আমরা রাজনীতির অদ্ভুত এক ঘেরাটোপের মধ্যে আটকে আছি!
১৯৯৪ সালের মাগুরা নির্বাচনের পরে তদানীন্তন বিরোধী দলসমূহ কর্তৃক উত্থাপিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আজ দেশের প্রধান ইস্যু। '৯৫ এর সেই দাবি চূড়ান্ত হয়েছিল '৯৬ সালের লাগাতার হরতাল, ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে। সেই সময়কার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল বিএনপি সরকার। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে তারা। সেসময় সংসদে বিল উত্থাপন করে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কায়েম করা হয়। সেই দিনের ক্ষমতাসীন বিএনপি আবার সেই দাবীকে ফিরিয়ে এনেছে।
ইতোমধ্যে বঙ্গোপসাগরের জল গড়িয়েছে অনেক। এই ব্যবস্থার অধীনে বর্তমান সরকার একবার ক্ষমতা হারিয়েছে, দুবার ক্ষমতায় এসেছে। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরে সংবিধান সংশোধন করে এই ব্যবস্থাকে বাতিল করেছে। তার আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই ব্যবস্থার বিপক্ষে রায় দিয়েছে।
'৯৫ এর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলটি আবার সেই দাবিকে ফিরিয়ে এনেছে। দেশের অন্যতম প্রধান বিরোধী দল (যদিও সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্বের হিসাবে তা তারা নয়) এই দাবির পক্ষে সবকটা বিভাগীয় শহরে তাদের জনসভা শেষ করেছে। তাদের লক্ষ্য এখন ঢাকার জনসভা।
এ দাবিকে কেন্দ্র করেই এ সমাবেশগুলো হচ্ছে কিংবা সরকার তার পাল্টা সমাবেশ করছে। কিন্তু দেশে ইতপূর্বেও ওই ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়েছে। দেশের তিনটি জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে ওই ব্যবস্থার মাধ্যমে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার কার্যকরিতার মাধ্যমে যারা ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন তারা দেশের সামগ্রিক সুশাসন কতটা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন তা দেশের জনগণ জানে।
গণতন্ত্রের নামে সারাদেশে যা চলছে তা কতটা গণতন্ত্র? সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আওতায় যেভাবে দেশ চলছে তাতে দেশের কত শতাংশ মানুষ তাকে সমর্থন করছেন তা নিরূপণ করার কোন বিধি ব্যবস্থা আমাদের দেশে নেই। থাকলে জনগণের মধ্যে একটি গবেষণা করা যেত যে বর্তমানের রাষ্ট্র কাঠামো যেভাবে চলছে তাতে আপনি কতটুকু সুখী কিংবা সমর্থন করেন?
অতীতের মতোই এখনও আমলা ও পুলিশ বাহিনী ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে যখন আন্দোলন চলছিল তখনও পুলিশকে দেখেছি দলীয় পুলিশের ভূমিকা পালন করতে। এখনো দেখছি পুলিশকে সেই একইভাবে দলীয় ভূমিকা পালন করছে।
২০০৬ কিংবা ১৯৯৫, সেসময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এমন বিস্তৃতি ঘটেনি। ফলে তখন কোথায় কী হচ্ছে তা সরাসরি দেখার সুযোগ কম ছিল। এখন ফেসবুক ও অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমের ফলে এই সমাবেশগুলোতে বক্তারা কী বলছেন, মিছিল কী বলছে, কী ধরনের স্লোগান দেওয়া হচ্ছে- তা সাধারণ মানুষ জানতে পারছে। ডিজিটাল আইনের মাধ্যমে অনেককিছু নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও সবকিছু আর নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না।
এ সময়ে বক্তাদের বক্তব্য কিংবা স্লোগান দেশকে এক চরম সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করা যায়। ক্ষমতাসীনদেরও জেলাগুলোতে মূল দলের পাশাপাশি সহযোগী সংগঠনের সম্মেলন চলছে। এরইমধ্যে সরকার প্রধান যশোর ও চট্টগ্রামে দলীয় সমাবেশ করেছেন। উভয় পক্ষই সমাবেশগুলোতে জনসমাগমের হিসেব দিয়ে প্রমাণ করতে চাইছেন কাদের পক্ষে জনসমর্থন বেশি।
