প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে রিয়াদ ইউসুফের গোল্ডম্যান স্যাকসের অংশীদার হয়ে ওঠার গল্প
বিগত ৬ বছরে গোল্ডম্যান স্যাকস রেকর্ড সংখ্যক অ-শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি ও নারীদের অংশীদার বানিয়েছে; প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় অধিভুক্ত বিভাগের অভিজাত পদে উন্নীত করেছে তাদের। একইসঙ্গে মার্কিন বহুজাতিক এই ব্যাংকিং জায়ান্ট নীরবে আরও একটি মাইলফলক অর্জন করেছে। দ্য ফিন্যান্সিয়াল নিউজ অবলম্বনে।
নভেম্বরে গোল্ডম্যানের দ্বিবার্ষিক প্রমোশন রাউন্ডে যে ৮০ জন জায়গা করে নিয়েছেন, তাদের মধ্যে একজন হলেন লন্ডনের রিয়াদ ইউসুফ। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তিনি গোল্ডম্যান স্যাকসের অংশীদার হয়েছেন। ব্যাংকের একজন মুখপাত্রসহ অভ্যন্তরীণ সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করেছেন এ তথ্য।
গোল্ডম্যানের ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা অঞ্চলের এমার্জিং মার্কেট সেলস (উদীয়মান বাজার) বিভাগের যুগ্ম-প্রধান হিসেবে কাজ করছেন ইউসুফ। ২০১১ সালে তিনি ডয়েচে ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন; সেখানে তিনি এমার্জিং মার্কেটের টার্ম স্ট্রাকচারিং টিমের প্রধান ছিলেন।
ইউসুফের বাবা-মা উভয়েই ছিলেন শিক্ষক। তিনি বাংলাদেশে বড় হলেও পরে আমেরিকায় পাড়ি জমান। তিনি যখন ১৬ বছরের কিশোর, তখন তার বাবা গবেষণার কাজে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে যাওয়ার সুযোগ পান। এরপরই পশ্চিমে পাড়ি জমাতে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন করতে শুরু করেন ইউসুফ। অবশেষে, মেইনের বেটস কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান তিনি। গণিত এবং পদার্থবিদ্যা নিয়ে তিনি পড়াশোনা শেষ করেন। নিজের টিউশন খরচের জন্য স্কলারশিপের ব্যবস্থা হলেও অন্যান্য খরচ যোগাতে সপ্তাহে ২০ কর্মঘণ্টার একটি চাকরি নিতে হয়েছিল তাকে।
নিজের আর্থিক অবস্থার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইউসুফ বলেন, "আমেরিকায় আমার তৃতীয় বছরে, একজন এসে বললেন, 'নিউ ইয়র্ক শহরে এই গ্রীষ্মের জন্য ১০ হাজার ডলারের একটি চাকরির অফার আছে, আপনি কি কাজটি আগ্রহী?' আমি এমনকি জিজ্ঞাসাও করিনি যে, আমাকে কী কাজ করতে হবে।"
"কারণ আমার ওপর ঋণের বোঝা ছিল অনেক। তখন প্রায় চার বছর চলে বাবা-মায়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়না। আমি বাড়ি যেতে চেয়েছিলাম; তাই অতকিছু না ভেবেই ইন্টারভিউ দিলাম এবং মেরিল লিঞ্চের সেই চাকরিটি আমি পেয়েছিলাম," যোগ করেন ইউসুফ।
১৯৯৯ সালে গ্রীষ্মকালীন ওই ইন্টার্নশিপটির মাধ্যমে মেরিল লিঞ্চ কোম্পানিতে ইউসুফের একটি ফুল টাইম বন্ড ট্রেডিং পজিশন সুরক্ষিত হয়; অর্থাৎ, চুক্তির ভিত্তিতে ফুল টাইম কাজ করার সুযোগ পান তিনি। এ সময় প্রতিষ্ঠানটিও ক্রমেই বেড়ে উঠছিল।
ইউসুফ বলেন, "আমার জন্য এক কঠিন জায়গা ছিল সেটি, আমি অনেকটা ডাঙায় থাকা মাছের মতো খাবি খাচ্ছিলাম। কারণ আমি মাত্রই সেখানে গিয়েছি এবং কাজ সম্পর্কে সত্যিই অতটা বুঝে উঠতে পারিনি। তবে কঠোর পরিশ্রমের ইচ্ছা ছিল আমার মধ্যে এবং এর জন্য যা যা লাগে তাই করতে রাজি ছিলাম আমি; কারণ কাজ করতে না পারা মানে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়া এবং সেই বিকল্প আমার ছিল না।"
যদিও টাকার জন্য কাজ শুরু করেছিলেন তিনি, তবে বাবা-মায়ের কাছ থেকে পড়াশোনার জন্য কিছুটা চাপ পেয়েছিলেন ইউসুফ। নিজেদের এলাকায় তার বাবাই ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করা প্রথম ব্যক্তি। সেই হিসেবে, তার ওপরেও মন দিয়ে পড়াশোনা করার চাপ ছিল।
তিনি বলেন, "বাংলাদেশি সাংস্কৃতিতে ব্যাংকিং পেশাকে খুব কাঙ্ক্ষিত পেশা হিসেবে দেখা হয় না। ডাক্তার, আইনজীবী, প্রকৌশলী কিংবা অধ্যাপনা সেদেশে আদর্শ পেশা; কিন্তু ব্যাংকিং সেখানে এমন কোনো পেশা নয়, যার জন্য বাবা-মা আপনাকে অনুপ্রাণিত করবে।"
ইউসুফ বলেন, চলতি বছরে যখন পার্টনারশিপ ক্লাস ঘোষণা হয়, তখন আমার মা বিষয়টি বুঝতে গুগল করেছিলেন, 'গোল্ডম্যান স্যাকসের অংশীদার হওয়ার অর্থ আসলে কী?'
"এখন তিনি আমাকে নিয়ে গর্বিত এবং উৎফুল্ল," যোগ করেন ইউসুফ।
২০২০ সালে মার্কিন পুলিশের হাতে খুন হন জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি। সেই কলঙ্ক ঘোচাতে ও সমতা প্রতিষ্ঠায় এরপর থেকে অনেক কৃষ্ণাঙ্গ লোককে নিয়োগ দিয়েছে মার্কিন ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈচিত্র্যতা আনতে ও তাদেরকে শক্তিশালী করতে আরও অ-শেতাঙ্গ কর্মীকে নিয়োগ দিতে হবে।
আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ডাইভার্সিটি গ্রুপ রিবুটের প্রতিষ্ঠাতা নোরীন বিডল শাহ বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাকিস্তানি এবং বাংলাদেশিদের প্রতি কম সময় ও মনোযোগ দেওয়া হয়; যদিও তারা যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যার ৩ শতাংশ।
"প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের প্রতিনিধিত্ব কম। তারপরেও ওএনএস (অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিকস) ডেটা এবং অ্যাডহক স্টাডির বাইরে এই কম প্রতিনিধিত্বশীল জনগোষ্ঠীর প্রতি খুবই কম সময় এবং মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তারা। তাই তাদের ওপর আরো মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন," বলেন তিনি।
ইউসুফ বলেন, বাংলাদেশে এখনও ভারত ও পাকিস্তানের মতো 'বিশ্বমানের স্কুল' নেই, যেখানে নির্দিষ্টভাবে আর্থিক খাতের পড়াশোনা করানো হবে। অধিকন্তু, বাংলাদেশের ব্রিটিশ সম্প্রদায় প্রায়শই এমন এলাকা থেকে আসেন যেখানে সামাজিক গতিশীলতার অভাব রয়েছে, যা আর্থিক খাতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, "বিশেষ করে বাংলাদেশি ছেলেমেয়েরা যারা ট্রেডিং ফ্লোরে থাকতে চান, তারা প্রায়ই কিছুটা পরিচিতি সংকটে ভোগেন। কারণ তারা মনে করেন, যারা অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ থেকে ঘুরে এসেছেন, তারা তাদের অন্তর্গত নন; যদিও ধারণাটি ভুল।"
২০২৫ সালের মধ্যে ৭ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ কর্মী নিয়োগের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে গোল্ডম্যান স্যাকস। সে লক্ষ্য পূরণেই ২০২২ সালে ঘোষিত ৮০ জন অংশীদারের মধ্যে ২৩ জন নারী এবং ২৮ জন অ-শ্বেতাঙ্গ লোকের নাম ঘোষণা করেছে সংস্থাটি। এরমধ্যে আবার ৭ জন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিও রয়েছেন। এছাড়া, পদোন্নতিপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন দুজন এলজিবিটি প্লাস পরিচয়ধারী।
২০০৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গোল্ডম্যানের সিইও ছিলেন লয়েড ঙ্কফেইন। ২০১৮ সালের শেষে ব্ল্যাঙ্কফেইনের জায়গায় ব্যাংকের দায়িত্ব নেন ডেভিড সলোমন। সিইও হওয়ার পর সলোমন বলেন, তিনি অংশীদারদের ভূমিকায় আরও নির্বাচনী হতে চান। ২০২০ সালে গোল্ডম্যান মাত্র ৬০ জন অংশীদারের নাম ঘোষণা করে; ১৯৯০ এর দশকের পর সেবারই সবচেয়ে কম অশীদারের নাম ঘোষণা করা হয়।