আফ্রিকার কোনো দেশই কখনো বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে যেতে পারেনি কেন?
১৯৩০ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের যাত্রা শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ১৩টি আফ্রিকান দেশ এতে অংশগ্রহণ করেছে। এগুলোর মধ্যে কেবল তিনটি দেশ সর্বোচ্চ কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছে: ক্যামেরুন ১৯৯০ সালে, সেনেগাল ২০০২ সালে, ও ঘানা ২০১০ সালে।
ইউরোপের ঘরোয়া ফুটবলে এখন অনেক আফ্রিকান খেলোয়াড় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাও কেন তাদের জাতীয় দলগুলো এখনো পেছনে পড়ে আছে?
'সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফ্রিকান খেলোয়াড়েরা অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠছেন। তারা খেলছেন বিশ্বের সেরা কিছু ফুটবল ক্লাবের হয়ে। এদের অনেকে ব্যালন ডি'অরের দৌড়েও নেমেছেন। এগুলো আফ্রিকার ফুটবলকে সমৃদ্ধ করেছে,' বলেন মরক্কোর সাবেক আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় ইয়াসিন আবদেসাদকি।
তবে তিনি মনে করেন, এখনো অনেক প্রভাবক রয়েছে যেগুলো আফ্রিকার দলগুলোকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এগোতে দিচ্ছে না।
মানসিকতা
ইয়াসিন আবদেসাদকি মনে করেন, আফ্রিকার দলগুলো নিজেদের তারকা খেলোয়াড়দের দক্ষতার ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর করে। ফলে খেলার অন্য দিকগুলো আড়ালে পড়ে যায়।
'সাংস্কৃতিক দিক থেকে দেখলে, ইউরোপ ও আমেরিকায় যেসব ব্যাপারকে আদর্শ হিসেবে দেখা হয়, আফ্রিকায় সেগুলো নিয়ে কাজ করা হয় না। বিশেষত, মানসিক দিকগুলো,' বলেন তিনি।
আবদেসাদকি মনে করেন, চাপের মুহূর্তে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়টিও জানেন না বল নিয়ে তিনি কী করবেন। এটা মানসকি প্রস্তুতির একটি গুণ, যা মাঠের নৈপুণ্যের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
'স্পেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম বা ব্রাজিলের মতো দলের খেলোয়াড়েরা চাপের মুহূর্তেও বলের ওপর গায়ের জোরে খেলেন না, বরং তাদের নির্দিষ্ট পরিকল্পনায় অটুট থাকেন। অন্যদিকে কম প্রস্তুত দলগুলোর খেলোয়াড়েরা চরম মুহূর্তে বলকে লাথি মেরে দূরে পাঠিয়ে দেন,' বলেন তিনি।
ভিশন গড়ে তোলা
আফ্রিকার জাতীয় দলগুলো যে আরেকটি সমস্যায় ভোগে তা হচ্ছে সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব।
সাবেক তিউনিসিয়ান ডিফেন্ডার করিম হাগুই বলেন, 'আপনি ইচ্ছে করলেই হুট করে একদিন কোনো টুর্নামেন্টে যোগ দিয়ে তারপর কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার মতো বিরাট কোনো লক্ষমাত্রা ঠিক করে ফেলতে পারেন না।'
করিমের মতে, আফ্রিকার দলগুলোর দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা নেই।
'প্রশিক্ষণ কৌশল থাকতে হবে। আফ্রিকায় ফুটবলের লেভেল বাড়াতে কাজ করতে হবে, কোচদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে,' তিনি বলেন।
সাবেক উলফসবার্গ ডিফেন্ডার হানস সার্পেইও একই মত পোষণ করেন। তিনি মনে করেন, আফ্রিকান ফেডারেশনকে আরও বেশি মনোনিবেশ করতে হবে। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পৌঁছানোর মতো লক্ষ্য ১০-১২ বছর আগে থেকেই পরিকল্পনা করে ঠিক করতে হবে।
সার্পেই বলেন, 'একেবারে শতভাগ নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে এ পদ্ধতি কাজ করবে। কিন্তু আপনি যদি জার্মানি বা ফ্রান্সকে দেখেন, তারা এ পদ্ধতি অবলম্বন করেই কাজ করেছে।'
কম সম্পদ, কম সুযোগ
একটি দলকে গড়ে তুলতে সময়ের পাশাপাশি অর্থেরও দরকার। এক্ষেত্রেও ইউরোপ বা আমেরিকার দলগুলোর তুলনায় যোজন যোজন পিছিয়ে আফ্রিকার দলগুলো।
২০২১ সালে ফ্রেঞ্চ ফুটবল ফেডারেশনের মোট বাজেট ছিল প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ইউরো। সেদিক থেকে তুলনা করলে, ২০২০ সালে ক্যামেরুন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের বাজেট ছিল কেবল ১২.৭ মিলিয়ন ইউরো।
তবে অর্থের পাশাপাশি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করা দলের সংখ্যাও একটি বাধা। আবেসাদকি বলেন, 'এটা সম্ভাবনার প্রশ্ন। ইউরোপ বা আমেরিকার তুলনায় বিশ্বকাপে আফ্রিকার কম দল খেলে। তাই পরিসংখ্যানগত বিবেচনায় আফ্রিকার দলগুলোর সেরা চারে ওঠার সম্ভাবনা কম।'
অভিজ্ঞতায়ও পিছিয়ে
১৯৯৮ সালে প্রথমবারের মতো আফ্রিকান ফেডারেশনের জন্য পাঁচটি স্লট রাখা হয় বিশ্বকাপে। তার আগ পর্যন্ত কেবল তিনটি আফ্রিকান দল বিশ্বকাপে খেলতে পারত।
অর্থাৎ আফ্রিকার সবচেয়ে সেরা দলটিরও বিশ্বকাপের মঞ্চে বিশেষ অভিজ্ঞতা নেই। আফ্রিকার দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি আটবার বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছে ক্যামেরুন। তা সত্ত্বেও ইউরোপ বা আমেরিকার সেরা দলগুলোর অর্ধেক অভিজ্ঞতাও নেই ক্যামেরুনের।
একটু ভিন্ন চাপ
আফ্রিকান দেশগুলোর ওপর প্রত্যাশা একটু বেশি বলেই মনে করেন হ্যান্স সার্পেই।
'জার্মানির ক্ষেত্রে সবাই আশা করে তারা বিশ্বকাপ জিতবে। কিন্তু আফ্রিকার ক্ষেত্রে সবাই চায় দেশগুলো যেন অবশ্যই বিশ্বকাপ জেতে। ইউরোপে খেলা আফ্রিকান খেলোয়াড়েরা চাপ সামলাতে পারেন, কিন্তু যখন পুরো দেশ চায় দল জিতুক, তখন ব্যাপারটি একদম ভিন্নরূপ নেয়,' সার্পেই বলেন।
খেলোয়াড়েরা মনে করেন এ চাপ শুধু তাদের নয়, তাদের পরিবারের ওপরেও পড়ে। এসব খেলোয়াড়েরা জানেন দল বাদ পড়ে গেলে তারা প্রথমবার 'সরাসরি দেশে যেতে পারবেন না, বরং ইউরোপে নিজেদের ক্লাবে ফিরে যেতে হবে,' বলেন সার্পেই।
এ বছর কাতার বিশ্বকাপে খেলছে আফ্রিকার দেশ সেনেগাল, ক্যামেরুন, ঘানা, তিউনিসিয়া, ও মরক্কে।
সূত্র: ডয়েচে ভেলে