লন্ডনের ব্রিক লেন কীভাবে বাংলাদেশি সংস্কৃতি ও খাবারের জন্য পরিচিত হয়ে উঠল?
ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনের পূর্বপ্রান্তের একটি স্ট্রিট 'ব্রিক লেন'। প্রাচীন বুটিক, স্ট্রিটজুড়ে প্রাণবন্ত চিত্রকর্ম, বেকারি দোকানে ভরপুর বলে এই জায়গাটি লন্ডনবাসীর কাছে বেশ জনপ্রিয়। তবে বাঙালির কাছে এর পরিচয়টি একটু আলাদা।
সুপ্রাচীন ব্রিক লেন যুক্তরাজ্যে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালিদের কাছে এক হৃদয়ভূমি। রাস্তায় বেরোলেই চোখে পড়বে দেওয়ালে বাংলা হরফে লেখা 'মাটির টান' কিংবা ফলকে ইংরেজির পাশপাশি বাংলায় লেখা কোনো স্ট্রিটের নাম। পূর্ব লন্ডনের দক্ষিণদিকের প্রবেশমুখের ফটকে দেখা যাবে বড় হরফে লেখা 'বাংলাটাউন'।
কফি শপের বিশেষত্ব, হালের সেকন্ডহ্যান্ড স্টোর, বিলাসবহুল স্থাপনা সবকিছু মিলিয়ে অনন্য হয়ে ওঠা বাংলাটাউন নিয়ে লোনলি প্ল্যানেট-এ লিখেছেন ব্রিক লেন এলাকায় বেড়ে ওঠা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তারিক হোসাইন।
ব্রিক লেনে একটুকরো বাংলাদেশ
লন্ডনের পাতাল রেলের অলগেট ইস্ট স্টেশনে নেমে মিনিট কয়েক হাঁটলেই ব্রিক লেন। এখানে এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় বেশ কয়েক দশক ধরে প্রবাসী বাঙালিরা বসবাস করছেন। বাংলাদেশি অভিবাসী অধ্যুষিত ব্রিক লেনকে ১৯৯৭ সালে স্থানীয় কাউন্সিল 'বাংলাটাউন' বলে ঘোষণা দেয়।
রাস্তার ধারের ফলকগুলোতে ইংরেজি চিহ্নের নিচে বাংলায় লেখা নাম, বাংলাদেশি পতাকা অনুসারে ল্যাম্পপোস্টেও লাল-সবুজ রং দেওয়া। গত বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এবং লন্ডন ও সিলেটের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ বন্ধনের ওপর আলোকপাত করতে শিল্পী মোহাম্মদ আলী অ্যারোসল বাংলাটাউনের একটি দেওয়ালে আঁকেন 'মাটির টান' গ্রাফিতি।
তারিক জানান, 'ব্রিক লেনের বাঙালি সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য কেবল যে বাংলাদেশি, তা নয়। তাদের একটি বিশেষত্ব হলো তারা বাংলাদেশের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে আগত, আর সেটি হলো সিলেট।' ষাটের দশকে তারা পূর্ব লন্ডনে আসেন এবং ব্রিক লেনের আশপাশের ইহুদি মালিকানাধীন টেক্সটাইল কারখানাগুলোতে কাজ শুরু করেন।
সিলেটিরা তাদের স্থানীয় ভাষায় কথা বলে। তাই ব্রিক লেনের ভারতীয় রেস্তোরাঁগুলোতে ঢুকলে প্রায়ই শোনা যাবে সিলেটি ভাষা। তাহলে এগুলোকে ভারতীয় বলার কারণ কী? তারিক মনে করেন, 'হয়তো রেস্তোরাঁগুলো যখন বানানো হচ্ছিল তখন বাংলাদেশের জন্ম হয়নি অথবা বাংলাদেশি খাবার কী, তা কেউ জানত না।'
এসব রেস্তোরাঁয় পরিবেশিত খাবার সম্পর্কে তিনি বলেন, 'ভারতীয় খাবারগুলোর ব্রিটিশ রাজের সাথে রোমান্টিক সম্পৃক্ততা ছিল বটে, কিন্তু এগুলো খাঁটি ভারতীয় খাবার ছিল না। এগুলো ছিল একপ্রকার ইংরেজ ও ভারতীয় খাবারের মিশ্রণ। এই যেমন, চিকেন টিক্কা মাসালার মতো খাবার সম্পূর্ণ নতুনভাবে তৈরি।'
চিকেন টিক্কা মাসালা: একটি ব্রিটিশ জাতীয় খাবার
