসের ডিম সংগ্রহ করি। এরপর পাশের বাগানে গিয়ে ঢেঁড়শ, বেগুন ও শসা তুলে আনি নাস্তার জন্য,' নিজের ব্লগে এভাবেই একদুয়ারিয়ায় থাকার স্মৃতি বর্ণনা করেছেন সারাহ।
'গ্যাভিন (সারাহ'র স্বামী) এ প্রথমবারের মতো মাটির চুলায় রান্না করেছিল। তার রান্নাটাও দারুণ হয়েছিল। আমরা ডিম, ঢেঁড়শ ও বেগুন ভাজি খেয়েছিলাম,' সারাহ লিখেন।
সারাহ পরিবার ওয়ারি-বটেশ্বরও ঘুরেছিলেন। সেখানে থাকা জাদুঘরও ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছিলেন তারা।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2022/10/23/a_homestay_in_bangladesh_gives_you_a_completely_different_opportunity_to_meet_a_family_and_see_the_way_of_family_life._photo_sarah_steiner.jpeg)
'সান কিসড বাকেট লিস্ট' নামক একটি ইউটিউব চ্যানেলে আরেক ব্রিটিশ দম্পতিকে একদুয়ারিয়া ভ্রমণের সময় ধান রোপণ শিখতে দেখা যায়।
স্থানীয় জীবনযাত্রা ধাঁচে সময় কাটানোর পাশাপাশি গ্রামীণ সম্প্রদায়কে সহায়তা করতে পেরেও খুশি এ পর্যটকেরা।
'জেনে ভালো লাগে যে আমরা যে অর্থ খরচ করি তা গ্রামের বাইরে যায় না। আপনার খাবার স্থানীয়ভাবেই কেনা হয়। পাশের বাড়িতেই আপনি রিকশাচালক খুঁজে পাবেন। এছাড়া স্থানীয় দোকান থেকে চা কেনা বা গরুর খাঁটি দুধ কিনলেও ওই পরিবারগুলোর উপকার হয়,' নিজের ব্লগে লিখেন সারাহ।
দুই রাত ও তিন দিনের এ ট্যুর প্যাকেজে যেকোনো পর্যটকদলের জনপ্রতি খরচ হয় ২০০ মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশি টাকায় ২০,০০০ টাকা। প্রতি বাড়তি রাতের জন্য পর্যটককে আরও ৪,০০০ টাকা তথা ৪০ ডলার দিতে হয়।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2022/10/23/apart_from_living_the_rural_lifestyle_what_also_makes_the_tourists_happy_is_that_they_can_help_the_community_by_travelling_to_the_village._photo_sarah_steiner.jpeg)
কোনো পর্যটক একা ভ্রমণ করলে তার জন্য খরচটা একটু বেশি পড়ে। তখন সেটা দাঁড়ায় ৩৫০ ডলার বা ৩৫,০০০ টাকায়। এ প্যাকেজের আওতায় ঐতিহাসিক সোনারগাঁও ভ্রমণের ব্যবস্থাও রয়েছে।
এত সব আকর্ষণের মধ্যে ভ্রমণকারীরা যে ব্যাপারটা কখনো ভুলতে পারেন না তা হলো একদুয়ারিয়ার মানুষদের আতিথেয়তা।
'বিশ্বাস করুন। এ গ্রামের আতিথেয়তা ভীষণ অসাধারণ। হাঁটতে বেরোলেই একটু পরই মানুষের হাতছানি দেখতে পাবেন। তারা আপনাকে ঘরে এসে ফ্যানের নিচে বসার আমন্ত্রণ জানাবে। ভাষা নিয়ে চিন্তা করবেন না, চমৎকার একটি গৃহের প্রশংসা করার বৈশ্বিক ভাষা রয়েছে,' সারা লিখেন।
জাফর তার উদ্যোগের মাধ্যমে যে সেবা দিচ্ছেন তা পরিষ্কারভাবে উপভোগ করেন এ পর্যটকেরা। আর তাদের ব্লগ ও ভিডিও একদুয়ারিয়ায় নতুন নতুন বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ করতে বেশ সহায়ক হচ্ছে।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2022/10/23/4_photo_sarah_steiner.jpeg)
বর্তমানে এ গ্রামে কেবল জাফরই হোমস্টে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তবে গ্রামের অন্যরাও এখন এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
'আমার প্রতিবেশী তাজুল ইসলাম তার বাড়িটিকে পর্যটক রাখার উপযোগী করে সাজাচ্ছে। আগামী নভেম্বরের মধ্যে এটি প্রস্তুত হয়ে যাবে বলে আশা করা যায়,' জাফর বলেন।
বাংলাদেশের ৭৫ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। গ্রামে না এসে এ দেশকে জানা সম্ভব নয়, বলেন তিনি।
'আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে অনেকে কাজ করছেন। কিন্তু একদুয়ারিয়ায় পর্যটকেরা মূলধারার বাংলাদেশি সংস্কৃতির স্বাদ পেতে পারেন,' বলেন জাফর।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2022/10/23/2_photo_sarah_steiner.jpeg)
'ধীর' বৈশিষ্ট্যের কারণে গতানুগতিক পর্যটন খাতের তুলনায় গ্রামীণ পর্যটন সহজাতভাবে বেশি টেকসই বলে মত প্রকাশ করেন জাফর। বাংলাদেশে গ্রামীণ পর্যটনের সম্ভাবনা অনেক বেশি বলেও মনে করেন এ তরুণ।
'আমাদের গ্রামগুলোকে শহরে পরিণত করার কোনো প্রয়োজন নেই। যখন মানুষ বুঝতে পারবে বিদেশি পর্যটকেরা আমাদের গ্রামগুলোকে পছন্দ করে, তখন তারা নিজেরাই গ্রামীণ বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্যগুলোকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করবে,' জাফর মন্তব্য করেন।