যেভাবে শেষ হয়ে গেল মাহাথির মোহাম্মদের ৫৩ বছরের বর্ণিল ক্যারিয়ার
১৯৮১ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২২ বছর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন মাহাথির মোহাম্মদ। ঔপনিবেশিক শাসন বেরিয়ে এসে ৮০'র দশকে তিনি মালয়েশিয়াকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের শীর্ষে নিয়ে যান। বিশ্বব্যাপী তাই তিনি 'আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি' হিসেবেই সুপরিচিত।
২০১৮ সালে মালয়েশিয়ার দুর্নীতিবাজ সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাককে সরাতে দীর্ঘ অবসর থেকে বেরিয়ে এসে আবারও নির্বাচনে দাঁড়ান মাহাথির। দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী আনোয়ার ইব্রাহীমের সাহায্যে পুনরায় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তিনি।
কিন্তু ৯৭ বছর বয়সে এসে নিজ দেশেই জীবনে প্রথমবারের মতো নির্বাচনে হারলেন বর্ষীয়ান এই নেতা। এর আগে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, নির্বাচনে হারলে রাজনীতি থেকে অবসরে যাবেন। ধারণা করা হচ্ছে এর মধ্যে দিয়ে তাঁর ৫৩ বছরের বর্ণিল রাজনৈতিক ক্যারিয়ারেরও সমাপ্তি হতে চলেছে। এই ক্রান্তিলগ্নে দেখে নেওয়া যাক দুর্দান্ত প্রতাপশালী মাহাথির মাহমুদের উত্থান ও পতনের গল্প।
মাত্র ২১ বছর বয়সে রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ করেন মাহাথির মোহাম্মদ। ১৯৪৬ সালে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন যখন চরমে, তখন জাতীয়তাবাদী ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে (ইউএমএনও)-তে যোগ দেন তিনি।
ইউনিভার্সিটি অব মালয় থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়াশোনা করে নিজ জন্মস্থান কেদাহ রাজ্যে দীর্ঘ সাত বছর চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন তিনি। এরপর ১৯৬৪ সালে ইউএমএনও-র হয়ে মালয়েশিয়ার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
তবে মালয় সম্প্রদায়কে অবহেলার অভিযোগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টুংকু আব্দুল রহমানের কাছে খোলা চিঠি লিখে দলীয় রোষের মুখে পড়েন তিনি। ১৯৬৯ সালে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে পার্লামেন্টের আসন হারান।
এরপরই নিজের আদর্শ ও ভাবনা থেকে লিখেন বিতর্কিত বই 'দ্য মালয় ডিলেমা'। ঔপনিবেশিক শাসনামলে মালয়দের কীভাবে প্রান্তিক ও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়, তা-ই ওঠে আসে এই বইয়ে।
এই বই প্রকাশের পরই রাজনীতিক হিসেবে মাহাথিরের নবজন্ম ঘটে। নব্য পশ্চিমা ঔপনিবেশিকদের প্রতি মালয়েশিয়ার ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে সেটিও ঠিক করে দেয় বইটি। মালয় ডিলেমা প্রকাশের পরই ইউএমএনও দলের তরুণ নেতাদের মধ্যে মাহাথিরের জনপ্রিয়তা বাড়ে। দলে ফিরেই ১৯৭৪ সালের নির্বাচনে পুনরায় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। এবার সরাসরি মন্ত্রণালয়ে ঢুকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।
মন্ত্রী হওয়ার চার বছরের মধ্যেই মাহাথির মোহাম্মদ দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ১৯৮১ সালে তিনি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
এরপর টানা ২২ বছর তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। জাপানকে অনুসরণ করে তিনি মালয়েশিয়াকে ইলেকট্রনিকস, স্টিল ও গাড়ি উৎপাদনকারী দেশে রূপান্তর করেন। এর আগে মালয়েশিয়া শুরু রাবার ও টিন রপ্তানি করত। ২০০৩ সালে স্বেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রীর পথ থেকে সরে দাঁড়ান মাহাথির।
যে কারণে হারলেন মাহাথির?
২০১৮ সালে নাজিব রাজাকের ব্যাপক দুর্নীতি সংশ্লিষ্টতার কারণে মাহাথির মোহাম্মদ নাওয়ার ইব্রাহীমের সঙ্গে সন্ধি করে পুনরায় রাজনীতিতে আসেন। তবে সময় গড়াতেই দুজনের পুরোনো দ্বন্দ্ব আবারও দেখা দেয়। এছাড়া দুর্নীতি বিরোধী প্রচারণা চালালেও নির্বাচনে জয় লাভের পর তিনি আর দুর্নীতি সামাল দিতে পারেননি।
বিশ্লেষকদের মতে, তরুণ প্রজন্মের কাছে এই নেতা নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। ধীরে ধীরে কমতে থাকে তার প্রভাব।
নির্বাচনে মাহাথিরের পরাজয়ের অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বীদের শক্ত রাজনৈতিক অবস্থান ও কৌশল। এবারের নির্বাচনে আনোয়ার ইব্রাহিমের দল পাকাতান হারাপান এবং মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের নেতৃত্বাধীন পেরিকাতান দল ছিল শক্ত অবস্থানে।
মাহাথির মোহাম্মদ পেরিকাতান জোটের প্রার্থী মোহাম্মদ সুহাইমি আবদুল্লাহর কাছে পরাজিত হন। তবে তিনি এবার ভরাডুবির সম্মুখীন হন। পাঁচ জন প্রার্থীর মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ অবস্থানে। নির্বাচনে হেরে জামানতও খুইয়েছেন তিনি। নির্বাচনে মাহাথিরের দল একটি আসনেও জিততে পারেনি।
২০১৮ সালে এই একই আসনে বারিসান ন্যাশনালের প্রার্থীতে হারিয়ে ৫৪ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেছিলেন মাহাথির।
এর আগে এক সাক্ষাৎকারে শতবর্ষে পা দিয়ে রাজনীতি অঙ্গনে থাকার ইচ্ছা নেই জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, 'আমার থাকার চেয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমার অভিজ্ঞতা দলের তরুণদের মধ্যে স্থানান্তর করা'।