অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে রাজনৈতিক সংকট সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলবে
দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে জনসমাবেশ ঘটিয়ে দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল তাদের প্রতি জনগণের আস্থার প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা করছে। সরকারের নানামুখী বাধা মোকাবিলা করে সমাবেশগুলোতে জনসমাগম হচ্ছে। সমাবেশের আগে আগে গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু, তাতে বিএনপি নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ বন্ধ করা যায়নি।
নেতাকর্মীরা যে যেভাবে পেরেছে দুই-একদিন আগেই সমাবেশস্থলে উপস্থিত হয়েছে। খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়ে সমাবেশ সফল করে তোলার চেষ্টা করছে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমনটি এর আগে দেখা যায়নি। অন্যদিকে, সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে নানান বাধা, গ্রেফতার, মামলা, হুমকি, পুলিশ দিয়ে নেতাকর্মীদের বাড়ি তল্লাশী, দলীয়ভাবে মোটরসাইকেল মহড়ার অভিযোগ থাকলেও- নেতাকর্মীদের আগমন বন্ধ হয়নি।
বিরোধীদলের জনসমাবেশকে প্রতিহত করার চেষ্টার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হলো, সমাজে ঐক্য সৃষ্টির সম্ভাবনা অধরাই থেকে গেল। বিশ্বব্যাপী একটি অর্থনৈতিক সংকট ধেয়ে আসছে। বিশ্বের প্রায় সকল অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আগামী বছরটি হবে মন্দার দিক দিয়ে আরো ভয়ংকর। সংকটের মূল কারণ ইউক্রেন- রাশিয়ার চলমান যুদ্ধকে চিহ্নিত করা হলেও, এখনো সেই যুদ্ধ অবসানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ বরং দীর্ঘায়িত হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ইউক্রেন-রাশিয়ার বাইরেও জ্বালানি খাতে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বব্যাপী। জ্বালানি ওপর আমদানি-নির্ভর দেশগুলো বাড়তি সংকটের মুখে পড়েছে, যেমনটি ঘটেছে আমাদের দেশে। পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার একটা সমঝোতার ধারণা সামনে নিয়ে এসেছে, যার মধ্যে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও চীনের প্রেসিডেন্ট এর কথোপকথন উল্লেখযোগ্য। এই আলোচনা- বিগত কয়েক বছর যাবত বাণিজ্য ক্ষেত্রে যে ধরনের নিষেধাজ্ঞা চলছিল চীনের ওপর- তা উঠিয়ে দেওয়ার একটা ইঙ্গিত কিনা- তা এখনো স্পষ্ট নয়। যদিও প্রেসিডেন্ট বাইডেন বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে 'তুমুল প্রতিযোগিতার' কথা খুব জোরের সাথে বলেছেন। তুমুল প্রতিযোগিতার কথা বললে তো অবশ্যই বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিতে হবে।
বিশ্ববাণিজ্য প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। আমদানি তুলনায় রপ্তানির ঘাটতি অনেক বছরের। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সেই আমদানির দায় মেটানোর উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কথিত উন্নয়নের সকল উৎসের মূল হচ্ছে প্রবাসী আয়। প্রবাসী আয়ের বৈদেশিক মুদ্রা প্রাপ্তিতেও সরকারের জন্য মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশ কয়েক মাস পূর্বেই বৈদেশিক মুদ্রার বাড়তি যোগানের প্রত্যাশায় বাংলাদেশ ব্যাংক অতিরিক্ত মূল্য প্রদানের ঘোষণা দেয়। কিন্তু, এখন দেখা যাচ্ছে, প্রবাসী আয়ের ওপর তা উল্টো ফল দিচ্ছে।
হুন্ডি এখনও প্রবাসীদের কাছে লাভজনক। এদের নিয়ন্ত্রণ সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। এরা দেশে এবং বিদেশে এমন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে যে, সরকারের পক্ষে তাদের লেনদেন আটকানো খুবই কঠিন। দেশে যখনই কোনো রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি হয়- তখনই একশ্রেণির মানুষ দেশ থেকে অর্থাৎ অর্থপাচার বাড়ায় যা বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত। এই অবৈধ আয় বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তরিত করে পৃথিবীর নানান দেশে পাঠায়।
অন্যদিকে, আমাদের প্রবাসীরা তাদের সহায়সম্বল বিক্রি করেই বিদেশে কাজের আশায় পাড়ি জমায়। হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন লাভজনক হলে- সেখানেই যে তারা ঝুঁকবে সেটাই স্বভাবিক।
দেশের আমদানি ও রপ্তানি আয়ে ভারসাম্য আনার জন্য অনেকদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে, কৃষি ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা, যাতে কৃষিপণ্য আমদানি করতে না হয়। জ্বালানির ক্ষেত্রেও তাই। নিজস্ব গ্যাস ও কয়লার উপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে আমদানি কমিয়ে ডলার মজুদ বাড়িয়ে তোলা। কিন্তু, এগুলো করা সম্ভব হচ্ছে কি?
প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিচ্ছেন, সামনের মাসেই সংকট কেটে যাবে। কিন্তু, এখনও ব্যাংকগুলো এলসি খুলছে না। স্বাভাবিক আমদানি-রপ্তানি করা না গেলে অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশ পরিত্রাণ পাবে না। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা দরকার। জ্বালানি খাতেই আমাদের অন্যতম বড় ব্যয়টা হচ্ছে। নিজস্ব জ্বালানি ব্যবস্থা গড়ে তোলা ও কৃষিপণ্য আমদানি পরিহার করার উপায় বের করতে হবে। দেশে এখনো নানান ভোগ্যপণ্যের বিজ্ঞাপন দেখতে পাওয়া যায়। উচ্চবিত্তদের বিলাসী পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তারও আগে প্রয়োজন- রাজনৈতিক সমঝোতা। তা নাহলে কোনো উদ্যোগই কাজে আসবে না।
আমরা জানি, জ্বালানি ক্ষেত্রে আজকের সংকটের মূল কারণ, আমাদের দেশের বিভাজিত রাজনীতি। আমাদের কাছে ৭০০ কোটি টন কয়লা মজুদ থাকার পরেও দেশের জ্বালানি খাত আমদানি-নির্ভর হয়ে চলছে। সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান প্রচেষ্টা নেই বললেই চলে। অভ্যন্তরীণ জায়গায় গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে, তার যথাযথ সঞ্চালনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। ভোলার গ্যাস দেশের অন্যান্য অংশে ব্যবহার করার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এই জায়গাগুলোতে দ্রুত নজর দিতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো- দেশের অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে রাজনৈতিক সংকট যদি বৃদ্ধি পায়- তাহলে অর্থনৈতিক সংকট যেমন সাধারণ মানুষের জীবনকে সংকটময় করে তুলবে; তেমনি রাজনৈতিক সংকটের তীব্রতাও সমানতালে বাড়বে। ক্ষমতা দখলের এই লড়াই সাধারণ মানুষের আরো ভাগ্য বিপর্যয় ঘটাবে।
আজকে যারা বিভাগীয় শহরগুলোতে সমাবেশ ঘটিয়ে সরকারের নির্বাচন ব্যবস্থা পাল্টানোর দাবি তুলছেন- তারা কেন স্বীকার করছেন না যে, কেবলমাত্র নির্বাচন ব্যবস্থা পাল্টানোই সংকটের সমাধান নয়। অতীতে তারাও ক্ষমতায় ছিলেন। সংকটের মূল কারণ আরো গভীরে।
হতদরিদ্র সাধারণ মানুষ যখন সংকটে পড়ে তখন তারা বিকল্প খোঁজে। কিন্তু, সেই বিকল্প যদি একই ধারার বিকল্প হয়, যে বিকল্প আমাদেরকে কোনো সমাধান দিতে পারেনি- তাহলে সে বিকল্প ব্যবস্থা আগামীদিনেও কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। জনসভাগুলোতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো কোনো অঙ্গকে সংস্কার করা দরকার, তা নিয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। আমরা জানি যে, আমাদের সংবিধানের নানান জায়গায় ঘাটতি আছে। সেসব বিষয়গুলোতে তাদের মত স্পষ্ট করে প্রকাশ করা উচিত।
পুলিশ কিংবা প্রশাসনকে ধমক দেওয়া ছাড়া বিকল্প কিছু শুনছি না। কী কারণে সরকার প্রশাসনের উপর এতটা নির্ভরশীল হয়, কোন আইনগুলোর পরিবর্তন হওয়া দরকার, রাষ্ট্র কাঠামোকে নিরপেক্ষভাবে পরিচালনার জন্য সেদিকে তাদের মনোযোগ দেখি না। কখনো প্রকাশ্যে উঠে আসে না, তারা সেগুলো সম্পর্কে কী করবেন আগামীতে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক