নতুন সূর্যোদয়ের ২৩ বছর
জয় আর পরাজয়ের ব্যবধান কতটুকু? হাসিবুল হোসেন শান্ত বলবেন, একটি লেগ বাই রানই যথেষ্ট। একটি লেগ বাই রানও ঘুচিয়ে দিতে পারে জয়-পরাজয়ের ব্যবধান। তাতে সায় মিলবে অধিনায়ক আকরাম খান, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, মোহাম্মদ রফিকদের। ক্রিকেট পাগল একটি পুরো জাতিও এতে সুর মেলাবে। পায়ে লেগে বেরিয়ে যাওয়া একটি লেগ বাই রানেই তো বদলে যায় বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাস।
ওই এক রানেই মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ওড়ে বিজয় কেতন, বাংলাদেশের মাথায় ওঠে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। সেমিফাইনাল জিতেই বিশ্বকাপে নাম লেখানো বাংলাদেশ স্থায়ীভাবে জায়গা করে নেয় ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসর বিশ্বকাপে। গল্পটা বাংলাদেশের ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জয়ের।
২৩ বছর আগে আজকের এই দিনে (১৩ এপ্রিল, ১৯৯৭) কেনিয়াকে হারিয়ে আইসিসি ট্রফিতে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। বড় বড় অক্ষরে বিশ্ব মিডিয়ার লেখা হয়, বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন। স্বাভাবিকভাবেই এই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথটা সহজ ছিল না। এর জন্য লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল। ৯টি ম্যাচ খেলে জিততে হয়েছিল ফাইনালের টিকেট।
ফাইনালে গিয়ে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা মেলে কেনিয়ার। বাংলাদেশের জন্য তখনকার কেনিয়া আবার রীতিমতো যমদূত। কেনিয়ার বিপক্ষে মাঠে নামলেই হার সঙ্গী হতো বাংলাদেশের। কিন্তু স্বপ্নজয়ের সেই ম্যাচটিতে চোখ রাঙিয়ে বাংলাদেশকে আর দমিয়ে রাখতে পারেনি কেনিয়া। ভয়কে জয় করে মালয়েশিয়ার মাটিতে বিজয় নিশান গাড়ে বাংলাদেশ।
পুরো টুর্নামেন্টে যতটা না কঠিন আর রোমাঞ্চকর পথ পাড়ি দিতে হয় বাংলাদেশকে, এক ফাইনালেই তারচেয়ে বেশি রোমাঞ্চ দেখা হয়ে যায় আকরাম, বুলবুল, রফিক, নান্নুদের। সবচেয়ে বড় রোমাঞ্চ ছিল শেষ বলে। বৃষ্টি হানার সেই ম্যাচে নতুন লক্ষ্য দাঁড়ায় বাংলাদেশের। জয়ের জন্য শেষ বলে গিয়ে প্রয়োজন দাঁড়ায় এক রানের।
ইনিংসের শেষ বল করতে ছুটে আসছেন কেনিয়ার পেসার মার্টিন সুজি। স্ট্রাইক প্রান্তে থাকা হাসিবুল হোসেন শান্তর কাঁধে তখন পুরো জাতির স্বপ্ন। শেষ ডেলিভারিটি দিলেন সুজি, ব্যাটে লাগাতে পারলেন না শান্ত। কিন্তু সেটা তোয়াক্কা করার সময় কই! প্যাডে লাগিয়ে ভোঁ দৌড় শান্তর। অন্য প্রান্তে থাকা খালেদ মাসুদ পাইলটও ততক্ষণে পৌঁছে যান লক্ষ্যে, শিরোপা হয়ে যায় বাংলাদেশের।
১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফির কুয়ালালামপুরের সেই ফাইনালটি ছিল ক্ল্যাইম্যাক্সে ভরপুর। দুইদিন ধরে অনুষ্ঠিত হয় ফাইনালটি। টস হেরে ১২ এপ্রিল ৫০ ওভার ব্যাটিং করে কেনিয়া। তাদের ইনিংস শেষ হতেই হানা দেয় বৃষ্টি। সেদিন আর বাংলাদেশের ব্যাটিং করা হয়নি। পরের দিনে গিয়ে নতুন লক্ষ্যে মাঠে নামে বাংলাদেশ। যদিও সেখানেও ছিল বৃষ্টির হানা।
