ব্যয়বহুল আমদানির কারণে ভর্তুকির পরিমাণ তিনগুণ বেড়ে ১.৬ লাখ কোটি টাকা
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় জ্বালানি, সার ও খাদ্যে ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাতগুলোতে বরাদ্দের প্রায় তিনগুণ। এ বছরের জন্য খাতগুলোতে ভর্তুকি বরাদ্দ ছিল ৫৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, খাদ্য ও কৃষিতে প্রাক্কলিত ভর্তুকির পরিমাণ মোট জাতীয় বাজেটের প্রায় ২৪ শতাংশ। ভর্তুকির সঙ্গে রপ্তানি প্রণোদনা ও নগদ ঋণের জন্য বাজেটে বরাদ্দকৃত ২৫ হাজার কোটি টাকা যোগ করা হলে 'ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণ' খাতে মোট প্রয়োজন হবে ১ লাখ ৮৬ ৫৯৫ কোটি টাকা বা মোট বাজেটের প্রায় ২৯ শতাংশে পৌঁছাবে।
ভর্তুকির বর্তমান পরিস্থিতিকে অর্থনীতির উপর 'ভয়ংকর চাপ' বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধির নিম্নমুখী প্রবণতার সময়ে এই বিপুল পরিমাণ ভর্তুকির চাহিদা কীভাবে মেটানো সম্ভব হবে, তা নিয়ে চিন্তিত সরকার।
গত ৬ নভেম্বর গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক সভায় পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে ভর্তুকির চিত্র তুলে ধরে অর্থ মন্ত্রণালয়, যার একটি কপি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের হাতে এসেছে।
ওই নথিতে দেখা গেছে, গত আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরও এ খাতে এক দশক পর প্রথমবারের মতো ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে সরকারকে।
ভর্তুকির চাপ কমাতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন বলে ওই দিন সভা শেষে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছিলেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ। ভর্তুকির দাবি মেটাতে প্রয়োজনে ব্যাংক ঋণ বাড়ানোর পরামর্শও দেন প্রধানমন্ত্রী।
ভর্তুকির চাহিদা মেটানোর সম্ভাব্য উপায়গুলো পর্যালোচনা করতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে চলতি মাসেই বৈঠকে বসবে সরকারের আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল।
এক দশকে প্রথমবারের মতো জ্বালানি তেলে ভর্তুকি
২০১২ সাল থেকে জ্বালানি তেলে কোনো ভর্তুকি দেয়নি সরকার। বরং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগের সাত বছর ধরে সরকার এখান থেকে মুনাফা করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটেও জ্বালানি তেলে ভর্তুকি বাবদ কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে জ্বালানি তেলের জন্য ১৯ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা ভর্তুকি চেয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা টিবিএসকে জানান, গত আগস্টে দাম বাড়ানোর পরও লোকসানে তেল বিক্রি করতে হয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে (বিপিসি)। এরপর ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরও কমে যাওয়ায় এই লোকসান বাড়তে থাকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হলে এ খাতে লোকসান বাড়তে পারে।
তবে আপাতত জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ সরকারের নেই বলে জানান বিপিসির কর্মকর্তারা।
খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সারে অগ্রাধিকার
একইভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম বাড়ার পর দেশেও ইউরিয়ার দাম কেজিতে ৬ টাকা বাড়িয়েছে সরকার।
তা সত্ত্বেও সারে ভর্তুকি মেটাতে এ খাতে বাজেট বরাদ্দের তিনগুণের বেশি অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে।
সারে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়বে, এমন ধারণা থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ৮২৭ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা করা হয়। যা আগের বছরের চেয়ে ৮২৭ কোটি টাকা বেশি।
কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয় এ খাতে এই বরাদ্দের অতিরিক্ত ৪০ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা ভর্তুকি দাবি করেছে। অর্থাৎ কৃষি খাতে চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি প্রয়োজন হচ্ছে ৫৬ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা, যা এ খাতে গত অর্থবছরের মোট ভর্তুকির দ্বিগুণ।
সারে ভর্তুকির পরিমাণ অনেক বাড়লেও সারের দাম আর বাড়াতে চায় না সরকার।
বর্তমানে দেশে প্রতি কেজি ইউরিয়ার দাম ২০ টাকা। পাশের দেশ ভারতে এর দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২ টাকা।
এই পরিস্থিতিতে দেশে সারের দাম আরও বাড়াতে খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
বিশ্বজুড়ে চলমান খাদ্য সংকট পরিস্থিতির সময় প্রধানমন্ত্রীও কৃষি খাতে চাহিদা অনুযায়ী ভর্তুকি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে টিবিএসকে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক।
