তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হবে না: সিলেটে বিএনপি মহাসচিব
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। যারা এর বিরোধিতা করবে তারা গণশত্রু হিসেবে চিহ্নিত হবে'।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী কেবল সংবিধানের দোহাই দেন। এই সংবিধান তো তিনি সংশোধন করিয়েছেন। এই সংবিধান আমরা মানি না।
উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা একটি যুদ্ধ শুরু করেছেন। এই যুদ্ধ মুক্তির যুদ্ধ, অধিকার ফিরে পাওয়ার যুদ্ধ, ভোটের অধিকার ফিরে পাওয়ার যুদ্ধ। সিলেটের ইতিহাস হচ্ছে যুদ্ধের ইতিহাস, যুদ্ধ জয়ের ইতিহাস।
শনিবার (১৯ নভেম্বর) সিলেটে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশে তিনি একথা বলেন। এদিন নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টা আগে সকাল সাড়ে ১১টায় নগরের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে এ সমাবেশ শুরু হয়।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ, কৃষক-শ্রমিক কেউ এখন শান্তিতে নেই। গতকালও চিনির দাম, তেলের দাম বেড়েছে। সবকিছুর দাম বেড়েছে। মানুষ এখন খেতে পারে না। তিন কোটি মানুষ বেকার। অথচ তারা ১০ টাকা দামে চাল খাওয়াবে বলেছিল। গত ১৪ বছরে এই সরকার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছে।
'এই সরকারের বিচার হবে জনগনের আদালতে। মানুষের সব অধিকার কেড়ে নেয়ার অপরাধে এই সরকারের বিচার হবে'।
ফখরুল বলেন, সরকার এখন মামলা করছে। কোনও কিছুই ঘটে নাই। তবু তারা নাশকতার কথা বলে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করে। আবার হুমকি দেয়, হেফাজতের মতো অবস্থা হবে।
'আমি বলতে চাই, হুমকি-ধামকিতে কাজ হবে না। জনগণ আজ জেগে উঠেছে। জনগণ বিজয় ছাড়া ঘরে ফিরে যাবে না'।
সমাবেশে প্রধান বক্তা এবং দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, সরকার পুলিশ ও পেটোয়া বাহিনী দিয়ে হামলা করে, বাস ট্রাক বন্ধ করে সমাবেশকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু জনগণকে আটকে রাখা যায়নি। তারা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। জনগণ সমাবেশ সফল করেছে।
তিনি বলেন, বাস-ট্রাক বন্ধ করে প্রতিদিন দেশের কত কোটি টাকার ক্ষতি করা হলো- তার জবাব সরকারকে দিতে হবে। যত টাকা ঋণ করা হয়েছে- তার সুদ দেয়ার মতো টাকাও কোষাগারে নেই। সরকার লুটে নিয়েছে। আজ 'গণতন্ত্রের অবস্থা ইলিয়াস আলীর মতো। ইলিয়াস গুম, গণতন্ত্রও গুম। আমরা ইলিয়াস আলীর মতো গণতন্ত্রকেও খুঁজছি'।
১০ ডিসেম্বরের পর সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হবে বলে জানান তিনি।
সমাবেশ উপলক্ষে বৃৃহস্পতিবার থেকেই নেতাকর্মীরা আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে জড়ো হতে শুরু করেন। শুক্রবার বিকেলেই প্রায় ভরে যায় পুরো মাঠ। পরিবহন ধর্মঘট উপেক্ষা করে নেতাকর্মীরা জড়ো হন সমাবেশে।
লক্ষাধিক মানুষের এই সমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, 'সারা বাংলাদেশে অন্যায় অত্যাচার জুলুম নির্যাতন চলছে। আজ বলতে চাই, বাংলাদেশে আর কোনো জুলুম-অত্যাচার চলবে না। আমরা দেশে আবার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবো, যেমন করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান'।
তিনি বলেন, বিএনপি কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় না। আমরা জনগণের ক্ষমতা জনগনকে ফিরিয়ে দেব। দিনের ভোট আর রাতে করতে দেয়া হবে না।
সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমরান আহমদ চৌধুরী, মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মিফতা সিদ্দিকী, সিটি কাউন্সিলর রেজাউল হাসান কয়েস লোদী ও ফরহাদ চৌধুরী শামীমের পরিচালনায় সমাবেশে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা জাহিদ হোসেন বলেন, সারাদেশের মানুষ আজ জেগে উঠেছে। শেখ হাসিনার পতন হবে। মানুষের বিজয় হবে। জিনিসপত্রের দাম কমবে। নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্টিত হবে।
সমাবেশে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্ঠা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির, তাহসীনা রুশদীর লুনা, ফকলুর রহমান, যুগ্ম-মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সিলেট সিটি মেয়র ও বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আরিফুল হক চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক সাখওয়াত হোসেন জীবন, সহসাংগঠনিক সম্পাদক কলিম উদ্দিন মিলন, সমবায় বিষয়ক সম্পাদক জি কে গৌছ, সদস্য নাসের রহমান, সহ-ক্ষুদ্র্র ঋণ বিষয়ক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক, সিলেট মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুল কাইয়ুম জালালী পংকী, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব হাসান, মহিণলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস, ছাত্রদলের সভাপতি রওনক উল ইসলাম শ্রাবনসহ মোট ৫৬জন বক্তা বক্তব্য রাখেন।
#সমাবেশ উপলক্ষে বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ সিলেট বিএনপি
দীর্ঘদিন ধরেই দুই ধারায় বিভক্ত সিলেট বিএনপি। আগে বিভক্তি ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ও সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলীর নামে। সাইফুর রহমান ২০০৯ সালে প্রয়াত হয়েছেন, আর ইলিয়াস আলী ২০১২ সাল থেকে নিখোঁজ।
তাদের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতেও বিভেদ ঘুচেনি দলটির। এখনও সিলেট বিএনপি দুই ধারায় বিভক্ত। বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্ঠা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির এবং দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য- সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নেতৃত্বে রয়েছেন এই দুই বলয়ের। সাম্প্রতিক সময়ে সকল দলীয় কর্মকান্ডে এ দুই নেতা ও তাদের অনুসারীদের বিপরীতমুখী অবস্থানে দেখা গেছে।
তবে সিলেট বিভাগীয় সমাবেশকে ঘিরে দীর্ঘদিনের এই বিভেদ ভুলে সিলেট বিএনপিতে এখন ঐক্যের সুর। দলের সব পর্যায়ের নেতারাই মাসখানেক ধরে ঐক্যবদ্ধভাবে সমাবেশের প্রচারণা চালাচ্ছেন। প্রচার কার্যক্রমের শুরু থেকেই সক্রিয় রয়েছেন খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির; অন্যদিকে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে চলতি সপ্তাহে সমাবেশের প্রচার কার্যক্রমে সক্রিয় হয়েছেন।
সমাবেশ সফলে গঠিত ছয়টি উপ-কমিটির মধ্যে দুটির আহ্বায়কেরও দায়িত্বে রয়েছেন এ দুই নেতা। পারস্পরিক বিরোধ থাকলেও তাদের দুজনকে একসাথেও সমাবেশের প্রচার ও প্রস্তুতির কার্যক্রমে দেখা গেছে। বৃহস্পতিবার সমাবেশস্থল আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে মুক্তাদির ও আরিফকে পাশপাশি বসে শলাপরামর্শ করতে দেখা গেছে।
সিলেটের বিএনপি নেতারা জানান, কেবল দুই নেতার মধ্যেই নয়, সিলেটে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে অন্তর্কোন্দল রয়েছে। তবে এই সমাবেশের জন্য এসব বিভেদ ভুলে তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করছেন।
জেলা বিএনপির একাধিক নেতা জানান, ঐক্যবদ্ধভাবে বিভাগীয় সমাবেশ সফলে কাজ করার জন্য কেন্দ্র থেকে সিলেটের নেতাদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতাদের সমন্বয়ে একটি দল সিলেটে অবস্থান করে প্রস্তুতি ও প্রচার কার্যক্রম তদারকি করছেন। এছাড়া ঢাকায় বসে শীর্ষ নেতারা এমনকী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সনও সব কার্যক্রম তদারকি করছেন। ফলে পারস্পরিক সকল বিরোধ ও বিভেদ আপাতত দূরে রেখে সব নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নেমেছেন।
তবে সিলেট জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক ও জেলা বিএনপির সর্বশেষ আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আব্দুল আহাদ খান জামাল বলেন, বিএনপিতে কোনো কোন্দল নেই। বড় দল হওয়ায় নেতৃত্বের প্রতিযোগীতা আছে।
তিনি বলেন, ছোটখাটো কিছু বিভেদ থাকলেও দল ও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সবাই এখন ঐক্যবদ্ধ। এই সরকারের পতন দাবিতে কারো কোনো দ্বিমত নেই। ফলে এই আন্দোলনে সকল নেতাই সক্রিয়ভাবে মাঠে রয়েছেন।
বিএনপি দলীয় সূত্রে জানা যায়, সাইফুর রহমানের প্রয়াণ ও এম ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর- সিলেটে বিএনপির একক নেতা হয়ে ওঠেন খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। যুক্তরাজ্য ঘনিষ্ঠতা তাকে আরও ক্ষমতাবান করে তোলে। এরফলে ছাত্রদল, যুবদল থেকে শুরু করে বিএনপি ও এর সহযোগী অঙ্গ-সংগঠনের কমিটিতে তার অনুসারী নেতাদেরই ছিল দাপট।
তবে দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর দলের মধ্যে নিজেকে শক্তিশালী করে তুলতে শুরু করেন আরিফ। এ থেকে মুক্তাদিরের সাথে দূরত্ব বাড়ে তার। গত সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসন থেকে মুক্তাদির বিএনপির মনোনয়ন চাইলেও আরিফুল হক চৌধুরী ছিলেন প্রবীন নেতা ইনাম আহমদ চৌধুরীর পক্ষে। মুক্তাদিরকে ঠেকাতে সাবেক আমলা ইনাম আহমদকে আরিফই মাঠে নামান বলে দলের মধ্যে আলোচনা রয়েছে। যদিও সেবার দলীয় মনোনয়ন পান খন্দকার মুক্তাদির। আর মনোনয়ন না পেয়ে বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগের যোগ দেন প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ইনাম আহমদ চৌধুরী।
তবে এরপর থেকে মুক্তাদির ও আরিফের দুরত্ব আরও বাড়তে থাকে। সম্প্রতিক সময়ে জেলা ও মহানগর বিএনপি এবং অঙ্গ-সংগঠনের সম্মেলনে দুই বলয় থেকেই আলাদা আলাদা প্রার্থী দিতে দেখা গেছে।
তবে ক্রমেই দূরে সরে যাওয়া এই দুই নেতা বিভাগীয় গণসমাবেশ উপলক্ষে এক কাতারে নেমে এসেছেন।
তবে দলে বিরোধ নেই জানিয়ে সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, আমাদের দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা আছে। তাই যে কেউ প্রার্থী হতে পারে। প্রার্থী দিতে পারে। আর কর্মীরা ভিন্ন ভিন্ন নেতাকেও পছন্দ করতে পারে। এটা বিরোধ নয়। আর ছোটখাটো সমস্যা থাকলেও এগুলো ভুলে আমরা সবাই সমাবেশ সফলে মাঠে নেমেছি। শনিবার সিলেটকে জনসমুদ্রে পরিণত করাই আমাদের লক্ষ্য।
খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির বলেন, বড় দলের ভেতরে মতানৈক্য-মতবিরোধ থাকবেই। এটাই রাজনীতির সৌন্দর্য। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তবে সব বিভেদ ভুলে আমরা এই অবৈধ সরকার পতনের লড়াইয়ে নেমেছি। জনগণকে ভোটাধিকার, জীবনের নিরাপত্তা ফিরিয়ে দেয়ার লড়াইয়ে নেমেছি। এসব বিষয়ে আমাদের মধ্যে কোন মতবিরোধ নেই।