টস জিতে প্রথমে ফিল্ডিং নিয়ে যেন নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনে বাংলাদেশ। প্রথমে ব্যাটিং করতে নেমে কেনিয়াকে একাই পথ দেখান স্টিভ টিকোলো। ডানহাতি এই ব্যাটসম্যানের অনবদ্য ১৪৭ রানের সুবাদে ৭ উইকেটে ২৪১ রান তোলে কেনিয়া। বাংলাদেশের মোহাম্মদ রফিক ৩টি এবং সাইফুল ইসলাম ও খালেদ মাহমুদ সুজন ২টি করে উইকেট পান।
বৃষ্টির দাপটে ১২ এপ্রিল লক্ষ্য তাড়া করতে মাঠে নামা হয়নি বাংলাদেশের। ১৩ এপ্রিলও হানা দেয় বৃষ্টি। বৃষ্টি আইনে ম্যাচ চলে আসে ২৫ ওভারে। বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ায় ১৬৬। এই লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নেমে শুরুটা দুঃস্বপ্নের মতো হয় বাংলাদেশের। স্কোরকার্ডে কোনো রান যোগ না হতেই বিদায় নেন ওপেনার নাঈমুর রহমান দুর্জয়।
ম্যাচের দৈর্ঘ্য কমে আসায় বাংলাদেশও ব্যাটিং অর্ডার পরিবর্তন করে মাঠে নামে। দুর্জয়ের সঙ্গে ইনিংস উদ্বোধন করানো হয় মোহাম্মদ রফিককে দিয়ে। দুর্জয় ফেরার পর বাংলাদেশের ইনিংস গুছিয়ে নেন রফিক ও মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। দুজনই ২৬ রান করে করেন। তাদের ব্যাটে দলীয় হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করে বাংলাদেশ।
এ দুজন ফেরার পরও বাংলাদেশকে দিক হারাতে দেননি আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও অধিনায়ক আকরাম খান। এ দুজনের ব্যাটে আরও কিছুটা পথ পাড়ি দেয় বাংলাদেশ। বুলবুল সর্বোচ্চ ৩৭ রানের ইনিংস খেলেন। আকরাম করেন ২২ রান। শেষের দিকে পেসার সাইফুল ইসলাম ১৪ রান করে দিলে শেষ ওভারে বাংলাদেশের প্রয়োজন দাঁড়ায় ১১ রান।
৬ বলে ১১ রানের মিশন জয়ে বাংলাদেশের হাতে তখন ২ উইকেট। এর মধ্যে ব্যাটসম্যান কেবল খালেদ মাসুদ পাইলট। অন্য প্রান্তে হাসিবুল হোসেন শান্ত। ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজের দায়িত্বটুকু পালন করেন পাইলট। মার্টিন সুজির প্রথম বলেই ছক্কা হাঁকান তিনি। ৫ বলে ৫ রান প্রয়োজন দাঁড়ায় বাংলাদেশের, আর শেষ বলে ১ রান। যে রানটি নিয়ে ক্রিকেট ইতিহাসে বাংলাদেশের নামটি বসিয়ে দেন হাসিবুল হোসেন শান্ত।
ফাইনালের আগেও দুটি শক্ত পরীক্ষা দিতে হয়। কোয়ার্টার ফাইনাল বাধা আকরাম খানের ব্যাটে উতরে যায় বাংলাদেশ। ৬৮ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে দলকে জেতান সাবেক এই অধিনায়ক। ম্যাচটির কথা এখনও সেদিনের ঘটনা মনে হয় তার কাছে।
নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সেই ম্যাচটি নিয়ে আকরাম খান বলেন, 'ওই ম্যাচটা যদি আমরা হারতাম বা টাই হতো, তাহলে সেমিফাইনাল খেলতে পারতাম না। ওখান থেকেই বিদায় নিতে হতো। অনেক কঠিন অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। ওরা ১৭১ রান করেছিল, ৫০ ওভারে খুব সহজ একটা লক্ষ্য ছিল। কিন্তু ১৫ রানেই আমাদের চারটা উইকেট চলে যায়। আতহার, দুর্জয়, বুলবুল, সানোয়ার আউট হয়ে যায়। এরপর দলগত পারফরম্যান্স ছিল। আমি একটা ইনিংস খেলে দলকে জিতিয়েছিলাম। অসাধারণ একটা ম্যাচ ছিল।'
সেমিফাইনালে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে দলগত পারফরম্যান্সে জেতে বাংলাদেশ। পাইলট ৭০, বুলবুল ৫৭ ও নান্নু ৩৯ রান করেন। বল হাতে দলকে পথ দেখান এনামুল হক মনি ও মোহাম্মদ রফিক। ২৫ রান খরচায় ৪ উইকেট নিয়ে স্কটল্যান্ডের ব্যাটিং অর্ডারের শেষভাগটা গুঁড়িয়ে দেন রফিক।
রফিকের চোখেও স্পষ্ট সেই ম্যাচটি। বাঁহাতি সাবেক এই স্পিনার বলেন, 'ওই ম্যাচটার কারণেই বাংলাদেশের ক্রিকেট আজ এখানে এসেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের টার্নিং পয়েন্ট ছিল ওই ম্যাচটিই। কারণ ওই ম্যাচটা হারলে আমরা চার নম্বর হতাম। চার নম্বর হলে তো আমরা বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতাম না। ওই ম্যাচটা জিতেছি বলেই আমরা বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করি।'
আইসিসি ট্রফি জয়ে বাংলাদেশের প্রায় সব ক্রিকেটারই অবদান রাখেন। দলগতভাবে যে অনেক দুর্গম পথও পাড়ি দেওয়া যায়, সেটাই প্রমাণ করিয়ে দেখিয়েছিল ক্রিকেটের নবীন সদস্য বাংলাদেশ। তবে দলগত লড়াইয়েও পথ নির্দেশকের দরকার হয়। ব্যাট হাতে সেই সেই কাজটি করেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল।
১০ ম্যাচে দুই হাফ সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ২১৭ রান করেন বুলবুল। অধিনায়ক আকরাম খান ও মিনহাজুল আবেদীনও রানের দেখা পান। দুজনই ১৮৫ রান করে করেন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকার চার নম্বরে থাকা নাঈমুর রহমান দুর্জয় করেন ১৭৩ রান। আতহার আলীর ব্যাট থেকে আসে ১৭০ রান।
বোলিংয়ে প্রায় সব ম্যাচেই বাংলাদেশকে পথ দেখান মোহাম্মদ রফিক। ফাইনালে ৩ উইকেট নেওয়া বাঁহাতি এই স্পিনার ১০ ম্যাচে ১৯ উইকেট নেন। যা আসরের সর্বোচ্চ। কেনিয়ার আসিফ করিম, নেদারল্যান্ডসের আসিম খানের মতো আইসিসি ট্রফির সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হন রফিক। আসিফ করিম ও আসিম খানও ১৯টি করে উইকেট নেন। বাংলাদেশের আরেক স্পিনার এনামুল হক মনি পান ১২ উইকেট। পেসার হাসিবুল হোসেন শান্তর শিকার ছিল ১১ উইকেট।
১৯৯৭-২০২০, ২৩ বছরের লম্বা এই সময়ে এবড়ো-থেবড়ো পথ পেরিয়ে, টানা হারের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে আলোর পথ খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখন সমীহের প্রতিপক্ষ। এখন যেকোনো দলের চোখে চোখ রেখে লড়তে জানে ৯৭ সালের সেই নবীন বাংলাদেশ। এখন অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের মতো দলের বিপক্ষেও টেস্ট জিততে জানে বাংলাদেশ।
ওয়ানডেতে ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দলও বড় কোনো বাধা নয়। এই যে পথটা, যে পথে হেঁটে বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন দেখেন তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মুস্তাফিজুর রহমান, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনরা; এ পথটা তৈরির পেছনে ২৩ বছর আগের কুয়ালালামপুরের সেই বিকেলটি। যে বিকেলের রোদ গায়ে লাগিয়ে অনেক সাফল্যই কুড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।
১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি, ফাইনাল
বাংলাদেশ-কেনিয়া
কেনিয়া: ৫০ ওভারে ২৪১/৭ (স্টিভ টিকোলো ১৪৭, মরিস ওদুম্বে ৪৩; সাইফল ইসলাম ২/৩৯, খালেদ মাহমুদ ২/৩১, মোহাম্মদ রফিক ৩/৪০)।
বাংলাদেশ: ২৫ ওভারে ১৬৬/৮ (বৃষ্টি আইনে ২৫ ওভারে বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ায় ১৬৬) (মোহাম্মদ রফিক ২৬, মিনহাজুল আবেদীন ২৬, আমিনুল ইসলাম ৩৭, আকরাম খান ২২, খালেদ মাসুদ ১৫* হাসিবুল হোসেন ৪*; আসিফ করিম ৩/৩১, মরিস ওদুম্বে ২/১৮)।
ফল: বাংলাদেশ ২ উইকেটে জয়ী।
টুর্নামেন্টের ফল: বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন।