রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: বড় প্রশ্ন এখন, কার ক্ষেপণাস্ত্র আগে নিঃশেষ হবে?
খুব সম্ভবত দ্বিগবিজয়ী ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ন কিংবা ফ্রেডারিক দ্য গ্রেট বলেছিলেন, সৈন্যদল অগ্রসর হতে পারে তাদের উদরের ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ সেনাদের অভিযান পরিচালনার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন পর্যাপ্ত খাদ্য। আরও বিশদভাবে বলতে গেলে, সবার আগে প্রয়োজন তাদের সুষম খাদ্য, প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যাবস্থা, যোগাযোগসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি দিয়ে সুসজ্জিত করে তাদের সর্বদা প্রস্তুত রাখা। এসব ছাড়াও অন্য আরেকটি জিনিস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো, প্রয়োজনীয় সমরাস্ত্র।
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে প্রতিহত করতে ইউক্রেন দারুণ সাহসিকতা, চাতুর্যপূর্ণ কৌশল এবং উল্লেখযোগ্য নেতৃত্ব দেখিয়েছে। তবে মানতেই হবে, পশ্চিম থেকে সামরিক সাহায্য না পেলে কিয়েভ এতদিনে মস্কোর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেত।
যুদ্ধের প্রথম ছয় সপ্তাহের মধ্যেই পশ্চিমা সরকার ইউক্রেনে ৬০ হাজার অ্যান্টিট্যাংক সমরাস্ত্র এবং ২৫ হাজার অ্যান্টি-ক্রাফট ওয়েপন পাঠিয়েছে। কিন্তু এত পশ্চিমা এবং ইউরোপীয় সাহায্য সত্ত্বেও যুদ্ধের গতি ইউক্রেনের জন্য টেকসই নয়।
অন্যদিকে ইরানের সাহায্য নিয়েও রাশিয়া বড় ধরনের ক্ষেপনাস্ত্র সংকটের সম্মুখীন। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে পশ্চিমা সাহায্য ইউক্রেনে পৌঁছানোর আগে থেকেই রাশিয়ার এক শিল্প ঘাঁটি নড়েবড়ে হয়ে পড়েছিল।
সুতরাং কার ক্ষেপনাস্ত্র আগে শেষ হবে?
মাইকেল কটকিনের কিছু মতামত এখানে তুলে ধরা হলো। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর নেভাল অ্যানালাইসিস-এর রাশিয়া স্টাডিজ প্রোগাম-এর প্রোগ্রাম ডিরেক্টর। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম রাশিয়া-পর্যবেক্ষক তিনি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সবচেয়ে বড় সাম্প্রতিক টুইস্ট হলো ইউক্রেনিয়ান ড্রোনের রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণ। এতে ক্ষতির পরিমাণ খুব বেশি না হলেও এর প্রভাব কী হতে পারে তা সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে খুব বড়সড় প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন না কটকিন।
তার মতে, এতে বিমান হামলা ক্যাম্পেইনের জন্য রাশিয়া হয়তো তাদের ঘাঁটিগুলো পুনর্গঠন করতে পারে। তবে সবচেয়ে বাস্তবিক প্রভাব হতে পারে, ইউক্রেনের সামরিক এবং জনসাধারণের মনোবল বৃদ্ধি।
ইউক্রেনের এ সফল ড্রোন আক্রমণকে ইউক্রেনের অগ্রসরতা বলে মনে করেন না কটকিন। কারণ, রাশিয়াও ইউক্রেন জুড়ে নিয়মিত হামলার জন্য দূরপাল্লার বিমানের ব্যবহার করেই আসছে।
বলা চলে, চলতি বছর ইউক্রেনের আক্রমণ সফল ছিল। কিন্তু এতে অনেক ক্ষেপনাস্ত্র নিঃশেষ হয়েছ্ যা দেশটির অস্ত্রাগারে বেশ চাপের সৃষ্টি করেছে। সুতরাং এখন ইউক্রেন শীতকাল নাগাদ পুনরায় অস্ত্রাগারে প্রয়োজনীয় সমরাস্ত্র মজুদ করতে পারবে কি না - এটিই বড় প্রশ্ন।
তবে কি আক্রমণ কিছুটা শিথিল হবে?