যদিও বাংলাদেশের নির্বাচনী আইন ব্যবস্থায় প্রশ্ন উঠতে পারে- এই সমাবেশগুলোর জন্য যে ব্যয় করা হয়েছে তা কোত্থেকেম কিভাবে আসে? বহুলভাবে প্রচলিত আছে যে, উভয় দল সমাবেশের লোক সংগ্রহ করার জন্য সরাসরি টাকা-পয়সা প্রদান করে থাকে। এই বিতর্কের মধ্যে সাধারণ মানুষ একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছেন।
তবে এর মধ্যেও কিছু বিষয় দৃশ্যমান। সরকারবিরোধী সমাবেশগুলোর আগে সকল ধরনের পরিবহন বন্ধ থাকছে ধর্মঘটের নামে। তারপরও মানুষ যেকোন উপায়ে সমাবেশগুলোতে আসছে। এই আসাও নির্বিঘ্ন হচ্ছে না। কোথাও প্রশাসন, কোথাও সরকারি দলের শত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে মানুষ আগের দিন সমাবেশ স্থলে হাজির হচ্ছেন। সমাবেশ স্থলে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়ে সমাবেশ করে মানুষ বাড়ি ফিরছে। সমাবেশ শেষ হওয়ার আগেই কথিত পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হচ্ছে। বিরোধীদের সবগুলো সমাবেশের চিত্র প্রায়ে এই এরকমই।
অন্যদিকে সরকারদলীয় সমাবেশগুলোতে প্রশাসনিক ও দলীয় সক্ষমতা শতভাগ ব্যবহার করা হয়েছে। সমাবেশে লোক আনা নেওয়ার জন্য পরিবহনের গাড়িগুলো আগে থেকে অপেক্ষা করে। তবে সরকারে থাকলে বাড়তি এই সুবিধাটুকু পাওয়া যায়। সব সরকারের আমলেই এমনটা ঘটেছে।
রাজনীতির অদ্ভুত এক ঘেরাটোপের মধ্যে আটকে আছি। দেশের অর্থনৈতিক সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, ঘুষ-দুর্নীতি, কোটি কোটি টাকা পাচার, ভুয়া কোম্পানি খুলে ব্যাংক থেকে টাকা লোপাট এসব খবর উঠে আসছে গণমাধ্যমে। আমরা এগুলো নিয়ে ভাবছি না। আমরা উদ্বিঘ্ন সমাবেশ কোথায় হবে সেটা নিয়ে। পরিস্থিতি এমন যে আমরা এটা নিয়েই ভাবতে বাধ্য। বিরোধী দল ইঙ্গিত দিয়েছে তৃতীয় কোন জায়গা পছন্দ হলে সেখানে সমাবেশ করতে আপত্তি নেই। বিরাট স্বস্তি। অনেকটা ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেওয়ার মত ঘটনা।
আলোচনার স্বার্থে যদি ধরেও নেই মানুষ পরিবর্তন চায়, তাহলে সবার আগে জানতে হবে কী সেই পরিবর্তন? যারা আজ পরিবর্তনের কথা বলছেন তারা দুই দশকের অধিক সময় রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন। সেই সময়ের মূল্যায়ন তারা করেছেন কি না। তাদের সময়ে সংস্কারগুলো কেন করা হয়নি বা আগামীতে ক্ষমতায় গেলে কীভাবে এবং কী কী পরিবর্তন আনবেন তা স্পষ্ট করা জরুরি।
ভাসা ভাসা অনেক দাবির কথা তারা বলছেন। পাশাপাশি এটাও বলছেন, খুব শীঘ্রই তারা সরকার পতনের একদফা দাবি সামনে নিয়ে আসবেন। আমরা আগুনে পোড়া, তাই সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পাই। একদফার অর্থ সরকার পতনই প্রধান, অন্য সবকিছু গৌণ হয়ে যাওয়া। অতীতে এমনটি ঘটেছে অনেকবার। আন্দোলনের সময়কার দাবিগুলো পরবর্তীতে 'প্রতিশ্রুতি'তে পরিণত হয়েছে যা আর বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি।
১৯৯০ এর আজকের দিনে সেই সময়ের স্বৈরশাসক এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা তিন জোটের রূপরেখার বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার পেয়েছি, এটুকুই। যদিও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতেন জনগণের সরাসরি ভোটে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন না- পার্থক্য শুধু এইটুকুই। ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বিবেচনায় এই দুই পদ্ধতির সরকারের মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই।
