রাজশাহীতে সড়কে তিন চাকার যানবাহনই এখন ভরসা, মোড়ে মোড়ে পুলিশি তল্লাশি
গতকাল বৃহস্পতিবার (১ ডিসেম্বর) রাজশাহীতে ডাকা পরিবহন ধর্মঘটের প্রথম দিন সিএনজিচালিত ইজিবাইক, করিমন, নসিমন, লেগুনা, ইমাসহ বিভিন্ন মাঝারি আকৃতির যানবাহন চলাচল করলেও শুক্রবার দুপুর থেকে মাঝারি ধরনের সব যানবাহন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
রাজশাহীর সঙ্গে বিভিন্ন জেলা-উপজেলার যোগাযোগের মাধ্যম এখন ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যানবাহন ইজিবাইক। এছাড়া ভ্যান, রিকশা ও মোটরসাইকেলে যাতায়াত করা যাচ্ছে। তবে পথে মোড়ে মোড়ে পুলিশি তল্লাশিতে পড়তে হচ্ছে।
নগরীর রেলগেটে সিএনজিচালিত ইজিবাইকের স্ট্যান্ড। সেখানে শতাধিক ইজিবাইক থাকলেও বিকেলে গিয়ে হাতেগোনা দুই-তিনটি ছাড়া কোনো সিএনজি ইজিবাইক চোখে পড়েনি। যে দু-একটি সিএনজিতে যাত্রী তোলা হচ্ছিল তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিএনজিচালিত ইজিবাইকে যাত্রী নিয়ে শহরের বাইরে যাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কোনো যাত্রী নিয়ে শহরে প্রবেশ করা যাচ্ছে না। সমিতি থেকে বলা হয়েছে সিএনজি না চালাতে। পেটের দায়ে চালাতে হচ্ছে।
সিএনজিচালক রফিকুল ইসলাম ও মিলন জানান, দুপুর থেকে শহরের ভেতরে যাত্রী নিয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না তাদের। পুলিশ ফিরিয়ে দিচ্ছে।
নগরীর চারটি প্রবেশপথ ঘুরে দেখা গেছে, প্রত্যেকটি প্রবেশপথেই পুলিশি টহল জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া শহরের বিভিন্ন মোড়ে রয়েছে পুলিশ। তারা প্রতিটি যানবাহন থামিয়ে কাগজপত্র দেখছে। সন্দেহজনক মনে হলে পুলিশ তাদের শহরের ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না।
কাটাখালী থানার ওসি (তদন্ত) আব্দুর রাজ্জাক জানান, অতিরিক্ত সর্তকতা হিসেবেই পুলিশি তল্লাশি চালানো হচ্ছে, যাতে কেউ কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা তৈরি করতে না পারে।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক জানান, পুরো মেট্রোপলিটন এলাকায় ১ হাজার ২০০ পুলিশ সদস্য নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন, যাতে কোথাও কোনো ধরনের অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়। বিএনপি যেন গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাবেশ করতে পারে।
পুলিশের বাধা পেরিয়েই সমাবেশস্থলে বিএনপির নেতাকর্মীদের আগমন
গত তিন দিন ধরেই বিভাগের আট জেলা থেকে হাজার হাজার বিএনপির নেতাকর্মী সমাবেশস্থলে আসছেন। শুক্রবারও সারাদিন বিভিন্ন উপজেলা ও জেলা থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মী সমাবেশস্থলে এসে পৌঁছেছেন।
বিএনপির নেতাকর্মীদের অভিযোগ, সমাবেশস্থলে আসতে তাদের পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। পথে বেশ কয়েকবার পুলিশি তল্লাশিতে পড়তে হচ্ছে তাদের। অনেককেই ফিরিয়ে দিচ্ছে পুলিশ। তখন ঘুরপথে গ্রামের মধ্য দিয়ে সমাবেশস্থলে আসছেন তারা। অনেকে হেঁটে আসছেন। অনেকে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, ভ্যান, রিকশা এবং মোটরসাইকেলে সমাবেশস্থলে আসছেন।
বগুড়া থেকে তিন হাজার মোটরসাইকেলে সমাবেশস্থলে এসে পৌঁছেছেন ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের ৭ হাজার নেতাকর্মী।
বিকেল ৫ টায় নগরীর রেলগেট হয়ে বিশাল শো ডাউন করে তাদের সমাবেশস্থলে পৌঁছাতে দেখা যায়। এ সময় তারা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন।
একটি মোটরসাইকেলে ছিলেন বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ ছাত্রদলের নেতা রজিবুল ইসলাম। তিনি জানান, তারা বগুড়া থেকে বিশ্বরোড ধরে সান্তাহার, নওগাঁ হয়ে রাজশাহী পৌঁছেছেন। পথে তাদের সাতবার পুলিশের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে।
আরেকটি মোটরসাইকেলে ছিলেন যু্বদলের নেতা আশরাফ আলী। তাদের মোটরসাইকেলে তারা তিনজন ছিলেন। আশরাফ জানান, পুলিশ তাদের থামিয়ে কাগজপত্র দেখতে চায়। অনেক জায়গায় ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে করে সমাবেশস্থলে যাচ্ছিলেন নওগাঁর মান্দা উপজেলার কৃষকদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সিদ্দিকুর রহমান সিদ্দিক। তাদের ইজিবাইকে সাতজন কৃষকদলের কর্মী ছিলেন। সিদ্দিক জানান, মান্দা থেকে ইজিবাইকে আসতে সড়কে পাঁচ জায়গায় পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। তখন ঘুরপথে গ্রামের মধ্যে দিয়ে সমাবেশস্থলে এসেছেন।
খোলা আকাশের নিচে রাত্রিযাপন
পাবনার বেড়া-সুজানগর থেকে এসেছেন হারুনুর রশিদ। তিনি জানান, গত দুদিন ধরে তারা কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে খোলা আকাশের নিচে তাঁবুতে থাকছেন। দিনে পদ্মা নদীতে গোসল করে নিজেরাই রান্নাবান্না করে খাওয়াদাওয়া করছেন। চাল, ডাল, তেল, নুন, উনুন সব নিয়ে এসেছেন। সমাবেশ শেষ করে তবেই বাড়ি ফিরবেন তারা।
শুক্রবার বিকেলে নগরীর পাঠানপাড়া কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে গিয়ে দেখা যায়, বিএনপির নেতাকর্মীদের আগমনে জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে গোটা এলাকা। হাজার হাজার নেতাকর্মীর স্লোগানে মুখরিত চারপাশ। খণ্ড খণ্ড মিছিল করছেন বিভিন্ন জেলা থেকে আগত নেতাকর্মীরা। পুরো মাঠে অর্ধশতাধিক তাঁবু টানানো হয়েছে। কোথাও কোথাও রান্নার আয়োজন করা হচ্ছে।
কথাপ্রসঙ্গে আমিনুল ইসলাম নামের বিএনপির একজন স্থানীয় কর্মী বলেন, রাজশাহী শহর দখল হয়ে গেছে। দুপুরে শহরের বিভিন্ন স্থানে মিছিল করতেও দেখা গেছে বিএনপির নেতাকর্মীদের।
পরিবহন ধর্মঘটে বাস কাউন্টারে চলছে ধোয়া মোছার কাজ, টার্মিনালের বেশিরভাগ হোটেল রেস্তোরাঁ বন্ধ
চলছে ১০ দফা দাবিতে রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় পরিবহন ধর্মঘট। বাস বন্ধ থাকায় কাউন্টারগুলোতে অলস সময় পার করছেন কর্মচারীরা। অনেক কাউন্টারে ধোয়ামোছার কাজ চলছে। অনেক কাউন্টার বন্ধ রাখা হয়েছে।
শুক্রবার বেলা ১১টায় নগরীর শিরোইল বাস টার্মিনালে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়। শিরোইল বাস টার্মিনাল থেকে ঢাকাসহ দূরপাল্লার বাস চলাচল করে।
গ্রামীণ ট্রাভেলসে গিয়ে দেখা যায়, কর্মচারী শাকিল ও কবির অফিসকক্ষের চেয়ার-টেবিল ও ফ্যান পরিষ্কার করছেন।
তিনি বলেন, পরিবহন ধর্মঘট থাকায় যাত্রীদের চাপ নেই। তাই অফিসকক্ষের চেয়ার, টেবিল, ফ্যান বের করে ধোয়ামোছা করা হচ্ছে।
হানিফ এন্টারপ্রাইজের কাউন্টারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে চেয়ার রঙ করা চলছে। অফিসকক্ষে পুরো ধোয়ামোছার কাজ চলছে। রঙ মিস্ত্রি বেলাল হোসেন জানান, পরিবহন ধর্মঘটের এই সময়ে সুযোগ থাকায় ম্যানেজার রঙ করাচ্ছেন চেয়ারে।
কাউন্টারের ভিতরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছেন রিপন আলী। তিনি বলেন, 'সময় থাকায় কাজে লাগাচ্ছেন মালিকপক্ষ।'
তবে পরিবহন ধর্মঘট থাকায় যাত্রীদের যেমন দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। একইভাবে বাস টার্মিনাল এলাকার বহু হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখা হয়েছে। যেগুলো খোলা রাখা হয়েছে সেখানেও বেচাবিক্রি হচ্ছে খুবই কম।
শিরোইল বাস টার্মিনাল এলাকার খাবার ঘর হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের কর্মচারী নূরে আলম বলেন, 'ব্যবসা চারভাগের এক ভাগও নাই।' একই হোটেলের কর্মচারী মুনতাজুল বলেন, 'পরিবহন ধর্মঘটের কারণে আগে ৫০০ টাকা যেখানে খরচ দিত, এখন সেখানে ২০০ টাকা দিচ্ছে। ব্যবসা নাই, তারপরও যে দিচ্ছে তাতেই খুশি।'
সৌদিয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ইমন বলেন, ১০ জন কর্মচারী থাকলেও পরিবহন ধর্মঘটের কারণে তাদের তিনজন কর্মচারীকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
জাহিদ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের কর্মচারী মাসুদ রানা জানান, 'হোটেল মালিকের খরচাপাতি বন্ধ নাই কিন্তু ব্যবসা বন্ধ আছে। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে চারভাগের এক ভাগও কাস্টমার নাই। বাস চলছে না তাই বাইরের কোনো যাত্রীও শহরে প্রবেশ করছে না।'
তিনি বলেন, 'আমি পুঠিয়ার বানেশ্বরে থাকি। অন্য সময় যেখানে রাজশাহী থেকে বানেশ্বরে যেতে ইজিবাইকে ভাড়া লাগতো ২০ টাকা। এখন সেখানে ভাড়া লাগছে ৭০ টাকা। দিনে ৭০ টাকা লাগলেও রাতে ভাড়া লাগছে ১০০ টাকা। আমাকে মালিক দৈনিক দেয় ৬৫০ টাকা। বানেশ্বরে যাওয়া আসা করতেই ২০০ টাকা খরচ হয়ে যায়। কাস্টমার না থাকলেও বেতন যে দিচ্ছে মালিক তাতেই খুশি।'
মো. জীবন নামের এক চা দোকানদার বলেন, 'বাস টার্মিনালের বেশিরভাগ দোকানই বন্ধ। যে কয়টা খোলা আছে তাতেও কাস্টমার নাই। আগে যেখানে ২০০ কাপ চা বিক্রি হতো এখন সেখানে ৫০ কাপ চা-ও বিক্রি হয় না।'
এছাড়া যাত্রীদের ভোগান্তি তো আছেই। সঙ্গে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা ঝর্ণা বেগম নামের পঞ্চাশোর্ধ্ব এক নারীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয় নগরীর ভদ্রা মোড়ে। তিনি ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে করে নাটোরে যাবেন। সেখান থেকে ট্রেনে রংপুর যাবেন।
ঝর্ণা বলেন, 'পরিবহন ধর্মঘট চলছে আমি জানি না। এদিকে আমার খালা খুব অসুস্থ। আমাকে রংপুরে যেতেই হবে। তাই বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত ভাড়া গুনেই রওনা হয়েছি।'