জেড-লাইব্রেরির জন্য হাহাকার: এ সময়ের আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি
সম্প্রতি চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে জনপ্রিয় ফ্রি ই-বইয়ের সংগ্রহশালা জেড-লাইব্রেরি। এতে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থী ও বইপোকারা। অনেকে তো এই ঘটনাকে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রেট লাইব্রেরি পুড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
জেড-লাইব্রেরি: আধুনিক বইপোকাদের আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি
মহামারি ও বইপ্রেমীর সংখ্যা বাড়ার কারণে জেড-লাইব্রেরির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। এই সাইটটি শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠ্যবই ও গবেষণা নিবন্ধ পড়ার সুযোগ করে দিত।
আইনের দৃষ্টিতে এ কাজ অপরাধ হলেও যেসব পাঠকের আর্থিক সংগতি নেই, তাদের জন্য জেড-লাইব্রেরির সরবরাহ করা এসব বই ও নিবন্ধ ছিল রীতিমতো আশীর্বাদ।
এছাড়া কিছু জরিপে দেখা গেছে, যেসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার উৎস ও স্কলারলি জার্নালে সাবস্ক্রিপশন অপ্রতুল, সেখানে গবেষকরা ছায়া লাইব্রেরির ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে থাকেন।
অনলাইন আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিতে অগ্নিসংযোগ
গত সপ্তাহের শুক্রবার জেড-লাইব্রেরির ওয়েবসাইটে প্রবেশের চেষ্টা করতেই একটি লেখা ভেসে ওঠে পর্দায়। যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ওয়েবসাইটটি চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে। জেড-লাইব্রেরির সঙ্গে সম্পৃক্ত সবকটি ডোমেইনই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে সত্যিকার অর্থেই একটি যুগের অবসান হলো।
শুরুতে, ২০০৯ সালে, জেড-লাইব্রেরি ছিল ফ্রি ফাইল-শেয়ারিং ওয়েবসাইট। এরপর সেখানে বিনামূল্যে বই ও পিয়ার-রিভিউড নিবন্ধ সরবরাহ করা শুরু হয়।
নানাজনের কাছ থেকে অভিযোগ আসতে শুরু করলে প্ল্যাটফর্মটি একজন ব্যবহারকারীর প্রতিদিন সর্বোচ্চ ডাউনলোডের সংখ্যা ৫টিতে নামিয়ে আনে। তবে এর পরও লেখক-প্রকাশকরা ই-বই পাইরেসি ছড়ানোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া বন্ধ রাখেনি।
গত মাসে মার্কিন অলাভজনক সংস্থা অথরস গিল্ড ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভের কাছে অভিযোগ পাঠায়। ওই চিঠিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় দুই ওয়েবসাইট জেড-লাইব্রেরি ও লাইব্রেরি জেনেসিস-এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়।
অভিযোগপত্রে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকজন লেখকের মন্তব্যও সংযুক্ত করা হয়।
লেখক সেরিনা বাওয়েন বলেন, 'জেড-লাইব্রেরি আমাদের মেরে ফেলছে। সকালেই প্রকাশ হওয়া বইটি দুপুরের মধ্যে আপলোড হয়ে যায়। শুধু এই সাইটই আমাদের ক্ষতি করছে না, তবে এই সাইটটি বারবার টিকটকে হাজির হচ্ছে।'
জেড-লাইব্রেরির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন একদল বেনামি রোমান্স লেখকও। তাদের অভিযোগ, জেড-লাইব্রেরি বহু বছর ধরে তাদের মাথাব্যথার কারণ। কিন্তু ২০২১ সালে এ সাইটের কারণে ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কারণ এ বছর টিকটকের কল্যাণে সাইটটির প্রচারণা ফুলে-ফেঁপে ওঠে। প্রতি মাসেই কোনো না কোনো নতুন টিকটক ভিডিওর স্লোগান থাকত: 'কখনও টাকা দিয়ে বই কিনবেন না! জেড-লাইব্রেরি থেকে পেয়ে যান।'
এ সমস্যার জেরে, লেখকদের অভিযোগের পর টিকটকও #জেডলাইব্রেরি হ্যাশট্যাগ নিষিদ্ধ করে।
এর ধারাবাহিকতায় গত শুক্রবার এফবিআই বন্ধ করে দেয় জেড-লাইব্রেরি। তার সঙ্গে বেকায়দায় পড়েন সারা বিশ্বের অজস্র পাঠক।
সপ্তম শতাব্দীতে কয়েক দফার প্রচেষ্টার পর অবশেষে চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল বইপত্রের বিশাল ভান্ডার আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি। তার কয়েক দশক পর জেড-লাইব্রেরি বন্ধ করে দেওয়াও যেন আধুনিক যুগের আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি ধ্বংস করে দেওয়ার মতোই—এমনটাই দাবি অনেক পাঠক-শিক্ষার্থীর।
ফিরিয়ে আনার দাবি বইপোকাদের
আইনত জেড-লাইব্রেরির মতো ছায়া লাইব্রেরিগুলো অবৈধ হলেও, মানুষ কেন এসব লাইব্রেরির দ্বারস্থ হয়, তা-ও বুঝতে হবে আমাদের।
