বাংলার ভূতেরা কী খায়?
'ঠিক দুপুর বেলা, ভূতে মারে ঠেলা'—বহুল প্রচলিত কথাটা অনেকেই হয়তো শুনেছেন। বিশেষ করে কলকাতার সোনালি দিনগুলোতে এটি খুব প্রচলিত ছিল। দুপুর বেলা বড়রা ঘুমিয়ে থাকাকালে ছোটরা যেন লুকিয়ে লুকিয়ে দুষ্টুমি করতে না বেরোয় সেজন্য বাচ্চাদের তারা ভূতের ভয় দেখাতেন। দুপুরের সুনসান নিরবতার মাঝে এই বাক্যটি অশুভও শোনাত বটে। ছোট থাকতে আসলেই মনে হতো কোনো নির্দিষ্ট একটি জায়গায় ভূত আছে, সে ভূত থেকে ছোট্ট ছোট্ট আদুরে বাচ্চারাও রেহাই পেত না।
বাংলার ভূতেদের মজার একটি দিক নিয়ে স্ক্রল ডটইনে লিখেছেন প্রিয়দর্শিনী চ্যাটার্জি। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পাঠকদের জন্য তা প্রকাশিত হলো।
দুষ্টুমি করলেই বড়রা ভূতের ভয় নিয়ে হাজির! তারা বলত ভূতেরা আমাদের চেতনায় সর্বদা লুকিয়ে থাকে। দুষ্টুমির সীমা অতিক্রম করলে আমাদের ভয় দেখাতে সদা প্রস্তুত তারা। সূর্যাস্তের পর বাইরে থাকা, প্লেটের সব খাবার না খেয়ে রেখে দেওয়া, তেতো জিনিস খেতে না চাওয়া; মানে ছোটরা বড়দের যে কথাগুলো শুনতে চাইতনা বা মানতে চাইতনা, সবখানেই ভূতের ভয় দেখিয়ে ছাড়ত। দুষ্টু মামদো ভূত না হলে এক পাওয়ালা একানড়ে, কুচুটে পেত্নি কিংবা কোঁ কোঁ করা শাকচুন্নি, মা-বাবাদের বারণ করা কোনো কাজ করতে গেলে এদের ভয় মনে লেগেই থাকত। খুব বিশ্বাস করতাম যে এদের থেকে পালান একেবারেই অসম্ভব। যেখানেই লুকোই, খুঁজে এরা পাবেই।
ছোটদের ভয় দেখানো বাদেও অন্তত বাঙালির মননে ভূতেরা মানুষের মতো দেহধারী হয়ে বসবাস করে। বাঙালির কল্পনায় ভূতেরা থাকে তেপান্তরের মাঠের তাদের পছন্দের গাছের মগডালে কিংবা কোনো পরিত্যক্ত বাড়ির ছায়াছন্ন কোণে। মানুষের মতোই দৈনিক কাজগুলো করে তারা। এমনকি পরিবারও নাকি গড়ে তোলে; তাদেরও সমাজ আছে; তারা নাচে, গায়, ঠিক আমাদের মানুষের মতোই।
তবে একটি বৈশিষ্ট্যের কারণেই সম্ভবত রক্তমাংসে গড়া মানুষের সাথে বাঙালি ভূতগুলোর সবচেয়ে বেশি মিল। আর সেটি হলো খাবারের প্রতি ভালোবাসা। আমাদের বাঙালিদের মতোই আমাদের ভূতগুলোও ভোজনপ্রিয়।
ভূত, পিশাচ, দৈত্যদের পছন্দের খাবারের অহরহ উদাহরণের দেখা মেলে বাঙালি লোকসংস্কৃতি এবং সাহিত্যে। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী চণ্ডীমণ্ডল কাব্যে এমন একটি বাজারের বর্ণনা দেন যেখানে পিশাচ, ভূত ও দৈত্যেরা মাংসের কেক, রক্তের মদ, মানুষের পেস্টে তৈরি চাকা আকৃতির পাউরুটির কেনাবেচা করে।
ঘাবড়ে গেলেন? ষোল শতকের এ কবি এর চেয়েও বেশি বিদঘুটে ব্যঞ্জনের বর্ণনা দিয়েছেন। নরম হাড্ডি দিয়ে ভাত, মানুষের চামড়ার রসালো পান, মানুষের মগজ দিয়ে তৈরি ঘি।
এতসব খাবারেও যদি এই অতিপ্রাকৃত ভোজনরসিকদের তৃপ্তি না মিলে, তবুও কোনো চিন্তা নেই। কারণ আরও আছে সাদা হাতির দাঁত (সাদা মূলার পরিবর্তে), ফালি করা আঙুলের নখ এবং জিহ্বার তৈরি কলা।
মুকুন্দরামের সাহিত্যে এসব ভয়ঙ্কর খাবার আমাদের মনে ভয় এবং বিতৃষ্ণা জাগাতে বাধ্য। তবে বাংলা লোকসাহিত্যের নক্ষত্র দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলিতে ভূতের ভয় আছে তবে রন্ধনশিল্প নিয়ে এমন বিস্তারিত বর্ণনা নেই। তার আইকনিক এই গল্পগুলোতে অন্যের রূপ নিতে সক্ষম রাক্ষস রাক্ষসীরা খায় ঘোড়াশালের ঘোড়া, হাতিশালার হাতি; আর মানুষদের গ্রাস করে সম্পূর্ণভাবে।
মাছের প্রতি ঝোঁক
বাঙালি ভূতের্রা বেশিরভাগই খাবারের ক্ষেত্রে সদাশয়। তাদের প্রিয় খাবার মাছ। সম্ভবত মানুষের প্রতি করুণাই তাদের এই পছন্দের কারণ। বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ মাছ ভূতেদেরও ভরনপোষণের প্রধান উৎস।
লোককাহিনী অনুসারে, একটি ভূত এতই মাছখেকো যে সে নাকি রাতের বেলা মাছ ধরার সময় হলে জেলেদের পিছু পিছু যেত। সুযোগ পেলেই তাদের ওপর হামলা করত আর মাছ আদায় করে নিত। এই ভূতের নাম মেছো ভূত।
কিন্তু মেছো ভূতের মাছ প্রেম হেরে যায় নারী ভূতের মাছ প্রেমের কাছে। পেত্নির কথাই ধরুন। পেত্নি হলো অবিবাহিত অথবা বিধবা কোনো নারীর ভূত। ভয়ঙ্কর এই পেত্নি গ্রামের সহজ সরল মানুষদের বাজার থেকে আসার সময় কীভাবে মাছ নিয়ে বিরক্ত করে এ নিয়ে অনেক গল্প আছে।
প্রথমে সে তাদের মাছ দিতে অনুরোধ করে। এতে কাজ না হলে তার অনুরোধ সরাসরি হুমকির রূপ নেয়। প্রাণের মায়ায় অনেকে মাছ দিতে বাধ্য হয়।
পেত্নিদের আপাতদৃষ্টিতে 'কুটনী মহিলা' মনে হলেও এর রূপকটি কিন্তু বেশ ভাবায়। মাছের প্রতি তার যে আকর্ষণ তা তার পূর্ব জীবনের (মৃত্যুর আগে) অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার রূপক। এ অঞ্চলের জেন্ডারবৈষম্যকে তুলে ধরে মাছের প্রতি তার এই প্রেম। একজন নারী খাবার থেকে বঞ্চিত হতেন, বিশেষ করে মাছ, তার প্রতিচ্ছবি এটি।
বাঙালি নারীদের অনেকে খুব অল্প বয়সেই বিধবা হতেন। তাদের রসুইঘরে মাছ রান্না নিষিদ্ধ ছিল। মাছ খেতে বঞ্চিত হওয়ার গল্পই পেত্নীর মাধ্যমে উপস্থাপিত।
উদাহরণস্বরূপ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁর বই গয়নার বাক্স-র পিসিমার কথাই ধরা যাক। অল্প বয়সে বিধবা হওয়ায় ছোট থাকতেই মাছ খাওয়া ছাড়তে হয়েছিল তাকে। মরার পর ভূত হয়ে পিসিমা সেই মাছের গন্ধেই ছুটে আসতেন।
প্রকৃতপক্ষে, মানুষের চাহিদাই রূপকথা এবং কিংবদন্তিতে ভোজনপ্রিয় অতিপ্রাকৃত ভূতের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে।
আরেক মাছপ্রিয় ভূত হলো শঙ্খচূর্ণী। যাকে শাঁকচুন্নিও বলা হয়। শাঁকচুন্নি তার জীবিত অবস্থার বিবাহিত জীবনে ফিরে যেতে চায়। তার গল্পে মাছের চেয়ে প্রাধান্য পায় মৃত্যু এবং ঘনিষ্ঠতা। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলায় স্বামীর স্বাস্থ্য ও জীবনের গুরুত্ব বোঝাতে বিবাহিত নারীদের মাছ খাওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। মাছের প্রতি শাঁকচুন্নির আকাঙ্ক্ষা তার বিবাহিত জীবন ফিরে পাওয়াকেই প্রতিফলিত করে।
তো শাঁকচুন্নি এবং তার জাতকরা কী ধরনের মাছ পছন্দ করে? উপকথা এর উত্তরে একটু বিভক্ত। কেউ বলে সে কাঁচা খেতে পছন্দ করে, অন্যরা বলে ভাজা বা পোড়া। আবার কেউ কেউ বেশ জোর দিয়ে বলে যে তারা পঁচা এবং দুর্গন্ধ মাছগুলোই চায়।
তারা কোনটা বেশি পছন্দ করে সেটি বোধয় 'ভূতের জাতের' ওপর নির্ভর করে।
অতিপ্রাকৃত জগতে জাতপ্রথা
আমাদের বাস্তব জগতের মতো অতিপ্রাকৃত জগতের সামাজিক কাঠামোতেও জাতপ্রথা বিদ্যমান।
যেমন, এক মৃত ব্রাহ্মণের ভূত ব্রহ্মাদিত্য। তাকে প্রায়শই সম্মানিত, পাণ্ডিত্যপূর্ণ এবং পরিপাটি হিসেবে বর্ণনা করা হয়। বাস্তব জগতে ব্রাহ্মণ যেমন সবার উঁচু জাত, ভূতের জগতেও তাই ব্রহ্মাদিত্য জাতপ্রথার শীর্ষে অবস্থান করে।
আর যে ভূতেরা পালমিরা গাছের সমান লম্বা, গড়ন পাতলা, দেখতে কৃষ্ণবর্ণের এবং যারা ভাতসহ সব ধরনের খাবার খায়, তারা ক্ষত্রীয়, বৈশ্য এবং শূদ্রদের আত্মা- এমনটাই লিখেছিলেন রেভারেন্ড লালবিহারী দে তার ১৮৭৪ সালে লেখা গোবিন্দ সমন্ত বইয়ে।
তিনি লেখেন, 'অন্যান্য ভূতের মতো ব্রহ্মাদিত্য সব ধরনের খাবার খেত না। খেত শুধু সে খাবারগুলো যেগুলো ধর্মের দৃষ্টিতে শুদ্ধ।'
তবে তারাদাস বন্দোপাধ্যায়ের ভূতেরা এখন বইয়ের চিত্রটি পুরোপুরি ভিন্ন। এই গল্পে দেখা যায়, একজন সুবিধাবঞ্চিত নারীর ভূত পঁচা মাছ খেতে চাওয়ায় তার ভূত ছেলেকে তিরস্কার করে। কারণ পচা মাছ ছিল ব্রাহ্মণাদিত্যের মতো উঁচু শ্রেণীর খাবার।
