ওই ম্যাচটার কারণেই বাংলাদেশের ক্রিকেট আজ এখানে: রফিক
সমীকরণটা খুব সহজ ছিল। জিতলে ফাইনাল, মানে বিশ্বকাপে খেলার টিকেট জয়। কিন্তু হারলেই বিদায়, তাতে আরও একবার স্বপ্নভঙ্গ। প্রতিপক্ষ স্কটল্যান্ড তখন বেশ দাপুটে। আর বাংলাদেশ পুরোপুরি 'মিনোজ'। প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে তখনও লড়াই করা শেখেননি আকরাম খান, খালেদ মাসুদ পাইলট, মোহাম্মদ রফিকরা।
তবু সেদিন বাংলাদেশের পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন ক্রিকেট ঈশ্বর। ২৩ বছর আগে আজকের এই দিনেই (৮ এপ্রিল) মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে আইসিসি ট্রফির ফাইনালে উঠেছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ক্রিকেটের চেহারা বদলানোর স্বপ্নের যাত্রায় দ্বিতীয় সেমিফাইনালে স্কটল্যান্ডকে ৭২ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়েছিলেন পাইলট-রফিকরা।
কুলয়ালালামপুরের আকাশ আগে থেকেই চোখ রাঙাচ্ছিল। আগের রাতে ভারী বর্ষণের কারণে খেলাও দেরিতে শুরু হয়। রিজার্ভ ডে থাকলেও ম্যাচ বাতিল হয়ে যাওয়া নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কা ছিল। যদিও সব শঙ্কা উড়িয়ে ২টা ৪৩ মিনিটে মাঠে গড়ায় খেলা।
টস হেরে আগে ব্যাটিংয়ে নেমে ম্যাচসেরা খালেদ মাসুদ পাইলটের ৭০, আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ৫৭ ও মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর অপরাজিত ৩৯ রানে ৭ উইকেটে ২৪৩ রান তোলে বাংলাদেশ। এরপর বল হাতে বাংলাদেশর দুই স্পিনার এনামুল হক মনি ও মোহাম্মদ রফিকের স্পিন ভেল্কি।
এনামুল হক মনি ৩ উইকেট নিয়ে স্কটল্যান্ডের ব্যাটিং লাইন আপের কোমড় ভেঙে দেন। বাকি কাজটুকু সারেন মোহাম্মদ রফিক। ২৫ রান খরচায় ৪ উইকেট তুলে নিয়ে বাংলাদেশকে স্বপ্নের ফাইনালে তুলে দেন দেশের হয়ে ৩৩ টেস্ট ও ১২৫ ওয়ানডে খেলা মোহাম্মদ রফিক।
২৩ বছর পরও সেই ম্যাচটি রফিকের চোখে ঝকঝকে-রঙিন। সেই চার উইকেট নেওয়ার কথা মনে আছে? এমন প্রশ্নে পুরো ম্যাচটিই যেন স্মৃতির ক্যানভাসে এঁকে ফেললেন বাংলাদেশের সাবেক এই স্পিনার। জানালেন, ওই ম্যাচটির কারণেই তো বাংলাদেশের ক্রিকেট আজ এখানে।
১৯৯৭ আইসিসি ট্রফির সেমিফাইনালে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ নিয়ে দ্য বিজনেজ স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে অনেক কথাই বললেন রফিক। বললেন, 'সত্যি বলতে অনেক বছরই তো হয়ে গেল। কিন্তু যত সময়ই যাক, এসব ম্যাচ তো স্মরণীয়। ওই ম্যাচটার কারণেই বাংলাদেশের ক্রিকেট আজ এখানে এসেছে। এটা শুধু আমাদের নয়, আমি মনে করি পুরো বাংলাদেশের মানুষেরই স্মরণ রাখা উচিত।'
ওই ম্যাচটাকেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের টার্নিং পয়েন্ট বলে মনে করেন রফিক। সাবেক বাঁহাতি এই স্পিনার বলেন, 'বাংলাদেশ ক্রিকেটের টার্নিং পয়েন্ট ছিল ওই ম্যাচটিই। কারণ ওই ম্যাচটা হারলে আমরা চার নম্বর হতাম। চার নম্বর হলে তো আমরা বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতাম না। ওই ম্যাচটা জিতেছি বলেই আমরা বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করি।'