বহু পাঠকেরই দামি কিন্তু প্রয়োজনীয় বই ও গবেষণা নিবন্ধ কিনে পড়ার সামর্থ্য নেই। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের মতো দেশগুলোতে শিক্ষার্থী, পাঠক, গবেষকদের সামর্থ্য সীমিত। এসব দেশের পাঠকরা তাই নিরুপায় হয়েই বিনামূল্যে দামি সব বই ও গবেষণা নিবন্ধ ফ্রিতে পড়ার সুযোগ খোঁজেন। এছাড়া বইয়ের চড়া দামের সঙ্গে আছে মূল্যস্ফীতির কষাঘাত। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই নতুন বই কেনার সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলেছেন। তাদের জন্যই জেড-লাইব্রেরির মতো ছায়া লাইব্রেরিগুলো আশীর্বাদ ছিল।
বাংলাদেশের উদাহরণই দেওয়া যাক। উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ গবেষণা নিবন্ধ ও দরকারি বই-ই কেনার সুযোগ হয় না এদেশের শিক্ষার্থী, গবেষক, পাঠকদের। এক্ষেত্রে তাদের সামনে মূল বাধা আর্থিক সামর্থ্য। আবার টাকা থাকলেও অনেকসময় অনেক দুর্লভ ও প্রয়োজনীয় বই দেশে আনানোর উপায় থাকে না।
তাছাড়া শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনার জন্য অনেক বই—যেগুলো তাদের কেনার সামর্থ্য নেই—ডাউনলোড করতেন জেড-লাইব্রেরি থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মারুফ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একটি টেক্সট বই বা লেখার ওপর অনেক সমালোচকের লেখা বইপত্র ও গবেষণা নিবন্ধ পড়তে হতো মাঝে মাঝেই। কিন্তু সব বই আমাদের ডিপার্টমেন্টে বা অন্যান্য জায়গায় পাওয়া যেত না, অথচ বই বা লেখাটি দরকারি। আবার বাইরে থেকে কিনে আনানোর সামর্থ্যও আমাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই নেই।
'তাহলে আমরা কি এসব বই পড়ব না, জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হব স্রেফ আর্থিক সংগতি নেই বলে? এসব বই পড়ার অধিকার আমাদের থাকবে না? আমি তা বিশ্বাস করি না। আমার মতো শিক্ষার্থী ও গবেষক-পড়ুয়াদের জন্য তাই জেড-লাইব্রেরি ছিল আশীর্বাদ। এসব বই আমি সংগ্রহ করতাম জেড-লাইব্রেরি থেকে।
'আইনের দৃষ্টিতে জেড-লাইব্রেরির মতো ছায়া লাইব্রেরিগুলোর কাজ "অপরাধ" হলেও, আমাদের জন্য এ ধরনের অনলাইন লাইব্রেরিগুলো ছিল জ্ঞানের ভান্ডার। জেড-লাইব্রেরি আমার মতো পাঠকদের কাছে সত্যিকার অর্থেই আধুনিককালের আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি ছিল। জেড-লাইব্রেরি ফিরে এলে আমাদের জন্য খুব ভালো হতো।'
একনিষ্ঠ পাঠক সূর্য চৌধুরী। তার নিজেরও বইয়ের বিশাল সংগ্রহ আছে। কিন্তু তারপরও জেড-লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আক্ষেপ পিছু ছাড়ছে তার। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'জেড-লাইব্রেরি বন্ধ করে দেওয়াটা সপ্তম শতকে বইয়ের বিশাল উৎস আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করে দেওয়ার মতোই শোকাবহ ঘটনা।'
জেড-লাইব্রেরি বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী সুজন সেন গুপ্ত বলেন, 'অ্যাকাডেমিক বই, জার্নাল, আর্টিকেলের জন্য জেড-লাইব্রেরি আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের কাছে আশীর্বাদের মতো ছিল। একটা দুর্লভ বই খুঁজে পাওয়ার যে আনন্দ, তা সবাই অনুধাবন করতে পারবে না।
'পাইরেসির নৈতিক সংকটের বিষয়টা আমরাও বুঝতে পারি, কিন্তু আমাদের পক্ষে তো বইপত্র সবসময় নিয়মমাফিক সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। জেড-লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন মনে হচ্ছে, আমাদেরকে এরপর থেকে সীমাবদ্ধ জ্ঞানভান্ডার নিয়ে অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা করতে হবে।'
জেড-লাইব্রেরির পাইরেটেড বই ডাউনলোড করে পড়া 'বেআইনি' হলেও যারা এসব বই ফ্রিতে ডাউনলোড করে পড়েন তারা পরে এসব বইয়ের প্রচারণাও চালান। এছাড়া তারা সাধ্যমতো নতুন বই কেনেনও। কোনো ই-বই পড়ে ভালো লাগলে সেগুলোর হার্ড কপি কেনেন।
এছাড়া বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর স্থানীয় বইয়ের দোকানে কিছু আন্তর্জাতিক প্রকাশকের বই পাওয়া দুরূহ। এ কারণে অনেক বইপ্রেমী বাধ্য হয়ে অনলাইন থেকে ফ্রি ই-বই ডাউনলোড করেন।
এছাড়া বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে পাবলিক লাইব্রেরির সংখ্যাও খুবই কম। এ কারণে লাইব্রেরিতে গিয়ে যে দরকারি বইটি পড়ে নেবেন, বেশিরভাগ সময় পাঠকদের সামনে সে উপায়ও থাকে না।
জেড-লাইব্রেরি ছিল দামি কিন্তু প্রয়োজনীয় বই পাওয়ার জন্য অসংখ্য শিক্ষার্থী ও বইপ্রেমীর শেষ আশ্রয়স্থল, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। তাই 'আধুনিক যুগের আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি' জেড-লাইব্রেরির জন্য পাঠকদের মনে আক্ষেপ থেকে যাবেই।