লক্ষ্মী রানী: ব্যতিক্রমী পেশায় ব্যতিক্রমী যিনি
বাড়ি থেকে সমর্থন ছিল না, সাথে সমাজের মানুষের গঞ্জনা। সবকিছু ছাপিয়েই নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন দিনাজপুরের বিরলের লক্ষ্মী রানী শর্মা। পেশায় তিনি কসাই, পুরুষবাচক এই শব্দটির সাথে লক্ষ্মীর নাম যেন বড্ড বেমানান। তবু লক্ষ্মী এই পেশায় থেকেই হাল ধরেছেন সংসারের, নিয়েছেন ছেলের লেখাপড়ার দায়িত্ব।
প্রতিদিন সকালে বিরল উপজেলার ৪নং শহরগ্রাম ইউনিয়নের ফুলবাড়ী হাটে তার মাংসের দোকানের ভিড় লেগেই থাকে। প্রতিদিন ৮ থেকে ১০টি খাসি কেটে সেসবের মাংস বিক্রি করেন। হাটবার অর্থাৎ রোববার ও বুধবারে পরিমাণ হয় দ্বিগুণ, কখনো কখনো তারও বেশি। একদিনে ৩১টি খাসির মাংস বিক্রি করার রেকর্ডও আছে তার। শুধু মাংস বিক্রিই নয়, খাসি জবাই, চামড়া ছাড়ানো, মাংস কাটাসহ কসাইয়ের সব দ্বায়িত্ব তিনিই পালন করেন। আর লক্ষ্মী রানীর স্বামী ঊষা দেবশর্মা বিভিন্ন হাটে ও গ্রামে ঘুরে ঘুরে খাসি কেনেন।
বছর পনের আগের কথা। লক্ষ্মীর ছেলের জন্ম সে সময়। অভাবে পড়ে নিরুপায় লক্ষ্মী রানী বিয়ের গহনা, হাঁস-মুরগী বিক্রি করে দোকান ভাড়া নিয়ে শুরু করেন খাসির মাংস বিক্রির ব্যবসা। এই ব্যবসা করেই লক্ষ্মী রানী এখন ধরেছেন সংসারের হাল। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি ও স্বামী-সন্তান নিয়ে তার সংসার। ছেলে পড়াশোনা করে ৭ম শ্রেণীতে, চার বছর বয়সী মেয়ে বাড়িতেই নিচ্ছে শিশুশিক্ষা।
লক্ষ্মী রানীর ইচ্ছা, সততা ও নিজ পায়ে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা মুগ্ধ করে এলাকার মানুষকে। তার সফলতায় যেন গর্বিত তারা। শুধু স্থানীয় নয়, দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসে তার দোকানে মাংস কিনতে। এখন অবস্থা এমন যে, আগে থেকেই সিরিয়াল দিতে হয়, অনলাইনেও হয় অর্ডার।
বিরলের দূর্গাপুর এলাকার সুভাষ চন্দ্র রায় বলেন, "এখানে খাসির মাংস বেশ ভালো। এজন্য আমরা এখানে কিনতে আসি। ওজন সঠিক ও দামও কম।"
ভাটপাড়া এলাকার সঞ্চয় রায় বলেন, "আমি এখান থেকেই মাংস ক্রয় করি। সঠিক টাকা দিয়ে সঠিক মাংস পাই। তাই এখানেই নির্ভরতা আমাদের। নারী-পুরুষ উভয়ে মিলে কাজ করলে দেশ ও সমাজের উন্নয়ন হবে। উনি নিজের সংসার চালাতে একটি পথ বেছে নিয়েছেন। ওনার এই ধরনের জীবন সংগ্রামকে আমি ধন্যবাদ জানাই।"