টকটিন বলেন, 'আমি এ যুদ্ধে শিথিলতার খুব বেশি প্রমাণ দেখিনি। বরং কামান, পদাতিক আক্রমণ এবং দূরপাল্লার নির্ভুল আক্রমণের নির্ভর টেকসই যুদ্ধ দেখতে পাচ্ছি। এই মুহুর্তে বড় আক্রমণ নাও হতে পারে, তবে এটি যুদ্ধের একটি ক্রান্তিকাল মাত্র। তাই চলমান হারে আক্রমণ বজায় রেখে দেশ দুটো নাটকীয়ভাবে প্রয়োজনীয় সমরাস্ত্রের সরবরাহ করতে পারবে - সে বিষয়ে আমি সন্দিহান।'
ইউক্রেনের পশ্চিমা শক্তি থেকে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং আর্টিলারি গোলাবারুদের টেকসই সরবরাহ প্রয়োজন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তাদের সমরাস্ত্র ব্যবহারের হার পশ্চিমে এর উৎপাদন হারকে ছাড়িয়ে গেছে। পরিস্থিতিকে আরও টেকসই করতে অর্থাৎ প্রয়োজনীয় সমরাস্ত্রের চাহিদা মেটাতে হলে পশ্চিমা বিশ্বে অস্ত্র উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে।
রাশিয়ার সমস্যাও কম গুরুতর নয়। দেশটির সামরিক বাহিনী আর্টিলারি গোলাবর্ষণের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। শীতে তারা সামরিক অস্ত্রশস্ত্রের ভাণ্ডার পুনরায় পূর্ণ করার চেষ্টা করবে। আর ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী আক্রমণ চালিয়ে যাবে এবং রাশিয়ার আক্রমণ ক্ষমতা পুনরায় বৃদ্ধির প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে।
রণকৌশল হিসেবে আকাশ এবং ভূমি - দুটো উপায়েই রাশিয়া হামলা করে যাচ্ছে। এর দুটো উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত, যুদ্ধের সরঞ্জামের জন্য যুদ্ধটি যেন টেকসই হতে না পারে। দ্বিতীয়ত, এমনভাবে যুদ্ধ চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যেন পশ্চিমা শক্তিগুলো যুদ্ধের খরচ এবং ব্যাপ্তি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে।
তাছাড়া রাশিয়া ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা গোলাবারুদ ধ্বংস করে দিচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে রাশিয়া চাইবে ইউক্রেনকে উভয়সংকটে ফেলতে; হয় শহর বাঁচাতে হবে, না হয় ফ্রন্ট লাইন।
রাশিয়াও তার উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে বেশি সমরাস্ত্র ব্যবহার করছে। ফলে দেশটি ড্রোনের জন্য ইরানের ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। কিন্তু, ইরান থেকে ব্যালিস্টিক মিসাইল আমদানি করতে সমর্থ হলে, রাশিয়া শীতেও হামলা চালিয়ে যেতে পারবে।
একসময় ভূমিতে হামলার প্রয়োজন হলে কি রাশিয়ার সেনাশক্তি প্রস্তুত?
গত সেপ্টেম্বরে ভ্লাদিমির পুতিন তিন লাখ সেনা সমাবেশের ঘোষণা দেন। তার এই কৌশল কি আদৌ কোনো কাজে আসবে, নাকি মরিয়া বলে এমন সিদ্ধান্ত? এ ব্যাপারে কটকিন বলেন, 'সেনার সংখ্যা জয় আনবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু এর অবশ্যই অনেক বড় ভূমিকা আছে। সৈন্য সমাবেশের বলেই রাশিয়ান লাইনগুলো স্থিতিশীল হয়। এর ফলেই খেরসন থেকে রাশিয়া তার সৈন্যদের সুসংগঠিতভাবে প্রত্যাহার করতে পেরেছিল এবং বাখমুতে হামলা করার জন্য তাদের যথেষ্ট জনবল ছিল। কিন্তু এই তিন লাখ সৈন্য নিয়ে পুতিন কী করবেন তা এখনো বলা যাচ্ছে না। এমন প্রক্রিয়ার ফলাফল দেখা দিতে কয়েক মাস লেগে যায়।'
রাশিয়ান সেনাবাহিনী বর্তমানে আত্মরক্ষামূলক কৌশল অবলম্বন করছে। সুতরাং, নতুন সৈন্যদের হয়তো হামলার কাজে না লাগালেও, প্রতিরক্ষার্থে ব্যবহার করা হতে পারে।
এসব কিছুর চূড়ান্ত ফলাফল হতে পারে, গতিপথের কোনো পরিবর্তন ছাড়াই যুদ্ধের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি।