২০০১ সালে যুক্তরাজ্যের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব রবিন কুক চিকেন টিক্কা মাসালাকে 'আ ট্রু ব্রিটিশ ন্যাশনাল ডিশ', অর্থাৎ একটি প্রকৃত ব্রিটিশ জাতীয় খাবার বলে উল্লেখ করেন। খাবারটির সাফল্যে গর্বিত বাঙালি সম্প্রদায় অকৃত্রিম বাংলাদেশি রান্না প্রচারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। তারিক পর্যবেক্ষণ করে দেখেন, এসব খাবারের উত্থান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ভারতীয় রেস্তোঁরার উত্থানের সদৃশ। সেসময় সদ্য আগমনকারী অভিবাসীদের কাছে ঘরোয়া খাবার সরবরাহ করত রেস্তোরাঁগুলো।
তারিক বলেন, 'আমাদের পরিচয় এবং ঐতিহ্যের সাথে সংযোগের অন্যতম একটি উপায় হলো খাবার। এবং বিশেষ করে আমাদের মতো ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের জন্য খাবার আমাদের পরিচয়ের অংশ। চিকেন টিক্কা মাসালার মতো মিশ্র খাবার নিয়ে আমরা গর্বিত, তবে এটি আমাদের নিজস্ব খাবার নয়। সুতরাং আমাদের নিজস্ব খাবার প্রচার করে দেখি কোথায় গিয়ে পৌঁছায়।'
সেই রেস্তোরাঁগুলো কলকারখানার শ্রমিকদের বাড়ির স্বাদ চাখার সুযোগ করে দিত। কিন্তু এখনকার রেস্তোরাঁগুলোর বাঙালি ক্রেতারা প্রবাসী বাংলাদেশিদের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রজন্ম, যারা এসব খাদ্যের রন্ধনপ্রণালী সম্পর্কে জানে না অথবা আগে হয়তো কখনো খায়নি।
তারিক ব্যাখ্যা করেন, 'মাতৃভূমির প্রতি যে আবেগের টান, সেটি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এই নতুন প্রজন্ম। শুধু ভৌগোলিকভাবেই নয়, পরিচয়ের দৃষ্টিকোণ থেকেও তারা দূরে সরে যাচ্ছে।'
ব্রিক লেনের প্রিয় রেস্তোরাঁ এবং যা যা অর্ডার করা উচিত
ব্রিক লেনের রেস্তোরাঁগুলোর মধ্যে তারিকের সবচেয়ে প্রিয় হলো 'গ্রাম বাংলা'। এর প্রধান রাধুঁনি আতিকুর রহমানের ভাষায় 'আমার গ্রাম'। আতিকুর রহমান জনপ্রিয় টিভি রাধুঁনি। অতিথিদের তিনি নতুন নতুন পদ্ধতিতে খেতে উৎসাহিত করেন। সাদরে অভ্যর্থনার পাশাপাশি তার থেকে শোনা যাবে সতর্কবার্তা, 'হাত দিয়ে খাবেন কারণ মাছে কাঁটা আছে কিন্তু!'
তারিক জানান রেস্তোঁরাগুলোর মেন্যু বিশেষত সিলেটের স্থানীয় খাবার দিয়ে সমৃদ্ধ যেগুলো যুক্তরাজ্য কেন, বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিছু উপকরণের নামও হয়তো আপনি শোনেননি। এই যেমন সাতকরা, লেবুর মতো একটি ফল, বড় খোসাওয়ালা, স্বাদ তেতো।
এখানকার রাধুঁনিরা মরিচ ব্যবহারে একেবারে উদার! পশ্চিমা বিশ্বে মাছ সাধারণত কাঁটাবিহীন মাছ খাওয়া হয়। আতিকুর উদীয়মান বাজার ধরে রাখতে খাবারের ধরন কিছুটা পাল্টালেও তারিক সতর্ক করেন , 'মাছ কিন্তু মাছের মতোই থেকে যায়! এরকম গ্রামীণ খাবারে মাছে কোনো কিছুই অপচয় করা হয় না।'
মাছের তরকারিগুলো সিলেটি খাবার, যেমন সুস্বাদু বোয়াল মাছের তরকারি অথবা মসলাদার ব্রথ (ঝোল), সরিষার তেল দিয়ে আলু ভর্তা ইত্যাদি। কারি সসে সুস্বাদু ভেড়ার মাংসের চপ, জিভে জল এনে দেওয়া বেগুন, কিমা আলু, মাংস ও আলুর সুগন্ধি কিমা, আরও কত কী!
