৪০০০ বছর পুরোনো হাজার কুড়ি কয়েন আর বিশ্বের প্রথম ডাকটিকিট আছে যার সংগ্রহে
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2022/11/19/coin_collector_5.jpg)
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের ভেতরের দিকে একটা মৃদু-সবুজ দেয়ালঘেরা বাড়ি। পাহারাদার কুকুরগুলো না কামড়ালেও অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতেও তাদের বিশেষ আগ্রহ নেই। কুকুরের চৌকি পেরিয়ে একটু এগিয়ে যেতেই কয়েকটা সিঁড়ি। সেখানেই ঘরের খোলা দরজার পাশে ওয়াকার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল মো. নূরুল ইসলামকে।
ভঙ্গুর শরীর, মাথায় আগোছালো ধূসর চুল, টলায়মান পায়ের নূরুল ইসলাম জানালেন, 'কয়েক মাস আগে এক দুর্ঘটনায় পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। এরপর থেকে ওয়াকার ব্যবহার করতে হয়।' তার কথা হারিয়ে গেল দরজা দিয়ে নাচতে নাচতে বেরিয়ে যাওয়া কয়েকটা বিড়ালের মিউ-মিউ ডাকে।
বসার পর নূরুল সাহেব ধীরে ধীরে ধাতস্থ হলেন। তার কথা স্পষ্ট ও কর্তৃত্বব্যঞ্জক হয়ে উঠল। এর কারণ বোধহয় আমরা এমন একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করতে শুরু করেছিলাম যেটা তার আবেগের সঙ্গে জড়িত। আদতে বিষয়টি তার মধ্যে নিদেনপক্ষে দীর্ঘ ৮২টি বছর আগ্রহ ধরে রেখেছে।
প্রায় ঘণ্টাখানেক আলাপের পর উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ওয়াকার দিয়ে একতলা পর্যন্ত উঠলেন। তার টলমলে পা-জোড়ায় একধরনের জেদ আর হাল না ছেড়ে দেওয়ার সুদৃঢ় উদ্দীপনা চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2022/11/19/coin_collector_2_0.jpg)
আমাদের সামনে এবার একটা বন্ধ দরজা পড়ল। তিন-তলা ভবনের শেষমাথার এ দরজাটা অবশ্য দুই পাল্লার, কাঠের, বেশ দশাসই দেখতে। খোলার পরে চোখের সামনে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল নূরুল ইসলামের ২,৫০০ বর্গফুটের জাদুঘর।
দেয়ালগুলোতে লম্বা করে সিরামিক টাইল বসানো। এসব টাইলের ওপর রাজত্বকালের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী ছাপা হয়েছে সেই ৪,০০০ বছর আগে থেকে উপমহাদেশ শাসন করা বিভিন্ন রাজা-বাদশাহদের ছবি।
পুরো জাদুঘরটি দুইভাগে ভাগ করা। সবকিছুতেই সঠিকভাবে লেবেল লাগিয়ে রাখা আছে। একপাশে খ্রিস্টাব্দ ও অন্য পাশে খ্রিস্টপূর্ব। খ্রিস্টপূর্বের নিচের টাইলগুলোতে স্থান পেয়েছেন মোগল, মৌর্য, ও কুষাণ সাম্রাজ্যের সম্রাটেরা সহ আরও অনেকে।
প্রতিটি টাইলের নিচে বর্ণনা লেখা আছে। জাদুঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে উপমহাদেশের সূচনালগ্নের শাসকদের থেকে শুরু করে বর্তমান শাসনব্যবস্থাকে দেখা যাবে একবার চোখ বুলিয়েই।
কোনো সাধারণ মানুষের কাছে এ জাদুঘর একটি অনন্য স্থাপনা, আর কোনো ইতিহাসপ্রেমীর কাছে এটি বিমুগ্ধ হওয়ার একটি পরিবেশ।
নূরুলের নিবিড় তত্ত্বাবধানে তৈরি করা প্রতিটি টাইল জটিল আর খুঁটিনাটি বিষয়েও সমৃদ্ধ। আর এ টাইলগুলো দেখার সময় গাইড হিসেবে সঙ্গে থাকেন তিনিও।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2022/11/19/coin_collector_17.jpg)
কিন্তু তার জাদুঘরের মূল আকর্ষণ এখনো বাকি।
নূরুলের আজীবনের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা এ জাদুঘরে কমপক্ষে ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০ কয়েন আছে। সুপ্রাচীন শাসকদের সময়কার অনেক কয়েনের মালিকও তিনি। প্রায় ৪,০০০ বছরের পুরোনো কয়েনও সংগ্রহ করেছেন নূরুল। এ শৌখিন সংগ্রাহকের আরও আছে ডাকটিকিটের সংগ্রহ। প্রায় ৩,২০০ ডাকটিকিটের মধ্যে নূরুলের সংগ্রহে বিশ্বের প্রথম ডাকটিকিটটিও পাওয়া যাবে।
'সঠিক সংখ্যাটা বলা কঠিন। অবশ্য সব সংগ্রহের রেকর্ড তৈরির চেষ্টা করছি এখন। ডাকটিকিটের ক্ষেত্রে, ধরুন যদি একটা এ-ফোর আকারের কাগজে ১০০টা ডাকটিকিট আঁটে, তাহলে আমার কাছে এরকম ৩২টার মতো কাগজ আছে,' বলেন নূরুল।
কয়েন, ডাকটিকিট, দেয়ালের গায়ে সাঁটানো ইতিহাসের পাশাপাশি নূরুল ইসলামের সংগ্রহে আরও আছে রাজ্যের পাথর। 'অতীতে গহনায় মুদ্রা লাগানো থাকত। ওই সময় আপনার কাছে কোনো নেকলেস থাকলে সেটার সঙ্গে অনেকগুলো কয়েনও যুক্ত থাকত।'
'আপনি আমার জাদুঘরে কোহিনূর ছাড়া আর সব পাথর পাবেন,' মজা করে বলেন নূরুল।
নূরুল ইসলামের এ সংগ্রটিকে একপ্রকার গুপ্তধন বলা চলে। আক্ষরিক অর্থে দেখতে গেলেও এটি গুপ্তধনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এখন পর্যন্ত এ সংগ্রহের পেছনে আড়াই কোটি টাকা খরচ করেছেন তিনি। আজ থেকে প্রায় বছর ১৫ আগে জাদুঘরটি গড়ে তুলতে শুরু করেন তিনি। তিন বছর ধরে নির্মাণকাজ চলে এটির।
তবে কেবল গত বছর এ জাদুঘরের জন্য একপ্রকার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন নূরুল ইসলাম। তিনি জানান, সে অনুষ্ঠানে মোটামুটি ৭০ জন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেছিলেন।
কয়েক দশকের প্রচেষ্টা, অনুসন্ধানের ফসল এ জাদুঘর এখন নূরুলের দায়িত্বে পরিণত হয়েছে। 'বেশ কয়েকবছর আগে আমি একাধিকবার জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমার সংগ্রহের সবচেয়ে বিরল কিছু বস্তু দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা কোনো আগ্রহ দেখাননি,' আফসোস করে বলেন নূরুল।
'হ্যাঁ, হ্যাঁ ওই কয়েন কালেক্টর,' ফোনালাপে নূরুল ইসলামের নাম শুনেই বলে ওঠেন অধ্যাপক শাহনাজ হুসনে জাহান, পিএইচডি।
'তার প্রস্তাবে কান না দেওয়ার কথাগুলো উনি আমাকেও বলেছিলেন,' বলেন এ অধ্যাপক। 'কিন্তু ব্যাপারটাই এমন বুঝেছেন তো। যখন ব্যক্তি (প্রত্নতত্ত্ব) বিভাগ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পড়ালেখা করে আসেন না, তখন তাদের ওই বিষয়ে বিস্তর আগ্রহ ও জ্ঞান থাকলেও তাদেরকে আর বিশেষজ্ঞ হিসেবে খুব একটা মূল্যায়ন করা হয় না।'
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2022/11/19/coin_collector_7.jpg)
শাহনাজ হুসনে জাহান পুরাতত্ত্বের একজন অধ্যাপক। একইসঙ্গে তিনি সেন্টার ফর আর্কিওলজিক্যাল স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক এবং ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস (ইউল্যাব)-এর ডিপার্টমেন্ট অব জেনারেল এডুকেশন-এর প্রধান।
জাহান আর নূরুল সাহেবের পরিচয় অনেক আগে থেকেই। 'আমার নূরুল সাহেবের সঙ্গে হুট করেই একদিন দেখা যায়। ১৯৯০-এর দশকে আমি যখন মাস্টার্স পড়ছি, তখন থেকেই ভদ্রলোককে দেখতাম ইতিহাসের অনেক সেমিনারে নিয়মিত অংশ নিতে। তিনি আমাকে তার কার্ড দিয়ে তার সংগ্রহ দেখার আমন্ত্রণ জানান। অবশেষে তার গৃহ-জাদুঘরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে তা সচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়,' জানান জাহান।
অধ্যাপক জাহান দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, নূরুল ইসলামের মতো ব্যক্তিগত সংগ্রাহকেরা বিশাল অবদান রাখছেন। 'আমরা সবাই জানি অ্যান্টিক জিনিসপত্র কীভাবে অবৈধভাবে পাচার হয়, আমাদের দেশের সম্পদ বাইরে চলে যায়,' তিনি বলেন। নূরুল ইসলামের মতো সংগ্রাহকেরাই দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ দেশেই রাখেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পাস করা একেএম জাকারিয়া গবেষণা ও প্রত্নতত্ত্বে আজীবন নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন। পরে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। হাবিবুল্লাহ পাঠান ও তার বাবা হানিফ পাঠান ওয়ারিতে বটেশ্বর সংগ্রহশালা নামে একটি স্থানীয় জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সম্প্রতি ২০০০ সালে পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ নাজমুল হক একটি পাথর জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রজ্ঞাবান মানুষেরা নিজেদের চেষ্টায়, নিজেদের খরচে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসার কারণে তিলে তিলে এ সংগ্রহগুলো গড়ে তুলেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের অনেক শিক্ষার্থী গত কয়েক দশকে নিজেদের গবেষণা কাজের জন্য নূরুল ইসলামের সংগ্রহ দেখতে এসেছেন।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2022/11/19/coin_collector_14.jpg)
