ধর্ষণ মামলায় ভুক্তভোগীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন নয়: বড় প্রাপ্তি এই সংশোধনী আইন
উনিশ বছরের মেয়ে সায়মা কলেজের বন্ধুদের সাথে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে ফেরার পথে ৪ জন 'বন্ধু'র দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হন। অপরাধীরা তাকে আহত অবস্থায় পথের পাশে ফেলে চলে যায়। পুলিশ মেয়েটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা দেয়। মেয়েটির অভিভাবক অপরাধীদের চেনা সত্ত্বেও কোনরকম মামলা করতে রাজি ছিলেন না, শুধুমাত্র আদালতে নানাভাবে তার মেয়েকে অপদস্ত করা হবে, এই ভয়ে। এমনকি তিনি কোন গণমাধ্যমের কাছেও মুখ খুলতে রাজি হননি। মেয়েটির মা মেয়েকে নিয়ে পালিয়েও যেতে চেয়েছিলেন।
এই ঘটনার মতো আরো বহু ঘটনা আছে যেগুলো দেখে বোঝা যায়, একজন রেপ ভিকটিম ও তার পরিবারের কাছে 'সাক্ষ্য আইন' এতটাই মারাত্মক অভিশাপের মতো যে, তারা অপরাধীকে চেনা সত্ত্বেও বিচার না চেয়ে, নিজেরাই পালিয়ে যেতে চাইছেন।
এরকম একটি সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে গত ৩ নভেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে যখন "ধর্ষণ মামলায় ভুক্তভোগীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না" আইনটি পাশ হয়, তখন সেটি একজন রেপ ভিকটিম বা ধর্ষণের শিকার নারী, তার পরিবার ও নারী অধিকার সংগঠনগুলোর কাছে অনেক বড় আশীর্বাদ হয়েই আসে। সাক্ষ্য আইনের এই সংশোধনী পাস করার মাধ্যমে সরকার নিঃসন্দেহে অসংখ্য নিগৃহীত মানুষের মর্যাদা রক্ষা করেছেন। সরকারকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানাই।
'আদালতের অনুমতি ছাড়া ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টা মামলায় জেরার সময় ভুক্তভোগীকে তার চরিত্র ও অতীত যৌন আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না', এমন বিধান যুক্ত করে ঔপনিবেশিক আমলের সাক্ষ্য আইনের সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। এছাড়া বিচারকাজে বিভিন্ন ডিজিটাল তথ্যকেও সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ এই আইনে যোগ করা হয়েছে। এসব বিধান যুক্ত করে 'এভিডেন্স অ্যাক্ট ১৮৭২ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২২' জাতীয় সংসদে কণ্ঠভোটে পাস হয়েছে।
একজন নারী যখন ধর্ষণের শিকার হয়ে থানাতে যান বা আইনের দ্বারস্থ হন, তখন তাকে ভয়াবহরকম ট্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তার হেনস্তার কোন শেষ থাকেনা। এই সাক্ষ্য আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে পুরো ব্যবস্থার মধ্যেই বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে বলে আমরা আশা করছি।
এই সংশোধনী পাস হওয়ার ফলে বিদ্যমান সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা বাতিল হবে। ওই ধারায় বলা হয়েছে, "কোনো ব্যক্তি যখন ধর্ষণ কিংবা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্র।" আমরা দেখি যে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির মামলা আদালতে উঠলে আইনজীবিরা সবার আগে রেপ ভিকটিমকে দুশ্চরিত্র প্রমাণ করার চেষ্টা করেন।
বিলে ক্রস এক্সামিনেশন বা জেরার সময় প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে নতুন বিধান যুক্ত করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টা মামলার ভিকটিমকে তার নৈতিক চরিত্র বা অতীত যৌন আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না। ন্যায়বিচারের স্বার্থে যদি আদালত মনে করেন এ ধরনের প্রশ্ন করা প্রয়োজন, তাহলে আদালতের অনুমতি নিয়েই কেবল তা করা যাবে।
কয়েকবছর আগে এডভোকেট সালমা আলী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন-সংক্রান্ত একটি মামলায় হাইকোর্ট এক রায়ে বলেছেন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়া পারিপার্শ্বিক বিবেচনায় ধর্ষণ মামলায় আসামিকে সাজা দেওয়া যাবে। ধর্ষণের প্রমাণ হিসেবে মেডিকেল রিপোর্ট না থাকলেও ধর্ষণের অভিযোগ যে মিথ্যা ছিল, তা বলা যাবে না। সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে উচ্চ আদালতের এই রায় ছিল যুগান্তকারী।
