গ্যাস সংকটে কিভাবে টিকে থাকতে হয়, দেখিয়ে দিচ্ছে- নারায়ণগঞ্জের একটি টেক্সটাইল কারখানা
তীব্র গ্যাস সংকটে দেশের টেক্সটাইল মিলগুলো যখন উৎপাদন চালিয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছে, তার মধ্যেই নারায়ণগঞ্জের মিথিলা টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড- এর একটি অভিনব সমাধান খুঁজে পেয়েছে মালিকপক্ষের দূরদর্শী চিন্তার সুবাদে। ২০১৮ সালে কারখানাটিতে ধানের তুষ-চালিত একটি বয়লার স্থাপন করা হয়। সাধারণত রাইস মিলে চাল উৎপাদনের উপজাত হিসেবে পাওয়া যায় এই তুষ। আর তা দিয়েই এই সংকটকালে সচল থাকতে পারছে টেক্সটাইল মিলটি।
ফলে প্রতিমাসে ৪৫ লাখ গজ (ইয়ার্ড) ফ্যাব্রিক উৎপাদনের পাশাপাশি– কারখানাটি দেশের আরও দুটি শীর্ষ টেক্সটাইল মিলকে সহায়তা করতে পারছে, গ্যাস সংকটে যারা চরম দুর্বিপাকে পড়েছিল। ওই দুটি কারখানার জন্য মাসে প্রায় ১৫ লাখ গজ ফ্যাব্রিক প্রস্তুত ও ডায়িং করে দিচ্ছে মিথিলা টেক্সটাইল মিলস।
পরিবেশ সুরক্ষায় শীর্ষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৮ সালে বিশ্বে সর্বপ্রথম– ইউনাইটেড স্টেটস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) এর লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রোমেন্টাল ডিজাইন (লিড)- এর প্ল্যাটিনাম সনদ পায় মিলটি।
কারখানাটির মালিকরা জানান, ধানের তুষ দিয়ে বাংলাদেশে তারাই প্রথম টেক্সটাইল মিলের বয়লার পরিচালনা শুরু করেন। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের দুপতারা এলাকায় অবস্থিত এই কারখানা।
মিথিলা গ্রুপের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান– খান ফুড অ্যান্ড অটো রাইস মিলস লিমিটেড। সেখানে চাল উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন ধানের তুষ– অটোমেটিক মেশিনের সাহায্যে বাতাসের তীব্র চাপে আলাদা পাইপে চলে যাচ্ছে ডায়িং- এর বয়লার ইউনিটে। সেই তুষ বার্নারে পুড়িয়ে বাষ্প উৎপন্ন করা হচ্ছে, যা দিয়ে চলছে ফেব্রিকের ডায়িং।
আবার খান রাইস ব্র্যান্ডের চাল বিক্রি হচ্ছে নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
মিথিলা গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. আজাহার খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তার নিজস্ব অটোরাইস মিলে ঘন্টায় ১০ টন চাল উৎপাদন হয়, এখান থেকে তিন থেকে সাড়ে তিন টন ধানের তুষ পাওয়া যায়।
বর্তমানে লোডশেডিং বাদ দিয়ে দিনের বাদবাকী সময় চালু থাকে এই রাইস মিল "তুষ দিয়ে (টেক্সটাইল মিলের) এখন মোট সক্ষমতার প্রায় ৭০ শতাংশ চালু রাখতে পারছি। এর ফলে প্রতি মাসে প্রায় এক কোটি টাকার গ্যাস বিল বেঁচে যাচ্ছে"- বলছিলেন আজাহার।
টিকে থাকার ব্যয়বহুল উপায়
২০১৮ সালে সবুজ কারখানার স্বীকৃতি পাওয়ার পর থেকেই মিলটি তুষ-চালিত বয়লার ব্যবহার শুরু করে। এরপর অতিবাহিত সময়ে যেমন অনেক খরচ বাঁচানো গেছে, ঠিক তেমনি ব্যয়ও অনেকগুণ বেড়েছে।