নূরুল জানান, তিনি সবসময় চেয়েছিলেন তার সংগ্রহগুলো যোগ্য হাতে গিয়ে পড়ুক। ১৯৫০-এর দশকে নিজের সংগ্রহ নিয়ে এক তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে নজরুল এখন নিজের সংগ্রহ নিয়ে কাকে বিশ্বাস করবেন তা বুঝে উঠতে পারেন না।
আহছানউল্লা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের (১৯৫২ ব্যাচ) গ্র্যাজুয়েট নূরুল ইসলামকে জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী হিসেবে সরকারি চাকরি করার সময় ১৯৫০-এর দশকের শেষভাগে একটি সেচব্যবস্থা তৈরির জন্য রংপুরের সাহেবগঞ্জে যেতে হয়।
জঙ্গল পরিষ্কার করে তার দলবল জমি খোঁড়া শুরু করার পর হঠাৎ বেশ কয়েকটি মূর্তি বের হয়ে আসে। নূরুল জানান, তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান এবিএম হাবিবুল্লাহ'র সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর চেয়ারম্যানের অধীনে পিএইচডি করা এক শিক্ষার্থীকে পাঠানো হয় নূরুলের কাছে। তারপর ওই সেচ প্রকল্পের এলাকা প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান সাইটে পরিণত হয়। প্রায় ৩০ জন পণ্ডিত ওই সাইটে অনুসন্ধান করে গেছিলেন।
'আমি ওই তিন ফুট উঁচু মূর্তিগুলো তাদের হাতে তুলে দেই। ওই প্রধান শিক্ষার্থীটি জোরাজুরি করেছিল এই বলে যে স্থানীয় লোকেদের কাছে এ মূর্তিগুলো ফিরিয়ে দেওয়া হোক,' নূরুল স্মৃতিচারণ করেন। 'এর কয়েক মাস পরে আমি জানতে পারলাম যে স্থানীয় লোকেরা বিদেশিদের কাছে ওই মূর্তিগুলো বিক্রি করে দিয়েছিল,' বলেন তিনি।
ওই অভিজ্ঞতার কথা এখনো ভোলেননি নূরুল। সময়ের সাথে সাথে তিনি নিজেই একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন।
ওই সাইট থেকে সংগ্রহ করা ছোট আকৃতির কিছু মিনিয়েচার মূর্তি দেখিয়ে নূরুল বলেন, 'এগুলো দেখছেন, গুলশানের গড়পড়তা অ্যান্টিক জিনিসের দোকানে আপনি এ ধরনের মূর্তি অনেক পাবেন। সাম্প্রতিক অতীতে আমি ওদের কাছ থেকে এগুলো সব কিনে নিয়েছি। তারা এগুলোর মূল্য বোঝে না।'
যে জীবন পরিতৃপ্তির
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2022/11/19/coin_collector_6.jpg)
১৯ বছর বয়সে ১৯৪৮ সালে পিতৃহারা হন নূরুল। বাবার মৃত্যুর পর তার জীবন সহজ ছিল না।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন হিসেব করে কাটিয়েছিলেন তিনি। সমৃদ্ধ পারিবারিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে তার অনেক বছর সময় লেগে গিয়েছিল। জীবনের কঠিন সময়গুলোতে সংগ্রহের নেশা তাকে আনন্দ দিয়েছিল।
১৯৪০ সালে ১১ বছর বয়স থেকে ডাকটিকিট ও ১৯৪৭ সাল থেকে কয়েন সংগ্রহ শুরু করেন নূরুল ইসলাম। ১৯৫৭ সালে হঠাৎ মূর্তি খুঁজে পাওয়ার পর পাথর, মূর্তি ও অন্যান্য আর্টিফ্যাক্ট সংগ্রহের যাত্রা শুরু হয় তার। পেশায় প্রকৌশলী হলেও তার কাজই তাকে অনেকবার প্রত্নতাত্ত্বিক, খননকারী হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে।
শরীর ভেঙে গেলে কী হবে, নূরুল এখনো ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে এক পায়ে খাড়া। তবে এ বয়সে এসে এখন চিকিৎসার বিল দিতেই তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। 'এ দুর্ঘটনা আর চিকিৎসায় আমার অনেক টাকা খরচ হয়েছে,' তিনি বলেন। আগারগাঁওয়ে ১১ কাঠা সম্পদ নিজের এক ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন নূরুল।
'আমি পরিষ্কারভাবে নির্দেশনা দিয়ে রেখেছি। আমার মৃত্যুর পর, এ জাদুঘরের দায়িত্ব তাদের ওপর থাকবে। তারা এর তত্ত্বাবধান করবে এবং শিক্ষার্থীদের এটি নিয়ে স্টাডি করা ও এর ওপর আলোচনার ব্যবস্থা করবে,' বলেন নূরুল ইসলাম।