ঢাকা বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প: মেয়াদ ও ব্যয়বৃদ্ধির অজুহাতে পুরোদমে কাজই শুরু হয়নি
সময়মতো কাজ না করে মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি যেন বাংলাদেশের উন্নয়ন কাজের অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) প্রকল্পের মতো প্রায় একই ধারায় হাঁটছে জয়দেবপুর থেকে দেবগ্রাম ও ভুলতা হয়ে মদনপুর পর্যন্ত ৪৮ কিলোমিটার সড়ক চার লেনে উন্নীত করতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) ভিত্তিতে নেয়া দেশের প্রথম সড়ক প্রকল্প।
ঢাকার যানজট এড়িয়ে গাজীপুর থেকে চট্টগ্রাম ও সিলেটে দ্রুতগামী পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ২০১৮ সালের চুক্তির আওতায় চলতি বছরের মধ্যে এক্সপ্রেসওয়েটি খুলে দেয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন কারণে এখনও পুরোদমে কাজ শুরুই হয়নি।
এরই মধ্যে করোনা মহামারী এবং রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে সব ধরনের উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি আর টাকার অবমূল্যায়নের অজুহাতে প্রকল্পটিতে সরকারের পক্ষ থেকে বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি টোল আদায়ের সময়সীমা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে বিনিয়োগকারী কনসোর্টিয়াম।
সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সরকারি সংস্থাকে পাঠানো একটি চিঠিতে, প্রকল্পের বেসরকারি অংশীদার ঢাকা বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ে ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড সরকারি তহবিল থেকে অতিরিক্ত বিনিয়োগের পাশাপাশি চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেছে; এর জন্য তারা দায়ী করেছে সব ধরনের নির্মাণ উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নকে।
কনসোর্টিয়ামটি ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সরকারের সাথে একটি ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তি স্বাক্ষর করে যেখানে দুই বছরের মধ্যে অবকাঠামোটির বিকাশ এবং পরবর্তী ২৩ বছরে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টোল আদায়ের ব্যাপারে উল্লেখ থাকে।
জয়দেবপুর থেকে দেবগ্রাম ও ভুলতা হয়ে মদনপুর রোড পর্যন্ত ৪৮ কিলোমিটারের নিয়ন্ত্রিত এই এক্সপ্রেসওয়ে চলতি বছরের শেষ নাগাদ যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পের কাজ শুরু হয় এপ্রিলে।
এই পরিকল্পিত এক্সপ্রেসওয়ের আগে এখানে ঢাকা বাইপাস রোড নামে একটি দুই লেনের রাস্তা ছিল। গাজীপুর থেকে চট্টগ্রাম ও সিলেটে দ্রুত যান চলাচলের লক্ষ্যে বিদ্যমান সরু রাস্তাটিকে চার লেনের ফ্লাইওভার হাইওয়েতে উন্নীত করে রাজধানীতে যানবাহনের চাপ কমানোই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (আরএইচডি) কর্মকর্তারা এই প্রস্তাবের বিষয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের (টিবিএস) কাছে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি তবে পিপিপি কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা এর বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রস্তাবটি গ্রহণ করা সরকারের জন্য আর্থিক ক্ষতি বয়ে আনবে এবং সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য পিপিপির মাধ্যমে অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে তা ব্যাহত হবে।
তারা আরও বলেছে যে চুক্তি বহির্ভূত যেকোন অতিরিক্ত সুবিধা অন্যান্য পিপিপি প্রকল্পের বিনিয়োগকারীদের অযৌক্তিক সুবিধা পেতে উৎসাহিত করবে।
চিঠিতে ঢাকা বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ে ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক ও সিইও জিয়াও ঝিমিং উল্লেখ করেন, প্রস্তাব জমা দেওয়ার সময় ২০১৬-২০১৭ সালের রেট শিডিউলকে নির্মাণ ব্যয় গণনার নির্দেশিকা হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল।
তবে বাংলাদেশ এবং সমগ্র বিশ্বে মহামারীর লকডাউনের সময় নির্মাণ সামগ্রীর দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। তিনি বলেন, মুদ্রাস্ফীতি বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে সরকার গত বছর ডিজেলের দাম ২৩% এবং এই বছরের আগস্টে আরও ৩৬.২৫% বাড়িয়েছে, এতেও পরিবহন খরচ এবং অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
জ্বালানি দাম ছাড়াও অন্যান্য আমদানিকৃত পণ্যের খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, যা প্রকল্প নির্মাণকে প্রভাবিত করছে।
বিবিএস বুলেটিনের উদ্ধৃতি দিয়ে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ইস্পাত, সিমেন্ট ও এগ্রিগেটের দাম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
সাম্প্রতিক গণনা অনুসারে, প্রকল্প প্রস্তুতির অর্থায়ন (পিআরএফ) পর্যায়ে নির্ধারিত ব্যয়ের তুলনায় প্রকল্পের ব্যয় ১৮.২৬% বৃদ্ধি পাবে; জিয়াও ঝিমিং ইঙ্গিত দিয়েছেন, ব্যয় আরও বাড়তে পারে।
এই পরিস্থিতিতে এ সমস্ত অতিরিক্ত ব্যয় সংকোচনের জন্য অতিরিক্ত আর্থিক সংস্থা্নের ব্যবস্থা করা খুব চ্যালেঞ্জিং হবে বলে চিঠিতে জিয়াও বলেছেন।
তিনি বলেন, ২,৫৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অতিরিক্ত ব্যয়ের সঙ্গে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ৩,০৫১ কোটি টাকা।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী (আরএইচডি) এ কে এম মনির হোসেন পাঠান বিনিয়োগকারী কনসোর্টিয়ামের চিঠির বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি।
তিনি প্রকল্পটির পরিচালক ও অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল ওয়াহিদের সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। তবে পিডি দেশের বাইরে থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা জানান, বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের একটি চিঠি অতি সম্প্রতি পাওয়া গেছে। চিঠির বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, চুক্তির বাইরে কোন সুবিধা দিতে হলে পিপিপি অফিস, সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয় ও সিসিসিএসহ সরকারের বিভিন্ন দফতরের অনুমোদন প্রয়োজন হবে।
পিপিপি কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক (প্রোগ্রামিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন) মোঃ আবুল বাশার বলেন, নির্মাণ ব্যয় বাড়লেও পিপিপি প্রকল্পের চুক্তিতে মেয়াদ বৃদ্ধির কোন সুযোগ থাকে না।
উপকরণের দাম বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে সরকারের প্রকল্পের ব্যয় বাড়তে পারে। কিন্তু পিপিপি প্রকল্পের ব্যয় বাড়লে বাড়তি অর্থ সরকারের পক্ষ থেকে দেয়ার কোন সুযোগ নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া সাপোর্ট প্রকল্পে ধীরগতির কারণে পিপিপি অংশিদারকে সময়মত জমি বুঝিয়ে দেয়া যায়নি। কাজ শুরু করতে সরকার ও পার্টনার দুই পক্ষেরই কিছুটা সমস্যা রয়েছে।
এই বিষয়টি বিবেচনায় আলোচনার ভিত্তিতে সামান্য কিছু সুবিধা দেয়া যেত পারে বলেও তিনি মনে করেন।
বিলম্ব আর ব্যয় বৃদ্ধির কারণে অংশিদার প্রতিষ্ঠানকে কোন বাড়তি সুবিধা দেয়া হলে পিপিপি প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসন নিশ্চিতে সরকারের প্রতিশ্রুতির বিচ্যুতি হবে বলে মনে করেন বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ ডাঃ শামসুল হক।
প্রকল্পের সারসংক্ষেপ
প্রকল্পটির প্রস্তুতি পর্যায়ে পরামর্শ সেবা দিয়েছিল এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), এডিবির প্রতিবেদনে বলছে, ঢাকা বাইপাস রোডটি পণ্য পরিবহনের জন্য একটি কৌশলগত করিডোর, ঢাকার উত্তরের উৎপাদন কেন্দ্রকে চট্টগ্রাম বন্দরেরসাথে সংযুক্ত করে।
অনুমান করা হচ্ছে, প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার মোটর যান বিদ্যমান ঢাকা বাইপাস রোড ব্যবহার করে এবং এ সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। ২-লেনের রাস্তাটি এই বর্ধিত ট্রাফিক চলাচলের জন্য উপযুক্ত না, তবে স্থানীয় ট্রাফিককে ট্রান্স-রিজিওনাল ট্র্যাফিক থেকে আলাদা করতে হবে চাহিদা বৃদ্ধি এবং ভ্রমণের সময় কমাতে একটি ডেডিকেটেড এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করতে হবে।
বিষয়টি বিবেচনা করে, অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি (সিসিইএ) নীতিগতভাবে পিপিপি ব্যবস্থার অধীনে একটি সার্ভিস লেন সহ রাস্তাটিকে চার লেনের এক্সপ্রেসওয়েতে উন্নীত করার জন্য ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়।
২০১৭ সালে আরএইচডি দ্বারা পরিচালিত দুই ধাপের বিডিংয়ের পরে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সিচুয়ান রোড অ্যান্ড ব্রিজ (গ্রুপ) কর্পোরেশন লিমিটেড (এসআরবিজি), শামীম এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড (এসইএল) এবং ইউডিসি কনস্ট্রাকশন লিমিটেড (ইউডিসি) এর কনসোর্টিয়ামকে ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারী অংশীদার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
চুক্তি স্বাক্ষরের সময় ভৌত প্রকল্পের আনুমানিক ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের ২২৪ কোটি টাকা ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফাইন্যান্সিং হিসেবে দেওয়ার কথা ছিল।
গত বছরের এপ্রিলে ঢাকা বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ে ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (সিডিবি) এবং বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড লিমিটেডের (বিআইএফএফএল) সঙ্গে একটি অর্থায়ন চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুযায়ী, সিডিবি ১,৬১৪ কোটি টাকা এবং বিআইএফএফএল ১,০৭৫ কোটি টাকা দেবে বলে সূত্র জানায়।
এর আগে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বেসরকারি অংশীদারকে ঋণ দেওয়ার জন্য বিআইএফএফএল-কে ১০০ মিলিয়ন ডলার দিতে সম্মত হয়েছিল।