আর্জেন্টিনাকে রুখে দেওয়ার ছক কষছে অস্ট্রেলিয়া, দেগেনেক কি পারবেন মেসিকে থামাতে?
চলমান কাতার বিশ্বকাপে ফুটবল ভক্তদের উন্মাদনার আরেক নাম আর্জেন্টাইন তারকা ফুটবলার লিওনেল মেসি। কাতারের রাজধানী দোহায় কিংবা বিভিন্ন স্টেডিয়ামের ভেতরে ও বাইরে জড়ো হওয়া অগণিত ফুটবলপ্রেমীর কাছে বিশ্বকাপ মানেই মেসি, কিংবা মেসি মানেই বিশ্বকাপ। সাবেক বার্সেলোনা কিংবদন্তির বা পায়ের জাদুতে মুগ্ধ হয়নি এমন ক্রীড়াপ্রেমী পাওয়া যাবে না বললেই চলে। এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বী দলের ভক্তরাও কখনো কখনো তাকে কুর্নিশ করতে বাধ্য হন, খেলোয়াড়রা ম্যাচ শেষে নিজেদের জার্সি অদলবদল করেন মেসির সাথে।
কাতারের রাজধানীর আনাচে-কানাচে, বিলবোর্ডে, পোস্টারে এখন লিওনেল মেসির ছবি। আর্জেন্টিনার আকাশি-সাদা পতাকা, আলবিসেলেস্তেদের জার্সি আর মেসির ছবি মিলে দোহা এখন পুরোপুরি মেসিময়! তবে বিশ্বকাপে অঘটন দিয়ে এবং লাখো ভক্তের হৃদয়ক্ষরণের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেছে আর্জেন্টিনা, কারণ গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচেই তারা হেরে গিয়েছিল সৌদি আরবের কাছে। তবে সময়মতো দ্বিতীয় ম্যাচ থেকেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে আর্জেন্টিনা, পরপর দুটি ম্যাচে ২-০ গোলে হারিয়েছে মেক্সিকো ও পোল্যান্ডকে।
কিন্তু পোল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে আর্জেন্টিনার ওপরে ছিল প্রচণ্ড চাপ, জয় ছাড়া কোনো বিকল্প ছিলনা তাদের। আর এই চাপের মুখেই একটি গুরুত্বপূর্ণ পেনাল্টি মিস করে বসেন দলের তারকা লিওনেল মেসি। কিন্তু তা সত্ত্বেও খেলার নব্বই মিনিটজুড়ে আধিপত্য দেখিয়ে যখন ২-০ গোলে জয় ছিনিয়ে আনলো আর্জেন্টিনা, তখন আবারও কাতারের 'স্টেডিয়াম ৯৭৪' জুড়ে সেই 'মেসি! মেসি!' প্রতিধ্বনি।
কাতারে মেসির জনপ্রিয়তা কোনো অংশেই কম নয়। শহরের আকাশচুম্বী অট্টালিকাগুলো, যেখানে মেসির গোল উদযাপনের ডিজিটাল ভিডিও ভেসে বেড়াচ্ছে- মেসির জনপ্রিয়তাও তেমনই আকাশছোঁয়া। কারণ তিনি যে কাতারের লাক্সারি ব্র্যান্ড- অর্থাৎ ফরাসি ক্লাব প্যারিস সেইন্ট-জার্মেইয়ের প্রতিনিধি! আবার একই সাথে মেসি ভারতীয়, নেপালি, শ্রীলঙ্কান এবং বিশেষ করে বাংলাদেশি। আবার মেসি সৌদি আরবীয়ও! হ্যাঁ, একজন লিওনেল মেসিকে একক জাতি-দেশের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। এই সমস্ত দেশে মেসির কোটি কোটি সমর্থক, তাদের বাধভাঙা উল্লাসই বলে দেয় মেসি তাদের কাছে কি!
