মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ থেকে হায়দ্রাবাদের নিজামের প্রিয় ছিল যে জুয়েলারি ব্র্যান্ড!
হংকংয়ে অনুষ্ঠিত এক নিলামে গত অক্টোবের সাত তারিখে বিক্রি হয় বিরলতম গোলাপি বর্ণের একটি হীরা। ১১ ক্যারটের এই হীরাটির নাম উইলিয়াম পিংক স্টার। নিলামকারী প্রতিষ্ঠান সদবি'জ হীরাটি পরিচয় গোপন রাখা এক ক্রেতার কাছে পাঁচ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলারে বিক্রি করে। এরপর থেকেই বিশ্বের গয়নার বাজারে শুরু হয় তোলপাড়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দরুণ বৈশ্বিক অর্থনীতি অস্থিতিশীল হওয়া স্বত্বেও ক্যারট প্রতি সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হওয়ার রেকর্ড গড়েছে গোলাপি হীরাটি। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো প্রত্যাশিত দামের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি দামে বিক্রি হয়েছে এটি।
তবে এতে মোটেও বিস্মিত নন ধ্রুব গুপ্ত নামে এক ব্যক্তি। কারণ অলঙ্কার তৈরি ধ্রুব গুপ্তর পরিবারের বহু বছরের পেশা। তাদের রয়েছে বংশ পরম্পরায় অলঙ্কারের পরিবারিক ব্যবসা। ধ্রুব বড়ই হয়েছেন মহামূল্যবান অলঙ্কার কেনাবেচার সাক্ষী হয়ে। দিল্লির সবচেয়ে পুরোনো তাদের এ দোকানের কারিগরের বানানো গহনা কিনতেন মোগল সম্রাটরা। দ্য প্রিন্টের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তাদের পারিবারিক ব্যাবসার নানা দিক।
বর্তমানে গহনা বিক্রয়কারী এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ১৮ তম প্রজন্মের উত্তরাধিকারী ধ্রুব ও তাঁর পরিবার। গহনা সম্পর্কিত বহু অবিশ্বাস্য ক্রয়-বিক্রয়ের সাক্ষী তারা। লেনদেনের খাতিরে গহনা গড়ার সুবাদে অনেক বনেদি পরিবারের কাছের মানুষও হয়ে গেছেন তারা।
ধ্রুব বলেন, 'গয়নার দোকানে গদির ওপর বসে থাকা প্রত্যেকটা দিনই যেন একটা বিস্ময়। আমরা জানি না কে জমজমাট কেনাকাটা করে যাবে আর কে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পারিবারিক গয়না নিয়ে হাজির হবে। এমনকি এই কাজের মাধ্যমে কোনো পরিবারের ভেতর কী চলছে তার খবরও পাই আমরা।'
মোগল সম্রাট শাহজাহান ১৭ শতকে দিল্লির প্রাচীনতম ও ব্যস্ত বাজার চাঁদনী চক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই বাজারেই অবস্থিত গহনার জন্য বিখ্যাত বাজার দারিবা কালান। এখানেই খুঁজে পাওয়া যাবে এখানকার সবচেয়ে পুরোনো গহনার দোকান শ্রী রাম হরি রাম (এসআরএইচআর)।
মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের বিশ্বস্ত রৌপ্য মণিকার ছিল দুইশো বছরের অধিক পুরোনো এই এসআরএইচআর। সম্রাট বাস করতেন দিল্লির লালকেল্লায় আর তাঁর প্রিয় মণিকারেরা থাকতেন পার্শ্ববর্তী চাঁদনী চক ভাকিলপুরা এলাকায়।
সেসময় কোনো রেডিমেড গয়না দোকানে প্রদর্শিত হতো না। রাজপরিবারের নারীদের জন্য গয়না বানানো হতো অর্ডার আসার পর। স্বর্ণকাররাই ছিলেন সেসব 'সৌভাগ্যবান' ব্যক্তিদের একদল যাদের জন্য অলঙ্কার বানাতে রাজকীয় নারীরা পর্দার গণ্ডি থেকে বের হতেন। তখন হাতে বানানো হতো ৩০ কিলো সলিড ব্লকের তৈরি সব রৌপ্য নূপুর, কোমরবন্ধনী ইত্যাদি অলঙ্কার।
ফ্যাশনের বিকাশের সাথে সাথে গহনায় মণিমুক্তা খচিত করার প্রচলন এল। এই পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে এসআরএইচআর-এর দক্ষ কর্মীরাও তাদের সৃষ্টিতে সোনা, পাথর এবং হীরার নানা কাজ অন্তর্ভুক্ত করল। তবে দিন বদলের এই ধারায় একটা বিষয় কিন্তু পাল্টায়নি; সেটি হলো তাদের কার্যনীতি। এক শতাব্দী আগেও তারা যেমন ক্রয়ের কোনো প্রমাণ ছাড়াই আবার তাদের পণ্য পুনরায় কিনে নিত, এখনো তারা তা-ই করে। অর্থের প্রাচুর্য থাকাকালে রাজকীয় পরিবারগুলো গহনা কিনলেও অভাবের সময় আবার বিশ্বস্ত সেকরাদের কাছে সেগুলো বিক্রি করে দিত। পাছে রাজকীয় মানসম্মান ক্ষুণ্ণ হয়- এই ভয়ে এসব লেনদেন চলত গোপনে।
আজকাল স্বর্ণকারেরা অফলাইন কিংবা অনলাইন কোনোখানেই দৃশ্যমান হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করে না। যেখানেই পারে বিজ্ঞাপনী প্রচারণা চালাতে দ্বিধা করে না তারা। কিন্তু এসআরএইচআর-এর মতো 'খানদানি' গহনা দোকানের জন্য বিচক্ষণতাই একমাত্র আদর্শ নীতিবাণী।
ষাটের দশকের সময়, তৎকালীন নিজাম একবার ধ্রুব গুপ্তের দাদা ব্রিজমোহন গুপ্তকে হায়দ্রাবাদে ডেকে পাঠান। সাধারণ স্বভাবের মিতব্যয়ী ব্যক্তি ব্রিজমোহনে ট্রেনে চেপে হায়দ্রাবাদ রাজপ্রাসাদে পৌঁছান। কোনো ভণিতা না করে নিজাম তাকে সরাসরি আঠারো শতকের প্রাচীন গহনা 'পাচ্চিকাম' কেনার অনুরোধ করেন। বড় বড় পান্না, হীরা এবং মুক্তাখচিত এই অলঙ্কারগুলো সম্রাটরা সাধারণত দরবারে জনসম্মুখে পরিধান করতেন। সম্মান প্রদর্শনপূর্বক কোনো প্রশ্ন না করেই অলঙ্কারটি কেনার অর্থ সংগ্রহ না হওয়া পর্যন্ত হায়দ্রাবাদ থেকে যান ব্রিজমোহন।
কেনার পরে তার কাঁধে ছিল আরেক ঝুঁকি। এত বড় গহনা নিয়ে কী উপায়ে দিল্লী ফিরবেন! অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলেন নিজের গলাতেই পাচ্চিকামটি পরে আসবেন। পরিকল্পনা মতো কাজ করলেন তিনি; বিশাল এই গহনাটি গলায় পরে তার ওপর মোট তিনটি জামা পরলেন। ট্রেনে সারা সময় জুড়ে নিজের জায়গায় চুপটি মেরে বসে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে যান তিনি।
ধ্রুব বলেন, 'আমার দাদার জন্য নিজামের মর্যাদাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই অনেক টাকা আটকে থাকলেও নিজামের আর্থিক দৈন্যের খবর যেন ছড়িয়ে না পরে সেজন্য কেনার কয়েক বছর পর্যন্ত পাচ্চিকামটি বিক্রি করা হয়নি।'
ব্রিজমোহনের পূত্রবধু সংগীতা গুপ্ত বলেন, 'উত্তর ভারতের মধ্যে পাটিয়ালা, জয়পুর, হোল্কার, দারভাঙ্গা, আলোয়ারের রাজপরিবারই গয়নার প্রতি সবচেয়ে অনুরাগী ছিল।
কার্টিয়ার ব্র্যান্ড যখন পাটিয়ালায় প্রথমবার আসে, রাজার সাথে পরিচয়ের জন্য সৌজন্যস্বরূপ কার্টিয়ার ছোটোখাটো এক অলঙ্কার কেনার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু তাদের যখন মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত রঙিন রত্নে ভরা কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো, তারা মুগ্ধ হয়ে একযোগে ১০০ কোটি রুপির গহনা তৈরির নির্দেশ দেন। এটিই ছিল তাদের জন্য কোনো গ্রাহকের কাছ থেকে পাওয়া সবচেয়ে বড় অর্ডার।
প্রাচীন স্বর্ণকারেরা নিজেদের বিলাসী পণ্য সরবরাহকারী হিসেবে নয়, বরং কোনো মহামূল্যবান কারুশিল্পের কারিগর ভাবতেন। খানদানি স্বর্ণালঙ্কারদের জন্য পরোপকার ছিল একটা আসক্তি। তাদের বাড়ি কত খানদানি, কত বিশাল - এসব বিষয়ের জন্য তারা পরিচিত হতেন না, বরং পরিচিত ছিলেন তারা কত ধর্মশালার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন বা মন্দিরে কী পরিমাণ দান দক্ষিণা করতেন কিংবা কত ধর্মীয় আয়োজন করতেন তার মাধ্যমে।
ব্রিজমোহন গুপ্ত ভোরের আগে ঘুম থেকে উঠে যমুনা নদীতে স্নান করেই নীল ছত্রী মন্দির দর্শনে যেতেন। জনশ্রুতি অনুসারে এ মন্দিরটি নাকি মহাভারতের দ্রৌপদী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি এই মন্দিরের আভায় এত বিমোহিত ছিলেন যে এর মূর্তিগুলো রুপার কারুকার্যে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তার দেখানো এই পথটিই দিল্লির অন্যান্য অনেক মণিকার অনুসরণ করেন।
১৯৬৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পাস করা স্বর্ণ নিয়ন্ত্রণ আইন একজন ব্যক্তি কী পরিমাণ স্বর্ণ রাখতে পারবে তার সীমা নির্ধারণ করে দেয়। ব্রিজমোহনের নেতৃত্বে দারিবার মণিকারেরা প্রকাশ্যে এই আইনের সমালোচনা করেন। পুরোনো দিল্লির বিচক্ষণ এই মণিকারের ইন্দিরা গান্ধীর এই পদক্ষেপের সমালোচনা করা সবার কাছে ছিল এক বিস্ময়কর ব্যাপার।
এর করেক মাস পরে, বিহারের এক অঞ্চল বন্যা কবলিত হয়। পাশে দাঁড়ান ব্রিজমোহন। তিনি বন্যা কবলিতদের জন্য এত খাবার, কম্বল, তাঁবু ইত্যাদি ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করেন যে সেগুলো দিয়ে পুরো একটি ট্রেইন পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এ খবর জানতে পেরে ইন্দিরা গান্ধী সব মালবাহী চার্জ মওকুফ করে দেন এবং ট্রেনটি যেন কোনো স্টেশনে থামা ব্যতীত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে তার নির্দেশ দেন। এভাবেই সরকার এবং দিল্লীর মণিকারদের মাঝে পুনরায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।