১৬ কোটি মানুষকে তিন মাস খাওয়ানো যাবে– এ পরিমাণ খাদ্য নষ্ট হচ্ছে প্রতিবছর
জলবায়ু সংকটের চরম প্রভাব, যুদ্ধ এবং মহামারির কারণে ব্যাপক খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ার সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছে বারবার। তারপরও ভাগাড়ে বাড়ছে খাদ্য বর্জ্যের স্তূপ। ধনী দেশগুলোর কাছে এটি মিথেন গ্যাস নিঃসরণ বৃদ্ধির মতো জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত উদ্বেগ। কিন্তু, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য– বছরে ১.৪৫ কোটি টন খাদ্য অপচয়– দুর্ভিক্ষের আসন্ন হুমকির মতোন গুরুতর।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘের তথ্যমতে, নষ্ট নাহলে এই খাদ্য দিয়ে ১৬ কোটি মানুষকে তিন মাস খাওয়ানো যেত।
অথচ মাঠ থেকে শস্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে গুদামজাতকরণ এবং সেখান থেকে পরিবহন পর্যায়ে খাদ্যের অপচয় কমাতে সরকারের ছিল দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন কর্মসূচি। এসব কর্মসূচিতে ফসল সংগ্রহ পর্যায়ে দুর্বলতার মতো বিষয় দূরীকরণকে অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে রাখা হয়। এমন একটি পাইলট প্রকল্প সাফল্যের মুখও দেখেছিল।
কিন্তু, তাতে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি তারপরে। এদিকে বারবার বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের হুঁশিয়ারি দিচ্ছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও বা ফাও)। এই বাস্তবতায়, জনগণকে সম্ভাব্য খাদ্য সংকটের বিষয়ে সতর্ক করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে বিপুল অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তাল মেলাতে পারছে না খাদ্য উৎপাদন। গত অর্থবছর নাগাদ- গত ১১ বছরে ধান ও গমের মতো প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন ১৩.৩৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৯০ লাখ টনে। একই সময়ে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে ১৪.৬৬% হারে।
পাশাপাশি মাঠ থেকে খাবার টেবিল পর্যন্ত আসতে- একাধিক পর্যায়ে নষ্ট হচ্ছে বাড়তি উৎপাদিত খাদ্যের উল্লেখযোগ্য অংশ।
বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির খাদ্য অপচয় সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ফসলের মাঠ থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত আসতে প্রতিবছর দেশে ৩৭ লাখ টনের বেশি খাবার নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে, বাড়িতে খাবার অপচয়ের বার্ষিক পরিমাণ প্রায় ১.০৭ কোটি টন। বার্ষিক অপচয় ও নষ্টের মোট পরিমাণ ১ কোটি ৪৫ লাখ টন।
টেবিলে খাবার নষ্ট হচ্ছে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি
রান্নাঘর থেকে পরিবেশন পর্যায়ে অপচয় হওয়া খাদ্যকে বলা হয় টেবিল পর্যায়ের অপচয়।
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) ২০২১ সালের ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স সূচক প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি বছর মাথাপিছু ৬৫ কেজির মতোন খাবার অপচয় হয়, যা অনেক উন্নত দেশের চেয়েও উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
যেমন যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু খাদ্য অপচয়ের পরিমাণ ৫৯ কেজি, রাশিয়ায় ৩৩, আয়ারল্যান্ডে ৫৫, নিউজিল্যান্ডে ৬১ এবং জাপানে ৬৪ কেজি।
বিশ্বে প্রতিবছর ৯৩ কোটি টনের বেশি খাবার নষ্ট করা হয়, যার বেশিরভাগই শেষপর্যন্ত ভূমি-ভরাট ভিত্তিক আবর্জনার ভাগাড়ে যায় বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
বার্তাসংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৫ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডসহ মাথাপিছু হারে শীর্ষ পাঁচ খাদ্য অপচয়কারী দেশের খাদ্য অপচয় বাড়ছে। এতে করে, ২০৩০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক খাদ্য অপচয় অর্ধেকে নামিয়ে আনার প্রচেষ্টাও প্রায় সম্পূর্ণ পথচ্যুত হয়েছে।
খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতিতে যখন ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠছে– তখন এই ঘটনা বাংলাদেশসহ মধ্য-আয়ের দেশগুলোর জন্য মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনছে বলে মন্তব্য করেন কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম খান।
তিনি বলেন, গৃহস্থালি পর্যায়ে (রান্নার পর) খাবারের অপচয়ের হার বাংলাদেশে প্রায় ২৫ শতাংশ। 'পল্লী অঞ্চলে নষ্ট হওয়া খাবারের একটা বড় অংশ হাঁসমুরগি ও গবাদি পশুর খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু, শহরে বাড়তি খাবারের পুরোটাই চলে যাচ্ছে ডাস্টবিনে'।
সাবেক কৃষিসচিব আনোয়ার ফারুক টিবিএসকে বলেন, জনসংখ্যায় প্রতিবছর নতুন করে যোগ হওয়া ২০ লাখ মানুষের জন্য অন্তত ৬ লাখ টন বাড়তি খাবার দরকার। এর বিপরীতে প্রধান খাদ্যশস্যের মোট উৎপাদন বাড়ছে ২-৩ লাখ টন করে। এর ফলে আমাদের খাদ্যের ঘাটতিও প্রতিবছরই প্রসারিত হচ্ছে।
'উৎপাদন ৫ শতাংশ বাড়াতে যে পরিমাণ অর্থ ও শ্রম ব্যয় করতে হয়, এর অনেক কম বিনিয়োগেই খাবারের ৫ শতাংশ অপচয় কমানো সম্ভব। আর এটা করা গেলেই আমদানি না করে উল্টো চাল রপ্তানি করা যাবে' বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ফসলের মাঠ থেকে খাবারের থালা, খাদ্যের অপচয় সবখানেই
সনাতন ফসল সংগ্রহ পদ্ধতির কারণে প্রতিবছর উৎপাদিত ধান, গম, ভুট্টা, আলু, নানান রকম ডাল, সরিষা, হলুদ ও মরিচের ৭.৩৩ শতাংশ নষ্ট হয়– সংগ্রহ এবং মাড়াই পর্যায়ে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুসারে, ২০১৮ সালে নষ্ট ও অপচয় হওয়া ফসলের বাজারমূল্য ছিল প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আউশ ধানে সর্বোচ্চ ৮.৯৩% ক্ষতি হয় মাড়াই পর্যায়ে, আর সবচেয়ে কম ৫.৮২% ক্ষতি হয়েছে ভুট্টায়।
অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম খানও মাঠ পর্যায়ে খাদ্য অপচয়ের মূল কারণ হিসেবে ফসল সংগ্রহে সনাতন পদ্ধতির ব্যবহারকে দায়ী করেন। তিনি জানান, ইদানীং ধান ও গম ফসল সংগ্রহে কম্বাইন্ড হারভেস্টর এর মতোন আধুনিক কৃষিযন্ত্র ব্যবহার শুরু হলেও– অন্যান্য ফসলে আগের পদ্ধতিই রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, 'অপচয় কমাতে অন্যান্য ফসল সংগ্রহেও যান্ত্রিকতায় গুরুত্ব দিতে হবে। এটি বাড়াতে উদ্যোগ বিস্তার ও ভর্তুকির মতো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত সরকারের'।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)-র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাজার ব্যবস্থাপনার অভাব, ফসলের বৈচিত্র্যহীনতা এবং দুর্বল পরিবহন ও গুদাম অবকাঠামোর কারণে বাংলাদেশের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের অর্ধেকের কম মূল্য পান।
অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, 'আমাদের উৎপাদিত ফসলের ৩৫-৪০ শতাংশ পথে ও বাজারে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পচে যাওয়া ফল ও সবজির দাম যোগ হয়ে ভোক্তা পর্যায়ে দামও বেড়ে যায়'।
ঢাকার সবচেয়ে বড় কাচাবাজার- কারওয়ানবাজারের ব্যবসায়ী ও ট্রাক চালকেরা জানান, বিভিন্ন ধরনের ফসল নষ্টের মাত্রাও ভিন্ন ভিন্ন হয়। যেমন আলুর ক্ষেত্রে প্রতি ৬০ কেজির বস্তায় ১২ কেজি পর্যন্ত নষ্ট হয়। পেঁয়াজের প্রতি মণে (৪০ কেজি) তা সর্বোচ্চ ১৫ কেজি পর্যন্ত হতে পারে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, শস্যক্ষেত থেকে স্থানীয় বাজার পর্যন্ত ফসল নিতে দেশের ৪৫.৭১ শতাংশ কৃষককে এখনও ভগ্নপ্রায় ও কাচা রাস্তা ব্যবহার করতে হয়।
দেশে বেসরকারি কোল্ড স্টোরেজ আছে ৪১৪টি, যার ৯৫ শতাংশ সক্ষমতা ব্যবহার হয় আলু সংরক্ষণে। বাকি ৫ শতাংশ ফল ও মাছ সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয় বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন।
গত কয়েক বছরে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য হিমাগার করেন কিছু উদ্যোক্তা। কিন্তু, লোকসানের শিকার হওয়ায় তাদের অনেকেই এখন সেগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন। এমন একজন বিনিয়োগকারী রাজশাহীর ফজলুর রহমান জানান, টানা দুই বছর ধরে লোকসান গুনে তিনি পেঁয়াজ সংরক্ষণ বন্ধ করে দিয়েছেন।
দেশব্যাপী খাদ্য অধিদফতরের বিভিন্ন গুদামে মোট ১৮ লাখ টন চাল ও গম সংরক্ষণের ক্ষমতা রয়েছে। এসবের অধিকাংশই এখন ভগ্নদশার, ভেতরের স্যাঁতসেঁতে পরিবেশের কারণে গোডাউনের ভেতরেই অনেক খাবার পচে যাচ্ছে। বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে খাদ্য অধিদফতরের আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার নির্মাণ প্রকল্পের প্রস্তাবনায়।
এতে বলা হয়, সরকারি এসব গুদামে ইঁদুরের উপদ্রুপেও অনেক খাবার নষ্ট হচ্ছে।
এই সমস্যার সমাধানে আটটি ইস্পাতের সাইলো নির্মাণের কাজ শেষ হয়নি ৮ বছরেও। গোডাউন সংস্কারের কাজেও আসেনি গতি।
সরকারি উদ্যোগে ধারাবাহিকতা নেই
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাসমূহের (এসডিজি)'র একটি হলো– কৃষি উৎপাদনে টেকসইতা বাড়িয়ে ২০৩০ সাল নাগাদ খাদ্য অপচয় অর্ধেকে নামিয়ে আনা।
এর সাথে সঙ্গতি রেখে সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ফসল সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ, প্যাকেজিং ও পরিবহনে বিভিন্ন উন্নয়নের সুপারিশ করা হয়।
২০২০ সালে অনুমোদন পায় এসংক্রান্ত মাস্টারপ্ল্যান। এতে সংরক্ষণাগারের ঘাটতি, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাতকরণ, উৎপাদন পরবর্তী ব্যবস্থাপনা, রেফ্রিজেরেটর ভ্যান ও হিমাগারকে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে কৃষি প্রক্রিয়াকরণকে শক্তিশালী করার তাগিদ দেওয়া হয়।
কিন্তু, গত কয়েক বছরে পুরো কৃষি সরবরাহ চক্রে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। যেমন ২০১৬ সাল থেকে নীলফামারিতে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ জোন প্রতিষ্ঠার আলোচনা চললেও– এখনও মাঠপর্যায়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশের ২৭ জেলায় এডিবির অর্থায়নে বাস্তবায়িত উচ্চমূল্যের ফসল চাষের প্রকল্পটি সাফল্যের মুখ দেখেছিল। সরকারি পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই প্রকল্পটি কৃষকদের আয় বাড়াতে এবং সবজি চাষে অপচয়ের পরিমাণ প্রায় ১৯ শতাংশ কমাতে ভূমিকা রাখে।
কিন্তু, দুইটি পর্যায়ে বাস্তবায়নের পর সফল এই কর্মসূচির ধারবাহিকতা আর রক্ষা করেনি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর।
অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক এম হামিদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'স্বাধীনতার পর থেকেই দেশে খাদ্যের ব্যাপক ঘাটতি থাকায়– কেবল উৎপাদনেই বাড়তি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এর ফলে কৃষি সংক্রান্ত প্রায় সব প্রকল্পেরই মূল উদ্দেশ্য ছিল শুধু উৎপাদন বৃদ্ধি'।
তবে ঘাটতির পরিমাণ অনেকটা কমে আসায়- উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি এখন অপচয় রোধ করার সময় এসেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব সায়েদুল ইসলাম বলেছেন, খাদ্য অপচয় রোধে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ সক্ষমতা বাড়াতে সরকার একাধিক প্রকল্পের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, 'বিভাগীয় পর্যায়ে ফল ও সবজি সংরক্ষণে শূন্য কার্বন নিঃসরণ প্রযুক্তির হিমাগার তৈরি করা হবে। বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকলেও- টানা সাতদিন পর্যন্ত পচনশীল পণ্য এখানে টাটকা থাকবে'।
পাশাপাশি ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পও খাদ্যের অপচয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমাবে বলে জানান তিনি।
সচিব বলেন, দ্রুত নগদ অর্থের দরকার থাকায় ফসল সংগ্রহের মওসুমে অনেক কৃষককেই নামমাত্র মূল্যে ফসল বিক্রি করতে হয়। এজন্য সরকার তাদের কৃষি ঋণ দেবে, যাতে তারা পরবর্তীতে বুঝেশুনে ভালো দামে বিক্রি করতে পারে। এ ছাড়া, কৃষকদের বাজার প্রবেশের সুবিধা বাড়াতে আগামী মার্চ থেকে একটি কৃষি রূপান্তর প্রকল্প শুরু করবে মন্ত্রণালয়।