২০১৮ সালে গ্যাসের কোনো সংকট না থাকার পরও– তুষচালিত বয়লার স্থাপনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে আজাহার বলেন, ভবিষ্যতের চিন্তা করেই তিনি এ সিদ্ধান্ত নেন।
"আমি ভেবেছিলাম- ভবিষ্যতে যদি কখনো গ্যাসের ক্রাইসিস হয় বা না পাওয়া যায়, তাহলে বিপুল বিনিয়োগের ডায়িং মিল তো বসিয়ে রাখা যাবে না। এ ছাড়া, ওই সময় তুষ দিয়ে বয়লার চালানোর ব্যয় গ্যাসের প্রায় সমান ছিল"- বলেন তিনি।
মিথিলা টেক্সটাইলের কর্তৃপক্ষের মতে, বর্তমানে গ্যাসের বদলে তুষ দিয়ে বয়লার চালানোর ব্যয় তিনগুণ বেশি।
যেমন বয়লারে এক টন বাষ্প তৈরি করতে এখন ৭১৪ টাকার গ্যাস খরচ হয়; অথচ ধানের তুষ দিয়ে তৈরির ক্ষেত্রে খরচ হয় ২ হাজার ১৯২ টাকা, কেননা এখন প্রতি কেজি তুষের বাজারমূল্য ১২ টাকা।
আজাহার আরও ব্যাখ্যা করে বলেন, আগে তুষ দিয়ে বয়লার চালানো অনেক বেশি লাভজনক ছিল, তারপরও এখন এটি সচল রাখা হয়েছে যাতে সময়মতো বায়ারদের পণ্য সরবরাহ করা যায়।
তিনগুণ বেশি ব্যয় সত্ত্বেও তুষ দিয়ে বয়লার চালানোর যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে আজাহার বলেন, আগে তুষ দিয়ে বয়লার চালানো অনেক বেশি লাভজনক ছিল, কিন্তু তারপরও এটা সচল রাখছি– কারণ বাড়তি ব্যয় হলেও এতে করে সময়মতো বায়ারদের পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হয়।
"আমরা নামকরা বিদেশি বায়ারদের সাথে কাজ করি। নির্ধারিত সময়ে তাদের চালান দিতে গিয়ে বর্তমানে পণ্যের ওভারহেড কস্ট (মাথাপিছু উৎপাদন ব্যয়) বেড়েছে এবং মুনাফার বদলে ব্রেক ইভেন পয়েন্টে (আয়-ব্যয় যখন সমান্তরাল) নেমে এসেছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা মানসম্পন্ন ফ্যাব্রিক সাপ্লাই দিতে পারছি, তাদের আস্থা ধরে রাখতে পেরেছি– বর্তমান ক্রাইসিসের সময়ে যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।অথচ একই সময়ে অনেক কারখানা কেবল গ্যাসের অভাবে অর্ডার নিতে পারছে না, কিংবা অর্ডার থাকলেও সময়মত সরবরাহ করতে পারছে না।"
এছাড়া ডায়িংয়ের সময়- গ্যাসের চাপ হঠাৎ কমে গেলে বা বিদ্যুৎ না পাওয়া গেলে- পুরো ডায়িং প্রক্রিয়ায় থাকা সব ফ্যাব্রিক নষ্ট হয়ে বিপুল আর্থিক লোকসান হয়। "কিন্তু এ প্রক্রিয়া যেহেতু নিজেদের কন্ট্রোলে, ফলে এতে ফ্যাব্রিক নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম থাকে"- বলেন তিনি।
টেক্সটাইল মিলে মূলত স্পিনিং, ডায়িং ইউনিট চালানোর জন্য গ্যাসের প্রয়োজন হয়।
গ্যাসের মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে, যা ক্যাপটিভ পাওয়ার নামে পরিচিত– স্পিনিং মিলগুলো চালানো হয়। আর একই প্রক্রিয়ায় বয়লারে স্টিম তৈরি করে তা ফেব্রিক ডায়িংয়ে ব্যবহার করা হয়। বড় আকারের টেক্সটাইল মিলগুলোতে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়, যা বিদ্যুৎ লাইন থেকে সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। এজন্য সরকার টেক্সটাইল মিল মালিকদের গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে নিজস্ব ব্যবস্থায় ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেশনে উৎসাহিত করে। এ প্রক্রিয়ায় চলছিল এতদিন দেশের স্পিনিং ও ডায়িং মিলগুলো।
