যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসকদের জীবনকে সহজ করে তুলছেন যেসব বাংলাদেশি তরুণেরা
সুদূর মার্কিন মুল্লুকের কোনো চেম্বারে বসে রোগী দেখছেন ব্যস্ত ডাক্তার। চোখে সাধারণ চশমা সদৃশ গুগল গ্লাস। সেই গ্লাসের বদৌলতে প্রায় ৮ হাজার মাইল দূরে বসে ডাক্তার-রোগীর কথোপকথন শুনে লিপিবদ্ধ করছেন আরেকজন। বাংলাদেশে নিযুক্ত চিকিৎসার দলিল লিপিবদ্ধকারী সেই ব্যক্তি হলেন মেডিকেল ডকুমেন্টেশন স্পেশালিস্ট বা স্ক্রাইব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসাব্যবস্থায় নতুন ধারা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান অগমেডিক্সের কল্যাণে বাংলাদেশি তরুণদের জন্য এক সম্ভাবনাময় পেশা হিসেবে পরিচিত হচ্ছে এই স্ক্রাইবিং।
আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে ডাক্তার-রোগীর এই কথোপকথন দলিলবদ্ধ করার প্রক্রিয়াটি অনেকের কাছেই নতুন ঠেকতে পারে। অন্যদিকে রোগীর যাবতীয় তথ্য ও চিকিৎসার বিবরণ লিপিবদ্ধ করে সংরক্ষণ করে রাখা আমেরিকায় সকল চিকিৎসকের জন্যই বাধ্যতামূলক। কারণ সেখানকার নাগরিকদের প্রায় সবাই স্বাস্থ্য বীমার মাধ্যমে চিকিৎসা সেবার খরচ মিটিয়ে থাকেন। আর ডাক্তারেরা যদি রোগীর সম্পূর্ণ চিকিৎসার বিবরণ বীমা কোম্পানিকে দিতে ব্যর্থ হন, তবে চিকিৎসার জন্য তারা কোনো ফি পাবেন না। তাই প্রত্যেক চিকিৎসকই গুরুত্ব সহকারে রোগীর তথ্য দলিলবদ্ধ করার কাজটি করে থাকেন।
বেশিরভাগ সময়ই যুক্তরাষ্ট্রের ডাক্তারদের নিজেদেরই এই স্ক্রাইবিং এর কাজটি করতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোগী দেখার পাশাপাশি এই লেখালেখির কাজটি অনেকের কাছেই হয়ে ওঠে অতিরিক্ত বোঝার। কাজের চাপ কমাতে কেউ কেউ সরাসরি তাদের চেম্বারেও স্ক্রাইব নিয়োগ করে থাকেন। কিন্তু আমেরিকার মতো দেশে সরাসরি স্ক্রাইব নিয়োগ যেমন ব্যয়বহুল তেমনি ডাক্তারের চেম্বারে বাড়তি মানুষের উপস্থিতি সেখানকার রোগীদের জন্যও অনেকক্ষেত্রেই অস্বস্তিকর। এই সমস্যার সমাধানেই বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত মার্কিন নাগরিক ইয়ান শাকিল ও তার বন্ধু পেলু ট্র্যান কাজে লাগান গুগল গ্লাসকে। গড়ে তোলেন ডাক্তারদের সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠান 'অগমেডিক্স'।
গুগল গ্লাসের পাশাপাশি বর্তমানে স্মার্টফোন আর আইপ্যাডে অডিও-ভিডিও কলিং-এর মাধ্যমে প্রায় দেড় হাজার মার্কিন চিকিৎসককে সাহায্য করছেন অগমেডিক্সের নিয়োগকৃত বিশ্বের পাঁচটি দেশের মেডিকেল ডকুমেন্টেশন স্পেশালিস্টরা। আমেরিকা ও বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, শ্রীলঙ্কা ও ডোমিনিকান রিপাবলিকে ছড়িয়ে আছে অগমেডিক্সের কার্যক্রম। বর্তমানে অগমেডিক্স বাংলাদেশের জনবল প্রায় ৭২০ জন। যাদের মধ্যে স্ক্রাইব হিসেবে কাজ করছেন ৪৫০ জন।
কীভাবে করতে হয় স্ক্রাইবিং