সারের বিপুল ভর্তুকি মেটানোর অর্থায়নের জন্য গত সপ্তাহে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে বৈঠক শেষে কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, অন্য খাতে ব্যয় কমিয়ে সারের ভর্তুকি মেটানোর ব্যবস্থা নেবেন বলে অর্থমন্ত্রী তাকে জানিয়েছেন। আগামী মার্চে বাজেট সংশোধনের সময় এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হবে।
বিদ্যুৎ, গ্যাসের দাম বাড়বে
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কয়লার দাম বাড়ার কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়ায় এ খাতে ভর্তুকির চাপও বাড়ছে।
বিদ্যুতে বাড়তি ভর্তুকি লাগবে, এমন অনুমান করেই এবারের বাজেটে এ খাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা করা হয়। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগ এ খাতে ভর্তুকি বাবদ আরও ৩২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দাবি করেছে।
বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির এই চাপ মোকাবিলা করতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএড) বিদ্যুৎ ও গ্যাসে ভর্তুকি কমানোর শর্তারোপ করেছে।
আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে গণশুনানি ছাড়াই সরকার যাতে যেকোনো সময় প্রয়োজনমতো গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়াতে পারে, সেজন্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হাইদ সম্প্রতি একটি অধ্যাদেশ জারি করেছেন।
আগামী ফেব্রুয়ারির আগেই গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়তে পারে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
এলএনজি আমদানিতে এ বছর ভর্তুকি বরাদ্দ রয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু জ্বালানি বিভাগ এ খাতে অতিরিক্ত ৫ হাজার কোটি টাকা দাবি করেছে।
অবশ্য এলএনজিতে ভর্তুকি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার স্পট মার্কেট থেকে আমদানি কয়েক মাস ধরে বন্ধ রেখেছে। যদিও এতে দেশে গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে।
রপ্তানিকারকরা বাড়তি মূল্যে গ্যাস কেনার আগ্রহের কথা সরকারকে জানানোর পর আবারও স্পট মার্কেট থেকে বেশি দামে গ্যাস কেনার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একইসঙ্গে এলএনজি আমদানি বেসরকারি খাতের জন্যও উন্মুক্ত করা হয়েছে।
দরিদ্রদের সুরক্ষা দিতে খাদ্যে ভর্তুকি
উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব থেকে দরিদ্রদের সুরক্ষা দিতে খোলা বাজারে (ওএমএস) চাল বিক্রিসহ ট্রেডিং কর্পোরেশন অভ বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে এক কোটি পরিবারকে ভর্তুকি মূল্যে খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে সরকার।
চাল, আটা, ভোজ্য তেল, চিনিসহ এসব পণ্যের দাম বাড়ায় এ খাতেও বাড়তি ভর্তুকির চাহিদার কথা জানিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
খাদ্য মন্ত্রণালয় পরিচালিত খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি বাস্তবায়নে চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা। খাদ্য মন্ত্রণালয় এ খাতে আরও ৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে।
অন্যদিকে, টিসিবির মাধ্যমে খাদ্যপণ্য বিক্রিতে এবার ভর্তুকি বরাদ্দ রয়েছে ১১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এ খাতে টিসিবি অতিরিক্ত ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে।
রপ্তানি, রেমিট্যান্সে প্রণোদনা কমতে পারে
এছাড়া, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে প্রণোদনা দেয় সরকার, যা মূলত ভর্তুকি। এ বছর রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় এ খাতে ব্যয় কিছুটা কমতে পারে।
চলতি অর্থবছরে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রণোদনা বাবদ ১৫ হাজার ২২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
নগদ ঋণ
এছাড়া, নগদ ঋণ খাতে এ বছর ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে, যা আর বাড়ছে না।
আরও কৃচ্ছ্রতা প্রয়োজন
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, এই ভর্তুকি মেটানোর আর্থিক সামর্থ্য এই মূহূর্তে সরকারের নেই।
তিনি বলেন, 'নিকট ভবিষ্যতে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনাও কম। সবকিছু মিলে দেশ একটা কঠিন সময় পার করছে। সরকারের আরও কৃচ্ছ্র সাধনের সুযোগ রয়েছে। কোন কোন খাতে ব্যয় কমানো যায়, দ্রুত অগ্রাধিকার ভিত্তেত তার তালিকা করতে হবে।'
প্রয়োজনে গ্যাস ও বিদ্যুতের পাশাপাশি সারের দামও হয়তো কিছুটা বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে বলে জানান তিনি।