একটি দেশের সংবিধান মুলত দেশের নাগরিকগণের অধিকার ও প্রাপ্য এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার কী ভূমিকা ও দায়িত্ব তা বিবৃত থাকে। বিশেষ করে রাষ্ট্রে মূল স্তম্ভ আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ কিভাবে ভারসম্যের নীতির উপর দাঁড়িয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে তা বলা থাকে। সবকিছুই পরিচালিত হবে জনগণের 'ইচ্ছায় ও প্রয়োজনে'। কেননা জনগণই এই রাষ্ট্রের মালিক।
সংবিধানের এই মৌলিক দায়িত্বের বিচ্যুতি ঘটছে কি না তা প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণে থাকা প্রয়োজন। আমাদের দেশে তেমন কোন কাঠামো নেই। জমিদারী ব্যবস্থার বিলোপ হয়েছে বহুকাল আগে। জমিদার না থাকলে প্রজা থাকে না। তাহলে আমাদের দেশ 'প্রজাতন্ত্র' কেন? এ প্রশ্ন এখন সামনে আসছে। অনেকে বলছেন, 'জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ' উপযুক্ত নাম। এই আলোচনা এখনই খুব জরুরি না হলেও রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভের মধ্যে ভারসম্যের নীতি ও স্বাধীনতা কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে সে আলোচনা প্রয়োজন। রাষ্ট্র পরিচালিত হবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানগুলো গঠিত ও পরিচালিত হবে সুনির্দিষ্ট আইন দ্বারা।
আইনসভার সদস্যগণ তার নির্বাচনী এলাকার নাগরিকের ইচ্ছার প্রতিফলন সংসদে রাখতে পারছেন না। আমাদের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ আইনসভার সদস্যদের নাগরিকের ইচ্ছার পরিবর্তে দলীয় ইচ্ছার প্রকাশ ঘটাতে বাধ্য করে। আন্দোলন করুন আর নির্বাচন করুন- বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া দরকার।
রাষ্ট্র পরিচালনায় 'প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা ও পরামর্শের' কথা বলে সামষ্টিক চেতনার বিপরীতে ব্যক্তি প্রধান হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদের ভ্রুণ এখানেই। বিচারপতি নিয়োগ, অপসারণ, বিচারাঙ্গনে নির্বাহী বিভাগের পরিবর্তে বিচার বিভাগের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রের স্তম্ভগুলো প্রকৃত অর্থে ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীন হতে পারে। দেশের সংবিধান এটার রক্ষাকবচ। সংবিধানে সেই প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা বলা হয়েছে কি না, প্রশ্নটা সেখানে।
কেবলমাত্র পরস্পরের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে রাষ্ট্রের মালিক জনগণকে আতঙ্কিত করে তুলবেন না। রাজনৈতিক দল হিসেবে জনগণের কাছেই দায়বদ্ধ হন। জনগণকে অন্ধকারে রেখে কেবল ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করুন। নির্বাচনের ইসতেহার হোক জনগণের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর সামাজিক চুক্তির মূল ভিত্তি।
জনগণকে আতঙ্কিত করা, তার চলাচলের বিঘ্ন ঘটানো, তার জীবন জীবিকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা, জীবন নেওয়া ইত্যাদির পরিবর্তে রূপরেখা বা ইসতেহার প্রকাশ করুন, যেন জনগণ স্বাধীনভাবে তার পছন্দ নির্দিষ্ট করতে পারে। রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যকার বোঝাপড়াটা উন্মুক্ত করুন। গণতন্ত্রের ভিত্তিমূল এখানেই।
ক্ষমতার প্রয়োজনে কেবলমাত্র তরুণ সমাজকে ছাত্র সংগঠনের নামে এক বিপর্যস্ত জীবনের দিকে ঠেলে দিবেন না, যা এখন প্রতিদিন দেখছি। যে ছাত্রলীগের দুর্দান্ত আন্দোলনের কারণে পাকিস্তানের শাসক আয়ুবের পতন ঘটেছিল, বঙ্গবন্ধু মুক্ত পেয়েছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে, সেই ছাত্রলীগের আজকের অবস্থা ভেবে দেখবেন রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা আছেন তারা; ভেবে দেখবেন এই তরুণ সমাজ কোথায় যাচ্ছে!
[এই নিবন্ধ-মতামত সম্পূর্ণ লেখকের। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদকীয় নীতিকে প্রতিফলিত করে না]