কাজেই ৭২ ঘণ্টা পর মেডিক্যাল টেস্ট করা হলে ধর্ষণের আলামত পাওয়া না গেলেও কিন্তু মামলা চলতে পারে। তাই ৭২ ঘণ্টা পর যাতে কোন মামলা না নেওয়া হয় সেই মর্মে যে আদেশ দেয়া হয়েছে, তা ভিকটিমকে আরো অসহায় করে তুলতে পারে।
মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা দীর্ঘদিন ধরে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এই ঔপনিবেশিক আইন সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এছাড়া সাক্ষ্য আইনের বিভিন্ন ধারা সংশোধন ও নতুন ধারা যুক্ত করে মামলার বিচারে ডিজিটাল তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপনেরও সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কেউ যাতে ভুয়া বা জাল সাক্ষ্যপ্রমাণ ডিজিটাল মাধ্যমে হাজির করতে না পারে সেটি নিশ্চিতে আদালত যদি মনে করেন যে কোথাও আপত্তিকর কিছু আছে অথবা কেউ যদি আপত্তি তোলে, তাহলে ওই সাক্ষ্য- প্রমাণের ফরেনসিক পরীক্ষা করা যাবে।
আমরা দেখেছি ধর্ষকের পক্ষে প্রচলিত ধারণা বা কুযুক্তিগুলো হচ্ছে, নারীরা সবসময় ধর্ষণ নিয়ে মিথ্যাচার করে, কারণ তারা যৌনক্রিয়া করে অপরাধবোধে ভোগে বা তারা আলোচিত হতে চায়। আরেকটি হচ্ছে কেউ যদি চিৎকার না করে বা আক্রমণকারীকে আঘাত না করে বা তার সঙ্গে ধস্তাধস্তি না করে, তবে এটা ধর্ষণ হবে না। কিন্তু আইনানুগ নিয়ম হচ্ছে, যৌনক্রিয়ার ক্ষেত্রে সবসময় অবশ্যই সঙ্গীর সম্মতি লাগবে। যেকোনো ধরণের সম্পর্কে থাকা অবস্থাতেও ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতন অপরাধ।
এতদিন ধরে ধর্ষণ মামলায় দেখানো হয়েছে, ভিকটিম মন্দ স্বভাবের মেয়ে, তাই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তাহলে বলতে হয়, দেহ বিক্রি করাই যার পেশা, অর্থাৎ যৌনকর্মী, তাকেও কি ধর্ষণ করার অধিকার কারো আছে? নাকি বিচার চাইতে গেলে আদালতে দাঁড়িয়ে তাকে হেনস্তা করা যায়? পয়সার বিনিময়ে শরীর বিক্রি করলেও যৌনকর্মীর অধিকার আছে, তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কিছু না করার।
কেন ধর্ষণ মামলার বিচারে দেরি হয় এবং অপরাধী কিভাবে বের হয়ে আসে, এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে অনেককিছু পাওয়া গেলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, থানা পুলিশ এবং বিচার প্রক্রিয়ায় ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারীকেই নানাভাবে দোষারোপ করা হয় (সূত্র: মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন)।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন কর্তৃক ২০১৪ সালে প্রকাশিত Landmark Judgements on Violence against Women of Bangladesh, India and Pakistan শীর্ষক বইটিতে বিচারপতি গোলাম রাব্বানী মন্তব্য করেছিলেন যে, বিচারের সময় একজন রেপ ভিকটিমের মুখের কথাকে গুরুত্ব দিতে হবে। সেইসাথে গুরুত্ব দিতে হবে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণাদিকে। ধর্ষণ এমন একটি অপরাধ যা শুধু ভিকটিমকে নয়, পুরো সমাজকে আঘাত করে।
যে মেয়েটি বা ছেলেটি যৌন নিপীড়ণের শিকার হচ্ছে, সে বা তার পরিবারই জানে কিসের মধ্যে দিয়ে তাদের যেতে হয়। পরিবার, সমাজ, আদালত, রাষ্ট্র সবক্ষেত্রে তারা নিগৃহীত হন। আর সবচেয়ে বড় নিগ্রহ ঘটে আদালতে এই প্রশ্নোত্তর পর্বে।
বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার নারীর মধ্যে শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। অক্টোবর মাসে এ দেশে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৭১ জন নারী ও শিশু। এদের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬৭ জন। আর এই ৬৭ জনের মধ্যে মেয়েশিশু ৪৮ ও নারীর সংখ্যা ১৯ (বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ)। ১২ জন মেয়ে ও ১০ জন নারীসহ দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ২২ জন।