বাংরু নামের এক স্থানীয় ব্যক্তি বলেন, "অনেক লোক লক্ষ্মী রানীর কাছ থেকে মাংস কেনেন। বড় বিষয় হলো, গরীব-দুঃখী বা নিম্নআয়ের মানুষেরাও এখান থেকে মাংস ক্রয় করতে পারেন। এককেজি, আধাকেজি থেকে এক পোয়া, দুইশো বা একশো টাকার মাংসও বিক্রি হয় এখানে, যেন সবাই মাংস খেতে পারে।"
বাজারের মুদি ব্যবসায়ী নাঈম ইসলাম বলেন, "এখানে শুধু হিন্দুরাই নয়, মুসলমানরাও মাংস ক্রয় করেন। মুসলমানরা যে খাসির মাংস কিনবেন তা জবাই করার জন্য আলাদা লোক আছে।"
বেচাবিক্রি বেশি হওয়ায় লক্ষ্মী রানী এখন দুইজন সহকারীকে রেখেছেন দোকানে, যারা দিন হাজিরা ভিত্তিতে বেতন পান।
আলোচিত লক্ষী রানীর গল্পে মুগ্ধ স্থানীয় সংসদ সদস্য ইসমত আরা বেগম তার জন্য সাহায্যের হাত বাড়াতে চান।
ইসমত আরা বেগম বলেন, "এই ফুলবাড়ী বাজারে নারী হয়েও খাসি জবাই ও মাংস বিক্রি করেন লক্ষ্মী। আগে সংসারে অভাব ছিল, কিন্তু এখন এই ব্যবসা করে তিনি সুন্দরভাবে সংসার পরিচালনা করছেন। বাচ্চাকে পড়ালেখা করাচ্ছেন। যদি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তার কোন সহযোগিতা প্রয়োজন হয় তাহলে আমরা তা করার চেষ্টা করবো।"
প্রথমদিকে শ্বশুর-শাশুড়িরও নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবে তার সৎ সাহসে পরিবারের সবাই বুঝতে সক্ষম হয়েছে।
লক্ষ্মী রানীর দোকানের বড় বিশেষত্ব হলো, এই দোকানে ১০০ টাকারও খাসির মাংস পাওয়া যায়। যা নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাদ আর সাধ্যের মধ্যে মেলে। তার স্বামী উষা দেব শর্মা বলেন, "আমার সংসার চলতো অভাব-অনটনে। স্ত্রীর পরামর্শে এই ছাগলের মাংস বিক্রির ব্যবসা শুরু করি। প্রথম দিকে খুব কম বেচাবিক্রি হতো। আমার স্ত্রী গহনা বিক্রি ও হাঁস-মুরগী বিক্রি করে কিছু টাকা দেয়। সেই টাকা দিয়েই এখন ব্যবসা পরিচালনা করছি। দীর্ঘ ৮ বছর ধরে ব্যবসা করছি। দূর-দুরান্ত থেকে লোকজন আসেন এখানে।"
"আমি শুধু ব্যবসাতে সততাটা রাখতে পেরেছি। আমাকে সব ধরনের সহযোগিতা করছেন আমার স্ত্রী। মূলত সে-ই দোকান চালায়। আমি গ্রামে-গঞ্জে, হাট-বাজারে ছাগল ক্রয় করে বেড়াই।"
লক্ষ্মী রানী শর্মা বলেন, "প্রথমে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি নিষেধ করেছিল। পরে তাদেরকে বলি যে সংসারের হাল ধরতে আমি শুধু স্বামীকে সহযোগিতা করতে পারি। আমি সন্তানদের পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করতে চাই। আমি একদিনে ৩১টা পর্যন্ত ছাগল জবাই করে মাংস বিক্রি করেছি।"
"আমি শুধু সততা ও পরিচ্ছন্নতাকে পুঁজি করে এই ব্যবসা পরিচালনা করি। আমার কাছে হিন্দু-মুসলমান কিংবা ধনী-গরীব নাই। আমি ১০০ টাকারও মাংস বিক্রি করি", যোগ করেন তিনি।