সরকারের হিসাবে চিনির কাঁচামাল পর্যাপ্ত, রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে সংকট
সরকারের হিসেবে দেশে পর্যাপ্ত র-সুগার মজুদের দাবি করা হলেও রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে, এবার চাহিদার তুলনায় কম চিনি আমদানি হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় থাকা ৫২ হাজার টনের বাইরে আমদানি পর্যায়ে আর কোনো চিনি নেই। ফলে দেশে চিনির ঘাটতির আশঙ্কা করছে মিলগুলো।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, গতবারের তুলনায় এবার চিনি আমদানি বেশি হয়েছে। শিগগিরই আরও এক লাখ টন চিনি আমদানি হবে। ফলে বাজারে চিনির সংকট হওয়ার কোন কারণ নেই। তদারকি জোরদার করলেই চিনির সংকট কেটে যাবে।
কদিন ধরেই চিনির বাজারে সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে, বেড়েছে পণ্যটির দাম। সরকার নির্ধারিত ৯০ টাকার খোলা চিনির দাম ২০ টাকা বেড়ে এখন ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যেখানে গ্যাস সংকটে উৎপাদন কমে যাওয়ার দাবি করা হচ্ছে। এর মধ্যেই সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন চিনির দামবৃদ্ধির সুযোগ খুঁজছে। কাঁচামাল আমদানিসহ বিভিন্ন খাতে খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে তাদেরও খরচ বেড়েছে, অন্যদিকে কাঁচামালের আমদানি কমেছে বলে দাবি করছে অ্যাসোসিয়েশন।
বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এক চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, বাংলাদেশ প্রতি বছর ২৭-২৮ মেট্রিক টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে। যেখানে এ বছর এখন পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ১৮ লাখ টন। গত বছর এই আমদানি ছিল ২৫ লাখ টন, তার আগের বছর ছিল ২৭ লাখ টন।বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন বলছে, দেশে প্রতি বছর চিনির চাহিদা রয়েছে ১৮ লাখ টন, যার ৯৮ শতাংশেরও বেশি মেটানো হয় আমদানির মাধ্যমে। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ চিনি ব্যবহার করে খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো।
সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব গোলাম রহমান স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ৯৬-৯৮ টাকা ডলার রেটে খোলা ঋণপত্রের বিনিময়মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে ১০৫ টাকায়। আগে যেখানে আমদানি শুল্ক ছিল প্রতি টন ২২-২৩ হাজার টাকা, এটা এখন সাড়ে ৩১ থেকে ৩২ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। ফলে প্রতি টন চিনির মিলগেট মূল্য দাঁড়াচ্ছে ১ থেকে ১ লাখ ৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ মণপ্রতি খরচ দাঁড়াচ্ছে ৩ হাজার ৭০৩ থেকে ৩ হাজার ৮৮৭ টাকা। কিন্তু বর্তমান মিলগেট মূল্য ৩ হাজার ১৫০ টাকা।
এদিকে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, 'গ্যাস সংকটের কারণে চিনির উৎপাদন ২০-২৫ শতাংশ কমেছে। তবে রিফাইনারি কোম্পানিগুলোর কাছে পর্যাপ্ত কাঁচামাল রয়েছে।'
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র এজিএম তাসলিম শাহরিয়ার বলেন, 'গ্যাসের কারণে চিনির উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাজারে সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে।'
এদিকে অ্যাসোসিয়েশন দাবি করছে, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ১টি অপরিশোধিত চিনির জাহাজ রয়েছে এবং রপ্তানিকারক দেশ ব্রাজিল থেকে বাংলাদেশে আসার মতো কোনো জাহাজ লাইনআপে নেই। অন্যদিকে বিকল্প দেশ হিসেবে ভারতও চিনি রপ্তানি বন্ধ রেখেছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশে চিনির ঘাটতি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে আশঙ্কা করছে অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা।