আতিকুরের ভাষায় এগুলোই 'মা রেসিপি'। 'ঠিক এ ধরনের খাবারগুলোই আপনি বাংলাদেশে পাবেন। সেখানে (বাংলাদেশে) যদি টিক্কা মাসালার কথা বলেন, তারা বলবে "ওটা আবার কী?" এই অকৃত্রিম "মায়ের রেসিপিগুলোই" আমরা অনুসরণ করে থাকি।'
তারিক বলেন, 'এগুলো খাওয়ার জন্য হয় এখানে আসতে হবে অথবা মায়েদের কাছ থেকে শিখতে হবে।'
খাবারের বাইরে আরও যা আছে দেখার মতো
রেস্তোরাঁগুলো প্রধান আকর্ষণ হলেও বাংলাটাউনে দেখার মতো আরও অনেক কিছু রয়েছে।
বাংলাটাউনে রয়েছে ব্রিক লেন মসজিদ যেটি তারিকের ভাষ্যমতে 'হাল ফ্যাশনের মিনার'। ২৯ মিটার উঁচু এই ল্যান্ডমার্কটির রং পরিবর্তনকারী এলইডি লাইট রয়েছে। তারিক বর্ণনা করেন, 'এর উত্তর আফ্রিকান জ্যামিতিক প্যাটার্ন আছে, কিন্তু লাভা ল্যাম্পের মতো রাতে হরেক রঙের লাইট জ্বলে। কোনো মিনারে এরকম দেখিনি। হাল ফ্যাশনের স্ট্রিটে বোধয় এটাই মানানসই।'
এছাড়াও আছে কবি নজরুল সেন্টার নামের একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। আশির দশক থেকে বাঙালি শিল্পকলার নিদর্শন এই কেন্দ্র বিভিন্ন প্রদর্শনী, নাটক ও ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন প্রকল্পের আয়োজন করে থাকে।
তারপর রয়েছে সানডে আপমার্কেট, যেখানে আছে লন্ডনের সবচেয়ে বড় হালাল খাবারের সমারোহ। এর বাইরে আছে ফ্লি মার্কেট যেটি ব্রিক লেনের প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রথম প্রজন্মের বড় একটি সম্পদ ছিল। তারিক বলেন, সাধ্যের মধ্যে কেনাকাটার জন্য 'আমার দেশের মানুষেরা এই মার্কেটের ওপরেই নির্ভরশীল ছিলেন। কারণ তারা যখন প্রথম এখানে আসেন তখন তাদের হাতে বলতে গেলে কোনো টাকাই ছিল না।'
বাংলাটাউনের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং রন্ধনসম্বন্ধীয় বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের বড় অবদান রয়েছে। তার পাশাপাশি তাদের কষ্ট, সংগ্রামেরও সাক্ষ্য বহন করে এলাকাটি। প্রবেশ ফটক দিয়ে ঢুকে মিনিট দুয়েক হাঁটলেই সামনে পড়বে আলতাব আলী পার্ক। যার নামানুসারে এই পার্ক, তিনি ছিলেন ২৫ বছর বয়সী এক সিলেটি টেক্সটাইল শ্রমিক। ১৯৭৮ সালে বর্ণবাদীরা তাকে হত্যা করে। এই হত্যার জের ধরে বাঙালি সম্প্রদায়ের মাঝে ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল।
পার্কটিতে রয়েছে ঢাকাস্থ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের একটি রেপ্লিকা। 'আলতাব আলীর সম্মানে প্রতিষ্ঠিত এই মিনারেই আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস পালন করতে এবং অন্যান্য শহীদের স্মরণে এখানে আসি,' জানান তারিক।
এসবই সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের অংশ যার প্রতি সম্মান জানাতে ও সংরক্ষণে বাংলাটাউন নিবেদিত। তারিক আশা করেন, ব্রিক লেনের মতো বিশ্বের আরও অনেক জায়গায় বাংলাটাউন গড়ে উঠবে। তিনি বলেন, 'এটি যেহেতু এখন আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত, আমার মতে, সময়ের সাথে সাথে এটি একটি "থিম"-এ পরিণত হবে। ঠিক যেমনটা আমরা দেখি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চায়নাটাউন গড়ে উঠেছে।'
- সূত্র: লোনলিপ্ল্যানেট ডটকম