জিতেও টানা দ্বিতীয়বার গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় চারবারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানির
উত্তেজনা, রোমাঞ্চ, অনিশ্চয়তা; কী থাকলো না ম্যাচে! ঝাঁঝালো লড়াইয়ে প্রতিটা মুহূর্ত থেকে ছড়ালো বারুদের গন্ধ। আশা-নিরাশার দোলাচোল চলতে থাকলো শেষ বাঁশি বাজা পর্যন্ত। অনেক সমীকরণ থাকায় একই সময়ে শুরু হওয়া জাপান-স্পেন ম্যাচের সঙ্গে দিতে হলো পাল্লা। তাই প্রথমার্ধ একভাবে শেষ করা জার্মানিকে দ্বিতীয়ার্ধে খেলতে হলো সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। কয়েকবার গোলের দেখাও মিললো, কোস্টারিকা গোলে গোলে জবাব দিলেও ব্যবধান থেকে গেল। কিন্তু এই ব্যবধান যথেষ্ট হলো না চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানির জন্য।
বৃহস্পতিবার রাতে আল বাইত স্টেডিয়ামে 'ই' গ্রুপের ম্যাচে কোস্টারিকাকে ৪-২ গোলে হারিয়েও কাতার বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নিলো পরাশক্তি জার্মানি। এ নিয়ে টানা দ্বিতীয়বার ফুটবলের মাহযজ্ঞের প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিলো তারা। ২০১৮ বিশ্বকাপে তাদেরকে বিদায় করে দেয় এশিয়ার দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। এবার তাদের বিদায়ের নেপথ্যে থাকলো এশিয়ার আরেক দেশ জাপানের সাফল্য।
স্পেনকে ২-১ গোলে হারিয়ে এই গ্রুপ থেকে শেষ ষোলোয় উঠেছে সূর্যোদয়ের দেশ জাপান। হেরেও গোল ব্যবধানে জার্মানির চেয়ে এগিয়ে থাকায় দ্বিতীয় রাউন্ডে গেছে স্পেন। তবে জাপান হারলে পরের রাউন্ডের টিকেট পেতো জার্মানি, এ ছাড়া গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে জাপানের বিপক্ষেই হেরেছিল তারা। নিজেদের বিশ্বকাপ ইতিহাসে তৃতীয়বার প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়লো জার্মানরা, এর মধ্যে টানা দুইবার। এ ছাড়া কেবল ১৯৩৮ বিশ্বকাপের (৮৪ বছর আগে) গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়েছিল জার্মানি। গ্রুপের চতুর্থ দল হিসেবে বিশ্বকাপ মিশন শেষ হলো মধ্য আমেরিকা অঞ্চলের দেশ কোস্টারিকার।
জয়ও অনর্থক হয়ে পড়া ম্যাচের পুরোটা সময় ছড়ি ঘুরিয়েছে জার্মানি। বেশিরভাগ সময়ে বল নিজেদের পায়ে রেখে একের পর এক আক্রমণ করে গেছে তারা। ৬৮ শতাংশ সময় বল দখলে রাখে জার্মানি। এ সময়ে অবিশ্বাস্যভাবে গোলমুখে ৩২টি শট নেয় তারা, এর মধ্যে ১১টি ছিল লক্ষ্যে। দুবার জালের ঠিকানা পাওয়া কোস্টারিকা গোলমুখে ৭টি শট নেয়, লক্ষ্যে ছিল ৫টি। জার্মানির পক্ষে জোড়া গোল করেন কাই হাভের্টজ। একটি করে গোল দেন সাগ্রে জিনাব্রি ও নিকোলাস ফুয়েলখুগ। কোস্টারিকার পক্ষে গোল করেন ইয়েতসিন তেহেদা, বাকি গোলটি আত্মঘাতী। জটলার মধ্যে জার্মান গোলরক্ষক ম্যানুয়েল নয়্যায়ের পায়ে লেগে বল তাদের জালে জড়ায়।
মাত্র এক পয়েন্ট নিয়ে খেলতে নামে জার্মানি, জয়ের বিকল্প না থাকায় শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতে থাকে দলটি। দ্বিতীয় মিনিটেই জার্মানির আক্রমণ। মুসিয়ালার শট ঝাঁপিয়ে কর্নারের বিনিময়ে ফেরান কোস্টারিকার গোলরক্ষক কেইলর নাভাস। সপ্তম মিনিটে ডি-বক্সের মধ্যে কোস্টারিকার খেলোয়াড়দের রীতিমতো ঘোরাতে থাকলেও গোলে শট নিতে পারেননি ১৯ বছর বয়সী এই তরুণ। নবম মিনিটে কিমিকের ক্রসে মুলারের হেড, একটুর জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
আক্রমণের ধারায় দশম মিনিটেই এগিয়ে যায় জার্মানি। বাঁ পাশ দিয়ে আক্রমণে গিয়ে ক্রস বাড়ান ডেভিড রাউম। দারুণ কৌশলী হেডে বল জালে জড়ান সার্গে জিনাব্রি। ১৪তম মিনিটে সতীর্থের বাড়ানো বলে হেড করেন গোরেটজকা, ফিরিয়ে দেন নাভাস। ফিরতি বলে আবার শট নিলে বারপোস্ট ঘেঁষে বেরিয়ে যায়। ২০তম মিনিটে মুসিয়ালার ক্রসে কেউ পা ছোঁয়াতে পারেননি, পরিষ্কার করেন কোস্টারিকার ডিফেন্ডার।
৩৬তম মিনিটে মুসিয়ালার শট একটুর জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। তিন মিনিট পর জিনাব্রির শট বার ঘেঁষে বেরিয়ে যায়। ৪২তম মিনিটে আচমকা আক্রমণ সাজায় কোস্টারিকা, দারুণ সুযোগ ছিল সমতায় ফেরার। মাঝমাঠ থেকে লম্বা করে বাড়ানো বল নিয়ন্ত্রণে নিতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেন রুডিগার। সেই সুযোগে বল নিয়ে ডি-বক্সে ঢুকে জোরালো শট নেন কেশার ফুলার। দারুণ দক্ষতায় কর্নারের বিনিময়ে দলকে বাঁচান ম্যানুয়েল নয়্যার।
৪৫তম মিনিটে ডি-বক্সের বাইরে থেকে জার্মানির সানের নেওয়া শট উপর দিয়ে চলে যায়। দাপুটে ফুটবল খেলে প্রথমার্ধ শেষ করে জার্মানি। এ সময় অবিরত আক্রমণে কোস্টারিকাকে দিশেহারা করে রাখে তারা। ৭১ শতাংশ সময় বল দখলে রেখে গোলমুখে ১২টি শট নেয় চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা, এর মধ্যে ৪টি ছিল লক্ষ্যে। আক্রমণ ফেরাতেই ব্যস্ত থাকা কোস্টারিকার নেওয়া একটি শট লক্ষ্যেই ছিল।
দ্বিতীয়ার্ধে আক্রমণের ধার বাড়ায় জার্মানি, যা তাদের দিকে বিপদ যেকে আনে। ১২ মিনিটের ব্যবধানে দুটি গোল হজম করে তারা। ৫৮তম কেন্ডাল ওয়াস্টনের হেড ঠিকভাবে ফেরাতে পারেননি জার্মান গোলরক্ষক নয়্যার। আলগা বল পেয়ে সহজেই বল জালে জড়ান তেহেদা। ৭০তম মিনিটে আচমকা আক্রমণে এগিয়ে যায় কোস্টারিকা। ফ্রি-কিক থেকে উড়ে আসা বলে ভার্গাস বল ভলি করতে গিয়েছিলেন। তার পায়ে লেগে গোলমুখের জটলায় নয়্যারের পায়ে লেগে বল জালে জড়ায়।
সমতা টানতে দেরি করেনি দুর্দান্ত ফুটবল খেলা জার্মানি। ৭৩তম মিনিটে বদলি খেলোয়াড় ফুয়েলখুগের কাছ থেকে বল পেয়ে নিখুঁত শটে লক্ষ্যভেদ করেন হাভের্টজ। ১২ মিনিট পর এগিয়ে যায় জার্মানরা। ডান প্রান্ত দিয়ে আক্রমণ করা জিনাব্রির ক্রস থেকে ফাঁকায় বল পেয়ে আলতো এক টোকায় দ্বিতীয়বারের মতো লক্ষ্যভেদ করেন হাভের্টজ। ৮৯তম মিনিটে লেরয় সানের বাড়ানো বল ফাঁকায় পেয়ে গোল করেন ফুয়েলখুগ। কিন্তু তাদের এই ৪-০ গোলের জয়ও কাজে এলো না, বাড়ি ফিরতে হচ্ছে শূন্য হাতেই।
ম্যাচে আরও কয়েকটি গোল হতে পারতো, দুই দলই পেতে পারতো জালের ঠিকানা। ৬১তম মিনিটে মুসিয়ালার শট বারপোস্টে লেগে ফিরে আসে। পরের মিনিটে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় মুলারের শট। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে নেওয়া রুডিগারের শট বারপোস্ট ঘেঁষে বেরিয়ে যায়। ৬৭তম মিনিটে আবার মুসিয়ালার শট বারপোস্টে লাগে। ৭৬তম মিনিটে তো অবিশ্বাস্য সেভ করেন নাভাস। একেবারে ফাঁকায় থেকে নেওয়া ফুয়েলকুগের শট দারুণ দক্ষতায় ফেরান কোস্টারিকার এই গোলরক্ষক। ৮৬তম মিনিটেও দরকে বাঁচান তিনি। যোগ করা সময়ের পঞ্চম মিনিটে ফুয়েলকুগের হেড একটুর জন্য জালে জড়ায়নি।