এ অবস্থায় অ্যাসোসিয়েশন চিনির উপর অরোপিত সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহার, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কোনো ধরনের বিধিনিষেধ ছাড়া ঋণপত্র খোলার অনুমতি দেয়া, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রস্তাবিত ডলার মূল্যে আমদানিকৃত চিনির মূল্য পরিশোধে ডলার সরবরাহ নিশ্চিত করা, ৩৬৫ দিনের ডেফারড পেমেন্টের মাধ্যমে কাঁচামাল আমদানির ব্যবস্থা এবং কারখানা চালু রাখার স্বার্থে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে।
গ্যাসের সংকট থাকবে না: ভোক্তা অধিদপ্তর
গ্যাস সংকটের কারণে বড় বড় রিফাইনারিগুলোর চিনির উৎপাদন ২০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। যে কারণে সরবরাহে সমস্যা তৈরি হয়েছে। তবে রোববার থেকে রিফাইনারি-সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে গ্যাসের সংবরাহ স্বাভাবিক হবে এবং পর্যাপ্ত কাঁচামালের মজুদ থাকায় দ্রুতই এই সংকট কেটে যাবে বলে জানান ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান।
রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজার খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ী সমিতির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে চিনির বাজার পরিস্থিতি বিষয়ে এক মতবিনিময় সভায় ৫টি রিফাইনারি পরিদর্শনে এসব তথ্য পাওয়ার কথা জানান ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।
তিনি বলেন, 'পর্যাপ্ত কাঁচামাল আমদানি করা আছে, উৎপাদন ঠিক রাখতে পারলে সমস্যা থাকবে না। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহের জন্য বলা হয়েছে। তারা সম্মত হয়েছেন।'
তিনি আরও বলেন, কোনো ব্যবসায়ী যদি মনে করেন তাদের চিনি দরকার, তাহলে আমাদের বললে আমরা ফ্যাক্টরি থেকে যত চিনি দরকার ততটুকু সরবরাহের ব্যবস্থা করব।'
এ অনুষ্ঠানে সিটি ও মেঘনা গ্রুপের ডিলাররা চিনির বাজারে সংকটের কারণ হিসেবে রিফাইনারদের দায়ী করেছেন। তারা অভিযোগ করেন, কারখানা থেকে পর্যাপ্ত চিনি সরবরাহ না করায় বাজারে সংকট দেখা দিয়েছে। পরিবেশক পর্যায়ে প্যাকেট চিনি নেই। সেপ্টেম্বর মাসে অর্ডার করা চিনি এখনো ডেলিভারি দেয়নি।
এ সময় মেঘনা গ্রুপের ডিলার জামাল হোসেন বলেন, এখনো মেঘনার কাছে ১৬ টন প্যাকেটজাত চিনির অর্ডার করা আছে, কোম্পানি থেকে সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে কোম্পানি জানিয়েছে, খোলা চিনির দাম বেড়েছে, যে কারণে তারা প্যাকেট চিনি সরবরাহ বন্ধ রেখেছে।
সিটি গ্রুপের ডিস্ট্রিবিউটর মো. ওমর ফারুক জানান, 'আমরা চিনির অর্ডার দিচ্ছি, কোম্পানিগুলো আমাদেরকে হালিম, ফিরনি পাঠিয়ে দিচ্ছে। সেপ্টেম্বরে চিনির অর্ডার দিয়েছি, এখনো সরবরাহ করেনি। কোম্পানিগুলোর কাছে আমরা সবাই জিম্মি হয়ে পড়েছি।'
একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে টিকে, আব্দুল মোনেম ও এস আলমের রিফাইনারির বিরুদ্ধেও।
উল্লেখ্য, সরকার গত ৬ অক্টোবর প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনির দাম ৯৫ টাকা ও খোলা চিনির দাম ৯০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু বাজারে দু-তিন দিন ধরে প্যাকেটের চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা কেজি দরে।
ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানান, দাম নির্ধারণের সময় রিফাইনারি কোম্পানিগুলোর মতামত নিয়েই করা হয়েছে। কিন্তু এখন তারা মানছে না। বেশ কিছুদিন ধরেই ডিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে চিনির ডেলিভারি শ্লথ করা হয়েছে। এখন সংকটের কারণ খুঁজতে বাজার অভিযানে গিয়ে দেখা যাচ্ছে অনেকে প্যাকেট কেটে চিনি খোলা বিক্রি করছে।