সাতবার ব্যালন দ'অর জিতলেও গোটা ক্যারিয়ারে একটিও বিশ্বকাপ জেতেননি লিওনেল মেসি। আর ঠিক সে কারণেই এবারের টুর্নামেন্টটা শুধুই মেসির। আর একই কারণে আর্জেন্টিনাকেও থেমে গেলে চলবে না, ৩৫ বছর বয়সী মেসির স্বপ্ন পূরণ ও আর্জেন্টিনার শিরোপা খরা ঘোচানোর জন্য আর্জেন্টিনাকে জয়ের ধারা অব্যহত রাখতেই হবে।
কিন্তু শেষ ষোলোর লড়াইয়ে আর্জেন্টিনার জয়রথ থামিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত অস্ট্রেলিয়া। গ্রুপ পর্বে ডেনমার্ককে ১-০ গোলে হারিয়ে ১৬ বছর পর বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে উঠেছে 'সকারুরা'। এই মুহূর্তে মেসি ও তার আর্জেন্টিনাকে থামানোর ছক কষছে অজিরা। অস্ট্রেলিয়ান ডিফেন্ডার মিয়োস দেগেনেক তো এরই মধ্যে মেসিকে আটকানোর ফন্দি করেই ফেলেছেন, তবে তিনি এও জানিয়েছেন যে তিনি নিজেই আর্জেন্টাইন সুপারস্টারের ভক্ত। দেগেনেক বলেন, "দুর্ভাগ্যবশত, আমি নিজেই তার (মেসির) অনেক বড় ভক্ত। কিন্তু তার হাতে বিশ্বকাপ দেখার চেয়ে আমি নিজে বিশ্বকাপ জিত্অতেই বেশি পছন্দ করবো।"
দেগেনেক হয়তো মাঠে পুরো নব্বই মিনিটই মেসির পেছনে লেগে থাকতেন, কিন্তু একথা ভুলে গেলে চলবে না যে আর্জেন্টিনার জন্যও এটা বাচা-মরার লড়াই। "তারা (মেসির সতীর্থরা) অবশ্যই অনেক বেশি অনুপ্রাণিত থাকবে কারণ এটাই মেসির শেষ বিশ্বকাপ, তারা চাইবে মেসির জন্য নিজেদের উজাড় করে দিয়ে খেলতে। আর আমাদের তাদেরকে থামাতে হবে", বলেন দেগেনেক।
২৮ বছর বয়সী এই অস্ট্রেলিয়ান ফুটবলার আরও বলেন, "আমি সবসময় মেসিকে ভালোবাসতাম। আমার মনে হয় তিনিই সর্বকালের সেরা ফুটবলার। কিন্তু তার বিরুদ্ধে খেলা কোনো সম্মানের বিষয় নয়, কারণ তিনিও একজন সাধারণ মানুষই, যেমনটা আমরা সবাই। কিন্তু বিশ্বকাপের শেষ ষোলোতে খেলা অত্যন্ত সম্মানের ব্যাপার, সেটা আর্জেন্টিনার বিপক্ষে খেলি বা পোল্যান্ডের বিপক্ষে। নকআউট পর্বে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করাই সবচেয়ে সম্মানের।"
ডেনমার্ককে হারিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েই শেষ ষোলোতে উঠেছে অস্ট্রেলিয়া। ফলে স্বভাবতই জয়ের অনুপ্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়ে আছে র্যাংকিং-এ ৩৮ নম্বরে থাকা দলটির খেলোয়াড়রা। অন্যদিকে, আর্জেন্টিনার স্বপ্ন কোয়ার্টার ফাইনাল, যেখানে নেদারল্যান্ড কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দেখা হতে পারে তাদের।
কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার পথকে সহজ করে দেখছেন না অজিদের ডিফেন্ডার দেগেনেক, "অবশ্যই এটা একটা কঠিন খেলা হবে। আমরা সর্বকালের সেরা ফুটবলারের দলের সাথে খেলতে যাচ্ছি। এছাড়াও, এখানে ১১ জনের বিপক্ষে ১১ জন খেলবে। এদের মধ্যে ১১ জনই মেসি নয়, মেসি তো একজনই। কিন্তু আমরা জানি তাদের দলটি তারকায় ঠাসা, তাদের দলের বেঞ্চেই আছে দিবালা, লাউতারো মার্তিনেজের মতো খেলোয়াড়রা। তাই আর্জেন্টিনার রয়েছে একটা নিখুত স্কোয়াড।"
আর্জেন্টিনা ও অস্ট্রেলিয়ার স্কোয়াডের বাজারমূল্য অবশ্যই চোখ কপালে তোলার মতো। তবে অজিরা বলে থাকে, একটা স্টার টিম মানেই স্টারদের টিম নয়। যে আর্জেন্টিনা টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত ছিল, তারাই পরাজয় বরণ করেছিল সৌদি আরবের কাছে। তাই অস্ট্রেলিয়ার যে কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই তা নয়।
তবে মেসিকে ঘিরে অবশ্যই আলাদা পরিকল্পনা রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার কোচ গ্রাহাম আর্নল্ডের। তিনি বলেন, "আমরা তাকে (মেসি) টানেলের মধ্যে রাখবো! নাহ, স্যরি! আসলে মজা করছিলাম। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে, আপনি যদি শুধু মেসির দিকে বেশি নজর দেন তাহলে অন্য খেলোয়াড়দের কথা ভুলে যাবেন। আমার মনে হয় পোল্যান্ড মেসির দিকে বেশি নজর দিয়ে ফেলেছিল। আশেপাশে তো আরও খেলোয়াড় থাকে, তাই এই ম্যাচ মানে শুধু মেসিকে আটকানো নয়- কারণ তাদের টিমে একাধিক ভালো খেলোয়াড় রয়েছে।"
তিউনিশিয়া ও ডেনমার্কের বিরুদ্ধে ব্যাক টু ব্যাক জয়ের মাধ্যমে ইতিহাস গড়া অস্ট্রেলিয়া গ্রুপ পর্বে ফ্রান্সের কাছে হেরে গিয়েছিল- যেই ফ্রান্স দলে আছেন কিলিয়ান এমবাপ্পের মতো ফরোয়ার্ড। ফ্রান্সের কাছে ৪-১ গোলের সেই পরাজয়কে একটা 'বন্ধুত্বপূর্ণ' শিক্ষা নেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা বলে আখ্যা দিয়েছেন কোচ আর্নল্ড।
তবে দেগেনেকের ভাষ্যে, "অবশ্যই এটাকে 'বন্ধুসুলভ' বলা চলে না, ফ্রান্স এই বিশ্বকাপের অন্যতম হট ফেভারিট। কিন্তু আমার মনে হয় প্রথম ম্যাচে সৌদির কাছে হেরে যাওয়ার পর আর্জেন্টিনা অন্য মাত্রায় চলে গেছে। তারা তাদের সেরাটা উজাড় করে দিতে চাইছে এবং জয়ের মনমানসিকতা নিয়ে খেলছে।"
আর্জেন্টিনাকে হারালে অস্ট্রেলিয়া যে নতুন আরেক ইতিহাস গড়বে তা বলাই বাহুল্য। আপাতত সেদিকেই মনোযোগ মিয়োস দেগেনেকের। ফ্রান্সের সাথে পরাজয়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, "ওইদিনের খেলা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি। আমরা প্রথম ম্যাচে তাদের একটু সম্মানও দেখিয়ে ফেলেছি। তবে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে একদম অন্যরকম খেলা হবে। কিন্তু তাদের দুই দলের ফুটবল স্টাইল সম্পূর্ণ আলাদা- ফ্রান্স একভাবে খেলে, আর আর্জেন্টিনার কৌশল আলাদা।"
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান