ছয় মাস পর নিম্নমুখী বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ
তারল্য সংকটে ব্যাংকগুলোর ঋণের শ্লথ গতি ও দেশের আমদানির পরিমাণ কমতে থাকায় টানা ছয় মাস পর বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমেছে।
সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে ১৩.৯৩%। এর আগের মাসে আগস্টে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪.০৭%। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিশ্বের অধিকাংশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মানি ফ্লো কমাতে তাদের মুদ্রানীতি কঠোর করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও ২০২২ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হার কমিয়েছে। তবে বর্তমান সময়ের আলোকে ঋণের প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি কারণ ঋণের সুদহার কম। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মানি ফ্লো আরও কমিয়ে আনতে হবে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, 'কোভিড পরবর্তিতে দেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোতে ঋণের পরিমাণ বেড়েছিল। এখন অধিকাংশ ব্যাংকে তারল্য সংকট রয়েছে। মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকায় আমানতের রেট প্রায় ৭% এর কাছে। অন্যদিকে মানি মার্কেটে রেট হাই তাই ব্যাংকগুলো আগ্রহ দেখাচ্ছেনা উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে নামমাত্র প্রফিটে ঋণ দিতে।'
তিনি আরও বলেন, 'কেন্দ্রৗয় ব্যাংকের করারোপের কারণে আমদানি অনেকটা কমছে। এছাড়া সামনে পরিস্থিতি কোন দিকে যায় সেটা চিন্তা করে অনেকে ঋণ নিচ্ছে না। যার ফলে ঋণের প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমতির দিকে।'
কোভিড পরবর্তিতে দেশের আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আমদানি ব্যয় ব্যাপক পরিমাণে বেড়ে যায়। যার কারণে ঋণের পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের জুলাইতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮.৩৮%। এরপর টানা ছয় মাস বেড়ে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১.০৭%। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কিছুটা কমে ১০.৮৭% হয়। এরপর টানা আগস্ট পর্যন্ত বাড়তে থাকে। সেপ্টেম্বরে এসে পয়েন্ট ১০ শতাংশ কমেছে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আমদানিতে নানা শর্ত থাকায় গত কয়েকমাস যাবৎ আমদানি কমছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ব্যবসায়ীদের এলসি ওপেনিং কমেছে ৩১.১৬%।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা এলসি খুলেছে ৫.৭০ বিলিয়ন ডলার। যা আগের অর্থবছরে একই সময়ে ছিল ৮.২৮ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এলসি কম খুলেছে ২.৫৮ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মানি ফ্লো কমাতে চারবার ব্যাংক রেপো রেট বাড়িয়েছে। সর্বশেষ গত দুই অক্টোবর থেকে ৫.৭৫% হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তারল্য সংগ্রহ করতে হচ্ছে।
এদিকে আগস্টে দেশের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯.১%। তার আগের মাস জুলাইতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৫%। মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে থাকায় ব্যাংকগুলোর আমানতের রেট বাড়লেও লেন্ডিং রেট একই থেকে যায়। যার কারণে ব্যবসায়ীরা সহজে ঋণে পাওয়ায় ঋণের প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের আগস্টে ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবৃদ্ধি রয়েছে ৭.৫৩%, যদিও এই সময়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৪.৭৮%। আমানতের তুলনায় ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকায় ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জুলাই মাসে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে ১২,৫৪৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। পরের মাস আগস্টে ব্যাংকগুলো ১২,২৫৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। সেপ্টেম্বরে ব্যাংকগুলো ঋণ নিয়েছে ১৫,৭৯৮ কোটি টাকা। অথচ গত বছরের এই সময়ে ব্যাংকগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ ছিল দুই থেকে তিন হাজার কোটি টাকার মতো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা। এরপর থেকে দেশের আমদানি বাড়তে থাকায় রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে। নিয়মিত ডলার বিক্রির কারণে কমতে থাকে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ; এছাড়া চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি ডলারের দাম এক টাকা বেড়ে ৮৬ টাকা হয়।
চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ডলারের সংকট আরও বাড়তে থাকে, যার ফলে দামও চড়া হতে থাকে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারি আমদানি বাবদ প্রতি ডলার বিক্রি করছে ৯৭ টাকায়। তবে ব্যাংক টু ব্যাংক ডলারের রেট সর্বোচ্চ ১০৫ টাকা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারের পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে এখন মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এই মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে টাকার সাপ্লাই কমাতে হবে। মানুষের হাতের টাকার সাপ্লাই বাড়তে থাকলে তাহলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে।'
'এখন বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে তবে এটা যদি উৎপাদন খাতে ব্যয় হয় তাহলে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়বে না, তাই ব্যাংকগুলোকে উৎপাদন খাতেই ঋণ দিতে হবে।'
গত অর্থবছরের আগস্টে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। তবে বিদায়ী অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি ও আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণে ব্যাংকগুলোর কাছে ৭.৬ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। এছাড়া চলতি বছর এখন পর্যন্ত সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার বিক্রি করায় গত ২৬ অক্টোবর রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩৫.৮৫ বিলিয়ন ডলার।