ডাক্তার-রোগীর কথোপকথনের সময় অনলাইনে সরাসরি যুক্ত থেকে বা রেকর্ডিং শুনে সব তথ্য সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করতে হয় ডকুমেন্টেশন স্পেশালিস্ট বা স্ক্রাইবদের। সময় অনুযায়ী অগমেডিক্সে তাদের কাজকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। লাইভ স্ক্রাইবিং বা রিয়েল টাইম স্ক্রাইবিং (আরটি) এবং নোটস স্ক্রাইবিং বা নন রিয়েল টাইম স্ক্রাইবিং (এনআরটি)।
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের দেশের সময়ের ব্যবধানের কারণে সে দেশে ডাক্তারদের রোগী দেখা শুরু হয় এখানের সময়ে সন্ধ্যার পর বা রাতে। আবার তাদের কাজ শেষ হয় বাংলাদেশের গভীর রাতে বা ভোরে। ডাক্তারদের এই কাজের সময়টায় সরাসরি অনলাইনে যুক্ত থেকে যারা স্ক্রাইবিং এর কাজ করেন তারা হলেন আরটি স্ক্রাইব। আর যারা সরাসরি যুক্ত না থেকে রেকর্ড করা কথোপকথন থেকে দলিল তৈরি করেন তারা এনআরটি স্ক্রাইব।
বাংলাদেশের সময় সাধারণত সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় এনআরটি স্ক্রাইবদের। রেকর্ডিং শুনে রিপোর্ট তৈরি করে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর ইলেকট্রনিক হেলথ রেকর্ড সিস্টেমে জমা দিতে হয় তাদের। কাজের সময়ে সরাসরি ডাক্তারদের সাথে কথা বলার সুযোগ থাকে না এক্ষেত্রে। আরটি স্ক্রাইবদের কাজ চলে ডাক্তারদের কাজের সময় অনুযায়ী সন্ধ্যা রাত থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। রোগী দেখার সময়ে ডাক্তারদের সাথে যুক্ত থেকে রিপোর্ট তৈরি করতে করতে কোনো বিভ্রান্তি থাকলে তা সরাসরিই জিজ্ঞেস করে নিতে পারেন তারা।
মার্কিন ডাক্তার-রোগীর কথোপকথনের ভাষা যেহেতু ইংরেজি, তাই স্ক্রাইবদের ইংরেজির জ্ঞান থাকতে হয় যথেষ্ট। কথা শুনে ঠিকঠাক বুঝতে পারার পাশাপাশি তা সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করার জন্য ইংরেজি টাইপিং-এ দক্ষ হওয়াটাও জরুরী।
কাজের সুযোগ-সুবিধা
সাংবাদিকতায় পড়াশোনা শেষে কিছুদিন সংবাদপত্রে কাজ করেছেন ফারিয়া ইসলাম। কলেজ বন্ধুর কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন অগমেডিক্স সম্পর্কে। স্ক্রাইব হিসেবে কাজ করতে নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ের পড়াশোনা দরকারি নয় জেনে কাজে আগ্রহী হয়েছিলেন তিনি। নবীনদের জন্য আকর্ষণীয় বেতন কাঠামো, স্বাস্থ্য বীমার সুবিধা দেশের অন্যান্য চাকরির চেয়ে স্ক্রাইবিং পেশাকে আলাদা করে তুলেছিল ফারিয়ার কাছে। গত দুই বছর যাবত অগমেডিক্সে ফুলটাইম স্ক্রাইব হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
বিবিএ শেষ করার পর মো. আরিফুজ্জামানের তৃতীয় চাকরি অগমেডিক্সে। ২০২০ সাল থেকে স্ক্রাইব হিসেবে আছেন তিনি। কাজের ক্ষেত্রে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ এখানে তার সবচেয়ে ভালো লাগার জায়গা। পাশাপাশি কাজের সময় বিনামূল্যে খাবার ব্যবস্থা, যাতায়াতের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা তার অন্যান্য কর্মক্ষেত্রের চেয়ে পৃথক করেছে অগমেডিক্সকে। আরিফুজ্জামানের মতে, স্ক্রাইবরা হলেন ডাক্তারদের 'ভার্চুয়াল শ্যাডো'।
ফার্মেসি থেকে সদ্য গ্র্যাজুয়েশন শেষ করা রূহানী আমরীন অগমেডিক্সে যোগদান করেছিলেন নিজের কৌতুহল থেকেই। প্রযুক্তির মাধ্যমে কীভাবে এতদূরে বসে চিকিৎসা ব্যবস্থায় অবদান রাখা যায় তা নিয়েই কৌতুহলী ছিলেন তিনি। স্ক্রাইব হিসেবে কাজ করতে করতে প্রতিদিন নিজের দক্ষতাগুলোকে ঝালাই করে নেওয়ার, প্রতিনিয়ত নতুন জিনিস শিখে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন তিনি। তার মতে, "কারো শেখার মেন্টালিটি, এফোর্ট দেওয়ার ক্ষমতা আর ডেডিকেশন থাকলে সে স্ক্রাইব হিসেবে সহজেই নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে পারবে।"
রাত জাগতে অভ্যস্ত এলএলবি গ্র্যাজুয়েট অনিক চৌধুরী তার বন্ধুর কাছ থেকে পরামর্শ পেয়েছিলেন অগমেডিক্সে রাতের শিফটে কাজ করার। ২০১৯ সাল থেকে এখানে স্ক্রাইব হিসেবে আছেন তিনি। অনিকের মতে, এই পেশা যেকোনো মানুষকে 'মাল্টিটাস্কিং'-এ দক্ষ করে তোলে। তার ভাষ্যে, "যদি কেউ মনে করেন তার কোনো দক্ষতা নেই, তবে এই চাকরিতে এসে তিনি সহজেই নিজের দক্ষতা খুঁজে নিতে পারেন।"
যেকোনো বিষয়ে সদ্য গ্র্যাজুয়েশন করা প্রার্থীদের প্রাধান্য দেওয়া হয় মেডিকেল ডকুমেন্টেশন স্পেশালিস্ট বা স্ক্রাইব হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে। এই পেশায় কাজ করার জন্য আগে থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জ্ঞান থাকার প্রয়োজন নেই। প্রতিষ্ঠান থেকে তিন মাসের ট্রেনিং সেশনেই শিখিয়ে নেওয়া হয় সবকিছু। প্রশিক্ষণ শেষে নিয়োগ পাওয়া একজন স্ক্রাইবের বেতন শুরু হয় ২৮ হাজার টাকা (এনআরটি স্ক্রাইব) থেকে ৩৫ হাজার (আরটি স্ক্রাইব) টাকার মধ্যে। প্রতিবছর রয়েছে ইনক্রিমেন্ট ব্যবস্থাও।
ডাক্তারদের জীবনকে সহজ করছেন তারা
অগমেডিক্স বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রাশেদ মুজিব নোমানের মতে, অনলাইনে স্ক্রাইবদের সহায়তা নেওয়া মার্কিন ডাক্তাররা তাদের বেঁচে যাওয়া সময়ে অন্তত ২০% বেশি রোগী দেখতে পারছেন। এতে বদলে যাচ্ছে তাদের জীবনধারা।
যেকোনো দেশেই স্বাস্থ্যসেবা একটি কঠিন কাজের সেক্টর। এক্ষেত্রে ছুটি বা বিশ্রামের সুযোগ পাওয়া মুশকিল। অগমেডিক্সের স্ক্রাইবরা যুক্তরাষ্ট্রের ডাক্তারদের কাজের ভার অনেকটাই নিজেদের কাঁধে নিয়ে তাদের জীবনকে সহজ করে তুলছেন।
ফারিয়া ইসলামের ভাষ্যে, "আমি একজন অর্থোপেডিক্স বিশেষজ্ঞের সাথে কাজ করছি। কাজের চাপে তিনি গত ৬ বছর যাবত পরিবারের সাথে কোথাও ঘুরতে যেতে পারেননি। আমি তার সাথে স্ক্রাইব হিসেবে কাজ শুরু করার পর তিনি গত চার মাসে দুইবার পুরো পরিবার নিয়ে ছুটি কাটিয়ে এসেছেন। অন্য আরেকজনের কাজের ভার এতটা কমিয়ে দিতে পেরেও নিজে স্যাটিসফেকশন পাই।"
নিয়োগের আগেই মেলে প্রশিক্ষণ ভাতা
স্ক্রাইব হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে প্রার্থীদের বেশ কিছু ধাপ পার করে আসতে হয়। শুরুতেই আগ্রহী প্রার্থীরা অংশ নিতে পারেন অগমেডিক্সের 'লাইভ রিক্রুইটমেন্ট' সেশনে। সেখানে অগমেডিক্সের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার পর তারা অংশগ্রহণ করতে পারেন 'প্রি স্ক্রিনিং টেস্ট'-এ। ইংরেজি গ্রামার, টাইপিং, লিসেনিং- ইত্যাদির পরীক্ষা নেওয়া হয় এই পর্যায়ে। এই ধাপ পেরোতে পারলে মৌখিক ভাইভা-র আয়োজন করা হয়। সেখানে উত্তীর্ণ হলে তিন মাসের প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
প্রশিক্ষণে ইংরেজি দক্ষতা বাড়ানো, চিকিৎসা সংক্রান্ত ভাষা শেখানো, রিপোর্ট লেখায় গুরুত্ব দেওয়া হয়। তিন মাসের প্রশিক্ষণ শেষে স্ক্রাইব হিসেবে দক্ষ হয়ে উঠতে পারলে স্থায়ীভাবে নিয়োগ করা হয়। প্রশিক্ষণের সময় প্রথম মাসে ৫ হাজার টাকা, দ্বিতীয় মাসে ১০ হাজার টাকা এবং তৃতীয় মাসে ১২-১৫ হাজার টাকা ভাতা দেওয়া হয় প্রার্থীদের।
পাঁচ বছর আগে অগমেডিক্সের কার্যক্রমের শুরুর দিকে প্রশিক্ষণের কাজে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রশিক্ষক আনা হত কিংবা ভারতে পাঠানো হত বাংলাদেশি প্রার্থীদের। বর্তমানে অগমেডিক্স বাংলাদেশেই আছে নিজস্ব প্রশিক্ষক। পাশাপাশি চূড়ান্ত পর্যায়ে অনলাইনে পর্যবেক্ষণ করেন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ দল। রাশেদ মুজিব নোমান বলেন, "যেহেতু ডাক্তারদের সাথে মানুষের জীবন নিয়ে কাজ করি, তাই আমরা কোনো রিস্ক নিতে চাই না। আমাদের এখানে ট্রেনিংটা কাজের থেকেও কঠিন।"
পেশার ভবিষ্যৎ
অগমেডিক্স বাংলাদেশে স্ক্রাইব হিসেবে যোগদান করা প্রার্থীরা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের সাপেক্ষে ব্যবস্থাপক পর্যায়ের কাজে উন্নিত হওয়ার সুযোগ পান।
রাশেদ মুজিবের ভাষ্যে, "আমরা নতুনদের জন্য একটা ক্যারিয়ার গ্রোথ অফার করছি। যে কেউ ফ্রেশার স্ক্রাইব হিসেবে শুরু করলে পাঁচ বছরে তারা ম্যানেজমেন্ট লেভেল পর্যন্ত যেতে পারবে। মাসিক লাখ টাকা ইনকাম করতে পারবে তারা। অনেক সম্ভাবনাময় একটা পেশা এটি। অগমেডিক্সে যারা কাজ করে সবাই দেশের করদাতা। দেশীয় অর্থনীতির জন্যও লাভজনক প্রতিষ্ঠান এটি।"
কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার প্রয়াসে নতুন কর্মী নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অনুপাত রাখতে চায় অগমেডিক্স বাংলাদেশ। তরুণদের মধ্যে শুদ্ধ ইংরেজির চর্চা না থাকা ও রাতে কাজ করার অভ্যাস তৈরি না হওয়া দেশে এই পেশায় বড় চ্যালেঞ্জ মনে করেন রাশেদ।
অগমেডিক্সের লক্ষ্য ২০২৫ সালের ভেতর বাংলাদেশে মোট ২০০০ কর্মী নিয়োগ করা। প্রতিমাসে কমপক্ষে ৬০-৮০ জন নতুন কর্মী নিয়োগ করে সেই লক্ষ্যের দিকেই এগোচ্ছেন তারা। নতুন নিয়োগকৃতদের মধ্যে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, আইটি ইঞ্জিনিয়ারসহ নানা পেশার লোক থাকলেও প্রাধান্য পাচ্ছেন ডকুমেন্টেশন স্পেশালিস্ট বা স্ক্রাইবরাই।