যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক রেট বৃদ্ধি কি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে?
যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশ পলিসি রেট বাড়ালে তার গভীর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের মতো তুলনামূলক দূর্বল অর্থনীতির দেশগুলোতে।
ডলার ও পাউন্ড শক্তিশালি হওয়ার কারণে কমে যেতে পারে দেশের রপ্তানি, রেমিট্যান্স, এফডিআই ও ট্রেড ফাইন্যান্স।
অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও এক্সপোর্টাররা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে আমাদের ডলার ব্যয় বাড়বে। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে অর্থনীতি আরো সংকটে পড়ে যেতে পারে।
১৯৮৯ সালের পর গত ৩৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় জাম্প দিয়েছে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের ইন্টারেস্ট রেট। বৃহস্পতিবার ব্যাংকটি তাদের পলিসি রেট ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ২.২৫% থেকে ৩% করেছে; তাদের প্রধান লেন্ডিং রেটে টানা অষ্টম বৃদ্ধি এটি।
আগের দিন বুধবার যুক্তরাষ্ট্র তাদের সেন্ট্রাল ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভও তাদের ইন্টারেস্ট রেট ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, সাধারণত কোনো দেশ যখন ইনফ্লেশন কন্ট্রোল করতে কন্ট্রাকশনারি মনেটারি পলিসি ফলো করে তখন তারা পলিসি রেট বাড়িয়ে দেয়। এই বাড়তি রেট সেই দেশের কারেন্সিকে কস্টলি করে দেয়, ঋণের সুদ বাড়িয়ে দেয়।
পলিসি রেট বাড়ানোর আরেকটি উদ্দেশ্য হলো জনগণকে ঋণ না নিতে উদ্বুদ্ধ করা এবং ব্যয় সংকোচন করতে বাধ্য করা।
আবার ঋণ কম নেওয়া হলে ইনভেস্টমেন্ট ও কর্মসংস্থান কম হয়। এছাড়া জনগণের পার্চেসিং পাওয়ার বা ক্রয়ক্ষমতাও কমে যায়। ফলে তারা জিনিসপত্র কম কেনে, ব্যয় কম করে। এতে করে ইকনোমিক স্লোডাউন হয়।
ইন্টারেস্ট রেট বাড়ানোর প্রভাবে বাংলাদেশে ডলারের দাম বেড়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদেরা। তাদের মতে, ডলারের চাহিদা বেড়ে যাবে সুদব্যয় সহ অন্য ব্যয় বাড়ার কারণে।
আবার অন্যদিকে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমার কারণে ডলারের ইনফ্লো কমে যাবে। ফলে ডলারের দাম বাড়বে।
তবে, ফেডের ইন্টারেস্ট বাড়ার পরদিনই যুক্তরাজ্যের সেন্ট্রাল ব্যাংক ইন্টারেস্ট রেট বাড়ানোর কারণে ডলারের দাম খুব বেশি নাও বাড়তে পারে বলে মন্তব্য করেছেন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ঢাকা অফিসের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।
এছাড়া এফডিআই-এ এই রেট প্রভাব ফেলতে পারে। আগের অর্থবছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে আমাদের নেট এফডিআই গ্রোথ ৩৭% এর বেশি। দেশ দুটি তাদের পলিসি রেট বাড়ানোর কারণে এই গ্রোথ কিছুটা কমতে পারে বলে ধারণা করছেন অর্থনীতিবিদেরা।
কমতে পারে রপ্তানি
কন্ট্রাকশনারি পলিসির কারণে জনগণের পার্চেসিং পাওয়ার কমলে তারা ব্যয় কমাবে, এটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের রপ্তানিখাত গার্মেন্টস ও আরএমজি নির্ভর হওয়ার কারণে সেটি আমাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও এক্সপোর্টাররা।
বৈদেশিক ঋণের সুদহার বাড়বে, ফলে বাড়বে ডলার ব্যয়
আমাদের দেশে যেসব বৈদেশিক ঋণ আসে তার একটা অংশ আসে ভেরিয়েবল ইন্টারেস্ট রেটে। ফলে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের পর বাজারে থাকা সুদহারের সঙ্গে এসব ঋণের সুদহার সমন্বয় করা হয়।
ফলে রিনিউ করা ঋণগুলোর ক্ষেত্রে বাড়তি সুদের চাপ নিতে হবে দেশের অর্থনীতিকে।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হাসান বলেন, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের বেশ কিছু ঋণ ভেরিয়েবল।
এর অর্থ হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে সুদহার বাড়লে এসব ঋণের সুদহার বাড়ে। এক্ষেত্রে এসব ঋণ যদি আমাদের রিনিউ করতে হয়, বাড়তি সুদ দিতে হবে।
আঘাত আসতে পারে রেমিট্যান্সে
ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর অ্যান্ড্রু বেইলি সতর্ক করেছিলেন, আগামী দুই বছর তাদের দেশ রেকর্ড দীর্ঘসময় পর্যন্ত রিসেশনে থাকতে পারে।
এর ফলে বর্তমানে গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকা যুক্তরাজ্যের বেকারত্বের হার ৬.৫% ছাড়িয়ে যেতে পারে।
সেখানে বেকারত্ব বাড়লে আমাদের রেমিট্যান্স আসা কমতে পারে বলে ধারণা করছেন ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সাবেক লিড ইকনোমিস্ট জাহিদ হাসান।
তিনি বলেন, "যুক্তরাজ্য থেকে আমাদের দেশে যেসব রেমিট্যান্স আসে, তার একটি বড় অংশই পাঠান সে দেশে রেস্টুরেন্ট ও হোটেল ব্যবসাসহ বিভিন্ন ব্যবসা চালানো বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। সেখানে রিসেশন হলে ব্যবসায়ীদের ইনকামও কমে যাবে। এর জের ধরে অনেকেই চাকরি হারাতে পারেন। ফলে রেমিট্যান্স কমে যেতে পারে।"
তবে ইউএসএ থেকে যে রেমিট্যান্স আসে, সেটিতে ইউরোপের অনেক দেশের রেমিট্যান্স অন্তর্ভূক্ত থাকে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, "বেশ কয়েকটি দেশের রেমিট্যান্স ইউএস হয়ে আসে বলে দেশটি থেকে আসা রেমিট্যান্স বেশি দেখাচ্ছে।"
তাই এ থেকে রেমিট্যান্স আসা খুব বেশি প্রভাবিত হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী টিবিএসকে বলেন, "এই রেটগুলো বাড়ার কারণে আমাদের দেশে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য দেশের প্রবাসীদের ওয়েজ আর্নার্স বন্ডের মতো যেসব ডলার ডিপোজিট আছে, সেটি কমে যেতে পারে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমার দিকে থাকার কারণে অনেকে ডিমোটিভেটেড হতে পারে বাংলাদেশে ডিপোজিট রাখতে।"
তিনি আরো বলেন, "রেমিট্যান্সে ইনসেনটিভ বাড়াতে পারলে দেশের জন্য ভালো হবে। এছাড়া আমাদের কিছু প্রচারণারও প্রয়োজন আছে। রেমিট্যান্স যে আমাদের দেশে ট্যাক্স ফ্রি, এটি অনেকেই জানে না। এই ধরনের প্রচারণা বাড়াতে পারলে রেমিট্যান্স বাড়বে।"
ট্রেড ফাইন্যান্স ও ডেফার এলসিতে সুদ ব্যয় বাড়বে
জাহিদ হোসেন বলেন, "ফেডের ইন্টারেস্ট রেট বাড়লে সিকিওর্ড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (এসওএফআর) রেট বাড়ে।
তিনি বলেন, "আমরা দীর্ঘমেয়াদী ঋণ না পেলেও আমাদের ব্যাংকগুলো বিদেশি যেসব ব্যাংক থেকে শর্ট টার্ম যেসব লোন নেয়, এসব লোনের সুদের হার নির্ধারিত হয় এসওএফআর রেটের উপর ভিত্তি করে। ফেডের রেট বাড়লে যেহেতু এসওএফআর রেট বেড়ে যায়, এর ফলে আমাদের ঋণ নেওয়াটাও কস্টলি হয়ে যাবে সুদের হার বেড়ে গিয়ে। ফলে ট্রেড ফাইন্যান্সের আওতায় থাকা এসব ঋণ কমতে পারে।"
কান্ট্রি রিস্ক রেটিং এর কারণে বাংলাদেশের এলসি কনফার্মেশন চার্জ বেড়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আমরা এলসির পেমেন্ট সময়মতো করতে পারছি না। অনেক ব্যাংকের কাছে ডলার না থাকার কারণে সেগুলোকে ডেফার করে দিতে হচ্ছে। এই ঘটনাগুলোর কারণে বিদেশি ব্যাংকগুলো কনফার্মেশন চার্জ বেশি চাচ্ছে। ব্যাংকগুলো এখন ডলার ক্রাইসিসে আছে।"
এই মূহুর্তে ডলারের ডিমান্ড বাড়লে ব্যাংক খাতে এর কেমন প্রভাব পড়তে পারে, জানতে চাইলে আরফান আলী বলেন, "আমাদের ডলার বরোয়িং কস্ট বেড়ে যাবে। আমাদের দেশ থেকে যেসব আমদানি এলসি খোলা হচ্ছে, সেগুলোর একটা বড় অংশই ৬ মাস থেকে ১ বছরের জন্য ডেফার করে দেওয়া হচ্ছে।"
"এসব ডেফার এলসির ডলারের উপর ইন্টারেস্ট রেট বেড়ে যাবে। এগুলো রিনিউ করার সময়ে নতুন ইন্টারেস্ট রেট আরোপ করা হবে। ফলে আমাদের এই ক্ষেত্রে সুদ ব্যয় বাড়বে, বেশি ডলার দেশের বাইরে চলে যাবে। এটি দেশের আমদানিও কিছুটা কমাবে," বলেন তিনি।
এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় এক্সপোর্ট কম্পিটিটিভনেসকে আরো বাড়ানোর প্রতি জোর দিয়ে অভিজ্ঞ এ ব্যাংকার বলেন, "আমাদের ইন্টার্নাল কনজাম্পশন ও গ্রোথ ভালো আছে, তবে এক্সটার্নাল ট্রেডে কিছুটা চাপ পড়বে। এছাড়া আমাদের ইমপোর্ট ডিপেন্ডেন্সি যদি কোনোভাবে কমানো যায়, সেটিও আমাদের জন্য ভালো হবে।"
"সেইসঙ্গে আমাদের ব্যয় সংকোচনের দিকেও যেতে হবে। বড় বড় যেসব প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে ইমপোর্ট করা লাগে, সেগুলো এই মূহুর্তে স্লো-ডাউন করে রাখা ভালো," যোগ করেন তিনি।