অন্যান্য গল্পে পাওয়া যায় আরও অনেক খাবারের যা ভূতেদের পছন্দ ছিল। যেমন, গুগলি, শামুক; উভয়ই মনুষ্য জগতের দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের সাথে সম্পৃক্ত।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর কুজো ও ভূত-এর কেন্দ্রবিন্দুতেও বাঙালি ভূতেদের অদ্ভূত রন্ধনশৈলীর বর্ণনা আছে। বিচিত্রবর্ণধারী এই ভূতগুলো হিং এর জঘন্য ঘ্রাণ, তেঁতুলের মুখ মোচকানো টক, রসুনের তীক্ষ্ণ ঘ্রাণ, গোলমরিচের ঝাল এবং শুটকির কড়া ঘ্রাণ পছন্দ করে। কিন্তু আবার কাঁচাগোল্লা, টাটকা ছানা দিয়ে তৈরি মুখে দেওয়ামাত্র গলে যায় এমন মিষ্টি, এসব খাবারে বিরক্ত হয়।
উপেন্দ্রর তৈরি বিশ্বে দেখা যায়, মানুষেরা যে খাবারগুলো তাচ্ছিল্য করে ভূতেরা সেগুলোই পছন্দ করে। যেমন মিষ্টির বদলে তারা ভালোবাসে নোনা, করা ঘ্রাণযুক্ত, গন্ধকপূর্ণ, কয়টুগন্ধযুক্ত খাবার। এই বৈশিষ্ট্যটি অতিপ্রাকৃত জগতের পরিবর্তিত বাস্তবতাকে প্রতিনিধিত্ব করে এবং জীবিত থেকে অপার্থিব জগতকে পৃথক করে।
তারাদাসের ভূত পুরাণে দেখা যায়, একটি শরীরবিহীন কন্ঠের দ্বারা নিহত হয়ে, রমায়ী ভট্টাচার্য যখন ভূত হয়ে যায়, তার কল্কে ফুল এবং জলন্ত ফায়ারফাইকস থেকে তৈরি মধুর জন্য অতৃপ্ত ক্ষুধা তৈরি হয়। মিঠাই, মালপুয়া, মনোহরার মতো মিষ্টি আর তার আগ্রহ ধরে রাখতে পারেনা।
ভোজনপ্রিয় ভূতের সবচেয়ে মর্মান্তিক গল্পগুলো লিখেছেন লীলা মজুমদার, তেপান্তরের পাড়ের বাড়িতে। এই গল্পে একজন বাড়ির মালিক নোটে ও গুরু নামে দুই যুবককে ভাড়া করেন তার বাড়িতে থাকতে। তার এই পৈতৃক বাড়িটি ভুতুরে বলে কুখ্যাত ছিল। তাই বাড়িতে যে ভূত নেই তা স্থানীয়দের কাছে প্রমাণ করতে ওই দুই যুবককে ভাড়া করে মালিক। তার ইচ্ছা ছিল তিনি স্থানীয় একটি সংস্থার কাছে বাড়িটি বিক্রি করে গৃহহীনদের জন্য আশ্রম বানাবেন। আর বিনিময়ে নোটে ও গুরু পাবেন ১৫ লাখ রুপি এবং সাথে খাবারের আয়োজনে থাকবে কচুরি, আলু চাট, কাঁচকলার আচার, জিভে গজা এবং লেবুর রস।
কিন্তু বাড়িটিতে থাকার সময় নোটে ও গুরু পড়েন মহাবিপদে। কারণ বাড়িটি ছিল গৃহহীন উদ্বাস্তু শিশুদের ভূতে ভরপুর। এই ভূতগুলো নোটে-গুরুর সব খাবার গোগ্রাসে গিলে ফেলে। তবুও তাদের তৃপ্তি মেলে না। কারণ তাদের চাই গরম গরম ভাত, ঠিক গ্রাম বাংলার বাঙালির মতো। তবে যা-ই হোক, হাতে পাওয়া খাবারের জন্য ভূতেরা কৃতজ্ঞ ছিল। ফলে তারা বাড়িটি খালি করতে রাজি হয়ে যায়। কিন্তু শর্ত একটাই; গৃহহীন অনাথদের জন্য প্রত্যেকদিন গরম গরম ভাত রেঁধে দিতে হবে।
- সূত্র: স্ক্রল ডটইন থেকে অনূদিত