একবার শুধু ভাবুন, এই শিশুরা আদালতে দাঁড়িয়ে অপমান ও লজ্জার কথা কিভাবে বলতে পারবে? তারা কি আদৌ কিছু বুঝবে? আর বলতে পারবে না বলেই অধিকাংশ রেপ কেসে অপরাধী আইনের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আসে।
ভিকটিমকে হেনস্তার একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে বনানীর রেইনট্রি হোটেলের ঘটনা। এ হোটেলে আপন জুয়েলার্স এর মালিকের ছেলেসহ তার সঙ্গীরা ধর্ষণের অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে যে বিজ্ঞ বিচারক মনে করেন --- "দুই তরুণী যৌনক্রিয়ায় অভ্যস্ত ছিলেন। এটা কোন আলোচিত মামলা না, অন্য সব সাধারণ মামলার মতোই এটা। যেহেতু তারা রেগুলার যৌনক্রিয়ার সাথে যুক্ত ছিলেন, সুতরাং এখানে কোন ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি।"
মেডিকেল রিপোর্টে ফোর্সফুল সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সের আলামত পাওয়া যায়নি। তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উইমেন সাপোর্ট এন্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের (ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টার) পরিদর্শক চার্জশিট দাখিল করে আদালতের পাবলিক টাইম (৯৪ কার্যদিবস) নষ্ট করেছেন।
রেইনট্রি মামলার রায়ে আসামিরা 'নিরপরাধ' প্রমাণিত হয়েছে। পাশাপাশি ভুক্তভোগীরা অপরাধী প্রমাণিত হয়েছেন কারণ, তারা এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন যাতে ধর্ষণ সংঘটিত হয়। মাননীয় বিচারক ধারণা করেন যে, 'পার্টিতে আসা, নাচা, সাঁতার কাটা' মানেই যৌন মিলনের জন্য সম্মতি দেওয়া। (সূত্র: মাহমুজ আনাম, সম্পাদক, দি ডেইলি স্টার)।
এই রায়ের পরে জানতে ইচ্ছা করছে নিয়মিত সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সের অভিজ্ঞতা যার আছে, তিনি কি ধর্ষণের শিকার হতে বা অভিযোগ করতে পারেন না?
এই ঘটনার সাথে খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ কানাডার আরেকটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। বন্ধুদের সঙ্গে পার্টিতে গিয়ে আরেক বন্ধু কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হওয়া ১৯ বছরের এক তরুণী যখন বিচার চাইতে আদালতের শরণাপন্ন হন, তখন খোদ বিচারক বলেছিলেন, "এই মেয়ে, তুমি তোমার দুই হাঁটু একসাথে চেপে রাখতে পারলে না?"
বিচারকার্য পরিচালনার সময় প্রিসাইডিং জাজ হিসেবে দায়িত্বপালনরত অবস্থায় রবিন ক্যাম্প এই কথাগুলো বলেছিলেন ধর্ষণের শিকার মেয়েটির উদ্দেশ্যে এবং রায়ে তিনি অভিযুক্তকে খালাস দেন।
ঘটনাটা ২০১৪ সালের, কানাডার আলবার্টার প্রভিন্সিয়াল আদালতের। পরে অবশ্য আপিলে তার এই রায় বাতিল হয়ে যায় এবং নতুন করে বিচারের নির্দেশ হয়। নতুন বিচারেও অভিযুক্ত খালাস পায় এবং আদালত অভিযোগকারীকে 'ইনকনসিস্টেন্ট এবং নট ক্রেডিবল' বলে মন্তব্য করে।
কিন্তু রবিন ক্যাম্পের 'ধর্ষণ ঠেকাতে হাঁটু চেপে রাখার' তত্ত্বের কারণে তিনি এখনো 'knees together judge' হিসেবে পরিচিত (সূত্র: সওগাত আলী সাগর, সাংবাদিক)। 'আদালত স্বাধীন এবং নিরপেক্ষভাবে মর্যাদার সাথে কাজ করে বলে সাধারণ মানুষের মনে যে বিশ্বাস রয়েছে' সেই বিশ্বাসকে মর্যাদা দিতে রবিন ক্যাম্পের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।
নারী, কিশোর-কিশোরী বা শিশু ধর্ষণের শিকার হলে প্রথমেই মানসিক ও শারীরিকভাবে ট্রমায় চলে যান। আমাদের দেশে সামাজিক অবস্থায় একজন ভিকটিম বা ভিকটিমের পরিবারকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনার পর নানা ধরনের ট্যাবু ও সিদ্ধান্তহীনতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। আদালতে দাঁড়িয়ে মেয়েকে কি প্রকাশ্যে এবং প্রশ্নবাণে আবারও ধর্ষণের শিকার হতে হবে কিনা, এটাই সবচেয়ে বড় ট্রমা ছিল ভিকটিম ও তার পরিবারের জন্য।
"ধর্ষণ মামলায় ভুক্তভোগীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না" বলে যে আইন পাশ হয়েছে, সেই আইন অবশ্যই একটি ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারীর সম্মান ও মরযাদা রক্ষার ও বিচারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে।
- লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন