চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ‘অপরিকল্পিত' ৫ র্যাম্প নির্মাণ স্থগিত করল কর্তৃপক্ষ
চট্টগ্রাম নগরীর প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের 'অপরিকল্পিত' পাঁচটি র্যাম্প নির্মাণ স্থগিত রাখার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ (সিডিএ)। অপ্রয়োজনীয়তা, পরিবেশগত উদ্বেগ এবং খরচ সাশ্রয়ের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি উড়াল সেতুটিতে দুই চাকার মোটর সাইকেল ও তিন চাকার সিএনজি অটোরিকশা প্রাথমিকভাবে চলাচলের সুযোগ রাখা হচ্ছে। গত সোমবার (২৯ অক্টোবর) অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) বোর্ড সভায় এসব সিদ্ধান্ত অনুমোদন করা হয়।
নিয়মানুযায়ী, তা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।
নির্মাণ স্থগিত করা পাঁচটি র্যাম্প হলো— নগরীর টাইগারপাসের মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী সড়কের পলোগ্রাউন্ড থেকে পতেঙ্গামুখী র্যাম্প; মূল এক্সপ্রেসওয়ে থেকে আগ্রাবাদে জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের সামনে নামার র্যাম্প; আগ্রাবাদের অ্যাকসেস রোডে ওঠানামার দুটি র্যাম্প এবং মূল সেতু থেকে ইপিজেড নামার র্যাম্প।
উড়াল সড়কে দুর্ঘটনাজনিত ঝুঁকি এড়াতে প্রথমে দুই চাকা এবং তিন চাকার বাহন চলাচলে বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছিল। যদিও সমালোচনার মুখে বোর্ড সভায় তা তুলে দেওয়া হয়েছে।
সিডিএর তথ্যমতে, গত আগস্টে গণঅভ্যত্থানের ফলে আওয়ামীলীগ সরকারে পতনের পর নতুন করে সিডিএ বোর্ড গঠন করা হয়। এরপর সিডিএ র্যাম্পের প্রয়োজনীয়তা, পরিবেশবাদী ও স্থানীয় অংশীজনদের আপত্তির বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে। পাশাপাশি ব্যয় সংকোচনের বিষয়টি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এছাড়া উড়াল সেতুতে দুই চাকা ও তিন চাকার বাহন চলাচলের নিষেধাজ্ঞার পূর্বের সিদ্ধান্তও সমালোচনার মুখে পড়েছিল। সেটিও বিবেচনা করা হয়েছে।
প্রকল্পের নথিপত্রের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের ১১ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকল্পটির ব্যয় এক লাফে ১ হাজার ৪৮ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা করা হয়। তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের কাজ ২০২০ সালের জুনে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু কাজ শুরুই করেছিল ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
পরে দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার দৈঘ্যের উড়াল সড়কটির নকশা প্রণয়নের সময় অন্য কোনো সংস্থা ও বা অংশীজনদের মতামত নেওয়া হয়নি। ফলে পদে পদে আপত্তি আসতে থাকে বিভিন্ন সংস্থা থেকে। ২০২১ সালে এসব বিষয় উঠে আসতে শুরু করে।
ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে আলাপ না করায় জটিলতা দেখা দেয়। ফলে অর্ধেক নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য ইউ-লুপ এবং ইউ-টার্নের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সামনে আসে। এরপর উড়াল সড়কে ওঠা-নামার জন্য নকশায় যুক্ত করা হয় ১৫টি র্যাম্প। পদে পদে নকশা পরিবর্তন, নতুন স্থাপনা যুক্ত নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে।
২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন করেছিলেন। গত আগস্টে পরীক্ষামূলক যান চলাচল শুরু করা হয়। এতে সর্বোচ্চ গতিসীমা রাখা হয় ৬০ কিলোমিটার। এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্পের (মূল উড়ালসড়ক থেকে ওঠানামার পথ) কাজ শেষ না হওয়ায় গাড়িগুলো নগরীর লালখান বাজার থেকে সরাসরি পতেঙ্গা পর্যন্ত যাতায়াত করছে।
নগরীর লালখান বাজার থেকে গাড়ি ওঠার সুযোগ রাখা হয়েছে। আর এই প্রান্তে গাড়ি নামছে টাইগারপাসে। এছাড়া, পতেঙ্গা প্রান্তে গাড়ি ওঠানামা করছে।