একটি সবুজতর বিকল্প
উচ্চ খরচের হিসাব বাদ দিলে, তুষের ব্যবহার অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব ও কার্যকর। এ দিয়ে কারখানা চালানোর বেশকিছু সুবিধাও পাওয়া যায়।
পাশাপাশি এই দূরদর্শিতার ফলে চলমান সংকট সামাল দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে। ফলে গত ছয় মাসে তুষ-চালিত বয়লারটির ওপর মিলটির নির্ভরতাও বেড়েছে।
মিথিলা গ্রুপের চেয়ারম্যান আজাহার বলেন, "গ্রিন সার্টিফিকেট পাওয়ার শর্ত ছিল–অন্তত ১৫ শতাংশ এনার্জি সেভ করতে হবে। কিন্তু, তুষ ব্যবহারের ফলে আমরা ৮৬ শতাংশ পর্যন্ত এনার্জি সেভ করতে পারছি। পাশাপাশি, ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) এর মাধ্যমে ৫০ শতাংশ পানি পুনর্ব্যবহার করা হচ্ছে।"
তুষ-ভিত্তিক বয়লার ব্যবস্থা চালু করতে কী পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হয়েছে সেটি অবশ্য জানাননি আজাহার।
গ্যাস সংকট চলছেই
গ্যাস সংকট যখন চরম রূপ নেয়– তখন বাংলাদেশের টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন জানায়, এতে উৎপাদন ৪০ শতাংশ কমেছে। মিথিলা টেক্সটাইল মিলসের কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, ওই সময় সেখানে গ্যাসের কোনো চাপ ছিল না। কারখানা কর্তৃপক্ষ জানান, তাদের অনুমোদিত গ্যাসের প্রেশার ১৫ পিএসআই। সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কারখানায় গ্যাসের কোনো প্রেশারই থাকে না। রাত ১০টার পর থেকে সকাল ৬ টা পর্যন্ত মাত্র ১ থেকে ৩ পিএসআই প্রেশারে গ্যাস দেওয়া হয়।
টেক্সটাইল খাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তুষ ছাড়াও আরো কিছু উপায়ে বয়লার চালানো যায়।
লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. খোরশেদ আলম টিবিএসকে বলেন, নারিকেলের ছোবড়া, ভুট্টার ছোবড়া, গাছের পাতা, ডাল, তুলার বিচিও বয়লারের বাষ্প তৈরির জন্য ব্যবহার করা যায়। চীনে এ প্রযুক্তি রয়েছে। তবে বাংলাদেশে এসব প্রযুক্তি এখনও কেউ ব্যবহার করছে বলে জানা যায়নি।
এছাড়া কাঠকয়লা ব্যবহারের সুযোগও রয়েছে। অবশ্য এটি পরিবেশবান্ধব নয়।
মিথিলা গ্রুপের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যানুসারে, তাদের একটি উইভিং মিল, দুটি ডায়িং মিল এবং প্রিন্টিং ইউনিট রয়েছে। এছাড়া অটো রাইস মিল রয়েছে, যেখান থেকে উৎপাদিত তুষ যায় বয়লারে।
বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪২ বিলিয়ন ডলারের বেশি পোশাকপণ্য রপ্তানি করেছে। এরমধ্যে নিটওয়্যার ছিল ৮০ শতাংশ। উভেন পোশাকের প্রায় ৪০ শতাংশই স্থানীয় টেক্সটাইল মিলগুলো সরবরাহ করে।