অনেকে মনে করতেন, ন্যাটো-রাশিয়া যুদ্ধ হলে ন্যাটো এক বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতো। কিন্তু রাশিয়া আশানুরূপ যুদ্ধ চালাতে পারেনি।
'তাই বলে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে এই যুদ্ধ থেকে পশ্চিমের কিছু শেখার আছে। ইউক্রেনের সামরিক সক্ষমতাকে এতদূর নিয়ে আসতে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক পশ্চিমা দেশকে অনেক বড় প্রচেষ্টা চালাতে হয়েছে,' বলেন কটকিন।
তার মতে, রাশিয়ার বর্তমান যে সামরিক শক্তি, তা ন্যাটোর জন্য হুমকি হয়ে না দাঁড়ালেও, রাশিয়া পুনরায় শক্তি সঞ্চার করে নেবে। তাছাড়া, এ যুদ্ধে অনেক ক্ষেপণাস্ত্রই পুতিন এখনো ব্যবহার করেননি। রাশিয়ার শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা, ইলেক্ট্রোনিক ওয়ারফেয়ার, অ্যান্টি-স্যাটেলাইট ক্ষেপণাস্ত্র, ডিরেক্টেড এনার্জি সিস্টেম, পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন সাবমেরিন ইত্যাদি রয়েছে।
ইউক্রেন প্রচুর পরিমাণে আর্টিলারি এবং রকেট সিস্টেম গোলাবর্ষণের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। তাদের এই রণকৌশলে রশদ দিয়ে সমর্থন করার মতো সক্ষমতা মার্কিন সামরিক বাহিনীর নেই। তাছাড়া সমরাস্ত্রের উৎপাদন বাড়াতেও সময়ের প্রয়োজন।
হিমার্স মিসাইলের মতো অধিক গুণমানসম্পন্ন পশ্চিমা ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি হলেও, মনে রাখতে হবে যে, ইউক্রেনের মাসিক ভিত্তিকে অনেক বেশি আর্টিলারি গোরাবারুদ প্রয়োজন।
এ তো গেল যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা। ইউরোপীয়রাও তাদের অস্ত্রাগার থেকে এই যুদ্ধে অবদান রাখছে। তাদের উৎপাদন ক্ষমতাও রয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যে মার্কিন সমরাস্ত্র মজুদ থেকে অনেক কিছুর ব্যয় হয়েছে, এবং মজুদে চাপ দৃশ্যমান।
আসন্ন বছরগুলোতে রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াতে পারে। কিন্তু, অনেক সেক্টরেই রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী এখন পর্যন্ত খুব বড়সড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি বা যে ক্ষতি হয়েছে সেগুলোও সহজেই পূরণ করতে পারবে।
রাশিয়া হয়তো ক্ষয়িষ্ণু শক্তিতে পরিণত হতে পারে, সামরিক শক্তি পূনরায় সুসংগঠিত করতে দশকের মতো সময় নিতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশটির সমরাস্ত্রের সক্ষমতা পশ্চিমা শক্তির জন্য বিপজ্জনক হয়ে থাকবে।
পুতিনের তিন লাখ সৈন্য মোতায়নের যে কৌশল, তাতে অনেক পরিবার বহু সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। কিন্তু এতেও পুতিন তার শক্ত অবস্থান হারাবেন না বলে মনে করেন কটকিন।
অতিরিক্ত মরিয়া হয়ে উঠলে পুতিন কী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন: পারমাণবিক নাকি রাসায়নিক?
এমন প্রশ্নের জবাবে কটকিন বলেন, 'রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করা হতে পারে - বারবার সামনে চলে আসা এমন উদ্বেগের কারণে আমি কিছুটা বিস্মিত। তবে রাশিয়া তা করবে বলে আমি মনে করি না। কিন্তু পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বৃদ্ধির যে ঝুঁকি, তা মোটেও মামুলি নয়। যদি রাশিয়ান সামরিক বাহিনী পরাজয়ের সম্মুখীন হয় এবং এতে যদি তারা অনেক বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তবে রাশিয়ান রাজনৈতিক নেতৃত্ব পারমাণবিক অস্ত্র বৃদ্ধির কথা বিবেচনা করতে পারে।'