অপরিকল্পিত প্রকল্প, পাঁচ র্যাম্প নির্মাণ স্থগিত
এদিকে, প্রকল্পটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে যৌথভাবে কাজ করছে বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ও চীনের র্যাঙ্কিন। প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন হওয়ার আগেই কাজের মান নিয়ে প্রশ্নও ওঠায় বিগত সরকারের আমলে এ বিষয়ে তদন্তও চলছিল।
অপ্রয়োজনীয়, অংশীজনদের আপত্তির ও ব্যয় সংকোচনের প্রশ্নে শুরু থেকেই প্রকল্পটির 'অপরিকল্পনার' বিষয়টি বোর্ড সভায় আলোচনায় আসে। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বোর্ড সদস্যরা।
টাইগারপাসের মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী সড়কের পলোগ্রাউন্ড থেকে পতেঙ্গামুখী র্যাম্প নির্মাণ করলে গাছ কাটা পড়বে। ফলে প্রকৃতি, সবুজ ও পাখির আবাস্থল নষ্ট হবে। বিষয়টি নিয়ে গত এপ্রিলে আন্দোলনেও নেমেছিলেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও সিডিএর নতুন বোর্ড সদস্য নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি জেরিনা হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "রাজনৈতিক বিবেচনায়ও র্যাম্প নামানো হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। প্রকল্পটির শুরু থেকেই অপরিকল্পিত। কৌশলগত ও প্রকৌশলগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি।"
তিনি বলেন, "কত শতাংশ মানুষ র্যাম্প ব্যবহার করবেন, কারা কোথা থেকে উঠবেন, উপরে কারা চলাচল করবেন, নিচে কারা চলাচল করবেন, এর প্রভাব কেমন পড়বে— এসব বিষয়ে কোন স্টাডি নেই। বোর্ড সভায় জবাব দিতে পারেনি কেউ। এজন্য পাঁচটি র্যাম্প নির্মাণ স্থগিত রাখার সুপারশি করা হয়েছে।"
সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "এখনই প্রয়োজন নেই, এজন্য পাঁচটি র্যাম্প নির্মাণ স্থগিত রাখার অনুমোদন হয়েছে। তবে নকশা আগের মতো থাকবে। ভবিষ্যতে প্রয়োজন অনুসারে র্যাম্প নির্মাণের সুযোগ রাখা হয়েছে।"
চলবে দুই-তিন চাকার বাহন, টোল হার পুনঃমূল্যায়ন
এদিকে, উড়াল সড়কে দুর্ঘটনাজনিত ঝুঁকির কারণে দুই চাকা এবং তিন চাকার বাহন চলাচলের বিধিনিষেধ ছিল। বোর্ড সভায় বিধিনিষেধও তুলে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আগের তুলনায় যানবাহন এবং ওঠা-নামা স্থান ভেদে ২০ থেকে ৫০ টাকা কমিয়ে টোল হার পুনঃমূল্যায়ন করা হয়েছে।
নতুন প্রস্তাবিত টোল হার অনুযায়ী, মোটর সাইকেল ১০ থেকে ১৫ টাকা, সিএনজি অটোরিকশা (তিন চাকার বাহন) ২০ থেকে ৩০ টাকা, কার ৫০ থেকে ৮০ টাকা, জিপ ৭০ থেকে ১০০ টাকা, মাইক্রোবাস ৯০ থেকে ১০০ টাকা, পিকআপ ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা, মিনি বাস ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, বাস ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা, ট্রাক (৪ চাকা) ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, ট্রাক (৬ চাকা) ৩০০ টাকা, কাভার্ড ভ্যান ৪৫০ টাকা ও ট্রেইলার ৪৫০ টাকা।
সংস্থাটির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম টিবিএসকে বলেন, "সিএনজি অটোরিকশা না চলতে দিলে মধ্যবিত্তরা বঞ্চিত হবেন। আর শুরুতে মোটর সাইকেল চলাচলের অনুমোদন দেওয়া হবে। তবে পরবর্তীতে অন্য যানবাহন চলাচল বাড়লে, মোটর সাইকেল চলাচল বন্ধ করা হবে। কারণ ভিন্ন লেন না থাকায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়ে গেছে।"
"এছাড়া, দুই ও তিন চাকার যানবাহনের টোল হারসহ পুরোটাই পুনঃবিবেচনা করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য।"
তিনি আরও বলেন, "টোল প্লাজার সরঞ্জাম বিদেশ থেকে এসে গেছে। নামার রাস্তায় টোল প্লাজা স্থাপন করা হবে। মধ্যবর্তী স্থানে এক ধরনের টোল এবং শেষ প্রান্তে আরেক ধরনের টোল হার নির্ধারণ করা হয়েছে।"