'চ্যাম্পিয়ন না হলে হয়তো আমরা একটা বিশ্বকাপ খেলতে পারতাম। আমাদের ভাগ্য ঘুরে গেছে কেনিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে। কেনিয়া যে রান করেছিল, সত্যি বলতে ওই রান করাটা খুব কঠিন ছিল। বৃষ্টিতে অনেকটাই সুবিধা হয়েছিল আমাদের। বৃষ্টি না হলে আমরা এই পর্যায়ে নাও থাকতে পারতাম। আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি বলে আজ বাংলাদেশ ক্রিকেটের মোড় ঘুরে গেছে।' যোগ করেন রফিক।
সেমিফাইনাল জিতেই বিশ্বকাপে খেলা নিশ্চিত হয়ে যায় বাংলাদেশের। ফাইনালের আগে আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যায় বহুগুনে। কিন্তু তখনকার শক্তিশালী কেনিয়ার বিপক্ষে ফাইনাল জিতবেন, এমন আশা ছিল না রফিক, দুর্জয়, সুজনদের।
রফিকের ভাষায়, 'ম্যাচ জিতে আত্মবিশ্বাস বেড়েছিল। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাব, সেটা চিন্তা করিনি। কারণ কেনিয়া তখন অনেক বড় দল। বাংলাদেশ এখন বড় দল হতে পারে, বড় বড় দলতে হারাতে পারে, কিন্তু সে সময় কেনিয়া আমাদের চেয়ে অনেক বড় দল ছিল। কেনিয়াকে আমরা সব সময়ই ভয় পেতাম। কেনিয়ার বিপক্ষে আমরা সব সময়ই হারতাম। তবে ফাইনালে যেহেতু উঠেছিলাম, লক্ষ্য ছিল ভালো খেলা। বাংলাদেশ বিশ্বকাপে খেলবে, এই বিশ্বাসটা ছিল।'
সেমিফাইনালে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ২৪৩ রান করেও স্বস্তিতে ছিল না বাংলাদেশ। তখনকার স্কটল্যান্ড যে বাংলাদেশের কাছে সমীহের প্রতিপক্ষ। রফিক বলেন, 'না জেতা পর্যন্ত ক্রিকেটে কিছুই বলা যায় না। ওরা কিন্তু অনেক ভালো দল ছিল। স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, কেনিয়া, কানাডা তখনকার নামিদামি দল ছিল। যে কারণে জিতবই, এভাবে ভাবার সুযোগ ছিল না।'
বাংলাদেশকে তখন কেউ পাত্তাই দিত না জানিয়ে রফিক আরও বলেন, 'আমরা নতুন একটা দল ছিলাম, বাংলাদেশকে কেউ তখন পাত্তাও দিত না। আজ যে যত যাই বলুক, সেসব মিথ্যা। তখন বাংলাদেশকে কেউ পাত্তাই দিত না। সবাই জানত বাংলাদেশের সঙ্গে খেলা দিলে আমরা জিতব। কিন্তু যখন দেখল আমরা উন্নতি করছি বা ম্যাচ জিতছি, তখন আমাদেরকে অন্যভাবে দেখা শুরু হয়। ওই ম্যাচে স্কটল্যান্ডই ফেবারিট ছিল।'
সেই চার উইকেট নেওয়ার স্মৃতি এখনও তৃপ্তি দেয়? এমন প্রশ্নে রফিক দলগত পারফরম্যান্সের বিষয়টি তুললেন। বলতে লাগলেন, 'তখনকার আর এখানকার ক্রিকেট এক নয়। জেতার যে স্পৃহা বা ভালো করার যে ব্যাপার, সেটা অনেক বেশি ছিল তখন। ভালো খেলার স্পৃহাটা ওখান থেকেই জন্ম নেয়। বাংলাদেশ যে উন্নতি করছে, আইসিসি ট্রফিতেই বিশ্ববাসী দেখতে পায়। আমি চার উইকেট নিয়েছিলাম বলে আলাদা করে বলব তেমন নয়, আমি চার উইকেট নিয়েছিলাম বলে জিতেছিলাম, তেমনও নয়। আমি মনে করি, দলগত পারফরম্যান্সেই সেদিন বাংলাদেশ জিতেছিল।'
১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি, দ্বিতীয় সেমিফাইনাল
বাংলাদেশ-স্কটল্যান্ড
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২৪৩/৭ (পাইলট ৭০, বুলবুল ৫৭, নান্নু ৩৯*; জন ব্লেইন ২/৪৯, ইয়ান বেভেন ২/২৯)।
স্কটল্যান্ড: ৪৪.৫ ওভারে ১৭১/১০ (ইয়ান ফিলিপ ৩৭, গ্রেইগ উইলিয়ামসন ৩৯*; এনামুল হক মনি ৩/৩১, রফিক ৪/২৫)।
ফল: বাংলাদেশ ৭২ রানে জয়ী।
ম্যাচসেরা: খালেদ মাসুদ পাইলট।