বেতন বাড়ানোর দাবিতে ধর্মঘটে বিশ্বখ্যাত প্রকাশনা হার্পারকলিন্সের কর্মীরা
মূল্যস্ফীতির উত্তাপে প্রায় সব দেশের অর্থনীতিতেই দেখা দিয়েছে মন্দা ভাব। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেলেও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না মানুষের বেতন। বইশিল্পও এই ধাক্কার বাইরে নয়। এবার বেতন বাড়ানোর দাবিতে ধর্মঘটে নেমেছেন বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা হার্পারকলিন্সের কর্মীরাও।
হার্পারকলিন্সের সিনিয়র প্রডাকশন এডিটর লরা হার্শবার্গার। এক মাসের বেশি সময় ধরে শিশুদের বই সম্পাদনা বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। নিউ ইয়র্ক সিটিতে ধর্মঘটরত ২০০-র বেশি সহকর্মীর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্টকে লরা বলেন, 'আমরা আমাদের চাকরির বিরুদ্ধে ধর্মঘট করছি না, বরং আমাদের চাকরির জন্য ধর্মঘট করছি। আমরা হার্পাকলিন্সের চাকরি করতে চাই—কিন্তু সেটি করতে চাই মর্যাদা, শ্রদ্ধা ও ন্যায্য বেতন নিয়ে।'
হার্পারকলিন্সের সম্পাদনা, বিক্রি, প্রচারণা, ডিজাইন, আইনি ও মার্কেটিং বিভাগের কর্মীরা ধর্মঘট করছেন। আন্দোলনরত কর্মীদের দাবি তিনটি—ন্যূনতম প্রারম্ভিক বেতন ৪৫ হাজার ডলার থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার ডলার করতে হবে, কর্মশক্তিতে বৈচিত্র্যের ঘাটতি পূরণ করতে হবে, এবং ইউনিয়নভুক্ত কর্মীদের আরও নিরাপত্তা দিতে হবে।
লেখক ও এজেন্টদের উদ্দেশে পাঠানো এক খোলা চিঠিতে হার্পারলিন্সের সিইও ব্রায়ান মারে বলেছেন, প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান বেতনভাতা প্রকাশনা শিল্পের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
কর্মীরা বলছেন, মূল সমস্যাটা ঠিক এখানেই। হার্পারকলিন্সের সিনিয়র প্রডাকশন এডিটর ডেভিড পামার বলেন, 'নিম্ন বেতনের জন্য এই শিল্প বহুদিন ধরেই কুখ্যাত। কিন্তু সারা দুনিয়া বদলে গেলেও এবং জীবন যাপনের ব্যয় বেড়ে গেলেও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রকাশনা শিল্প বদলায়নি।'
রুপার্ট মারডকের নিউজ কর্প-এর অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হলো হার্পারকলিন্স। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পাঁচ প্রকাশনীর একটি এটি।
গত ১০ নভেম্বর ধর্মঘট শুরু করেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা। এই ধর্মঘটের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে প্রকাশিতব্য বইয়ের পরিমাণ ও বৈচিত্র্যের ওপর। সামনে হয়তো দেখা যাবে মানসম্মত নয়, এমন বহু বই ছাপা হচ্ছে।
বিশেষ করে তরুণ কর্মীরা প্রকাশনা শিল্পে সবচেয়ে কম বেতন পান। আবার তাদেরকে কাজ করতে হয় বেশি। বেতন বাড়ানোর কথা বললে আবার তাদের চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেওয়া হয়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশনা শিল্পের কেন্দ্র নিউ ইয়র্ক সিটিতে বাড়িভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে প্রকাশনা শিল্পে কাজ করে আর কতদিন টিকে থাকা যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেছে।
হার্পারকলিন্সের সহযোগী সম্পাদক স্টেফানি গুয়েরদান বলেন, 'বাসাভাড়া কীভাবে দেব—এই চিন্তায় মাথায় ঘুরঘুর করতে থাকলে কেউই তার সেরাটা দিয়ে কাজ করতে পারে না।'
ছয় বছর ধরে হার্পারকলিন্সে কাজ করছেন গুয়েরদান। তিনি পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা, মার্কেটিংয়ের সঙ্গে সমন্বয়সহ তার সম্পাদককে আরও অনেক কাজে সহায়তা করেন। সহযোগী সম্পাদকের চাকরিটিকে তিনি 'স্বপ্নের কাজ' বলে অভিহিত করেন, কিন্তু সেইসঙ্গে এ-ও বলেন, 'পছন্দের কাজটা করার জন্য কারোরই তার জীবন বাজি লাগানো এবং আর্থিক-ত্যাগ স্বীকার করা উচিত নয়।'
হার্পারকলিন্সের বাইরের মলি ম্যাকগি-র মতো কর্মীরা বিশ্বাস করেন, তাদের এই ধর্মঘটই ঠিক করে দেবে আগামী বছরগুলোতে পাঠকরা কেমন বই পাবে।
বেশ কয়েকটি প্রকাশনীর হয়ে আট বছর কাজ করা ম্যাকগি বলেন, 'গত দশকে একদিকে বই প্রকাশ বেড়েছে, অন্যদিকে সম্পাদনা কর্মী কমেছে। যতদিন যথেষ্টসংখ্যক বৈচিত্র্যময় সম্পাদকরা যথেষ্ট সময় নিয়ে পড়ে অনন্য বই বাছাই করার সুযোগ না পাবেন, ততদিন সিইওরা শুধু এমন সব বই-ই বের করবেন যেগুলো আগে তাদের পকেটভারী করেছে।'
বই অনুপাতে সম্পাদকসংখ্যা কমে যাওয়ায় প্রকাশিত বইয়ের মানে প্রভাব পড়েছে। ম্যাকগি বলেন, 'সাধারণত প্রতি ২০ বইয়ের মধ্যে একটি বইয়ের মানে ঘাটতি থাকতে পারে। কিন্তু এখন প্রতি ২০ বইয়ের মধ্যে ১০টির মানেই ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, প্রকাশকরা এখন মানের ঘাটতি আছে এমন বই বের করে পাঠকদের অসম্মান করছেন। এছাড়া সম্পাদকের সংখ্যা কমিয়ে তাদের জায়গায় এজেন্টদের বসানো হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
ধর্মঘটরত কর্মীরা বলেন, এতে পাঠকরাও স্বল্প মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
হার্শবার্গার বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া টিমও ধর্মঘটে যোগ দেওয়ায় পাঠকরা আগের মতো বইয়ের খবরাখবর পাচ্ছেন না।
পাঠকদের জন্য আরেকটি চিন্তার বিষয় হচ্ছে, কিছু এজেন্ট ও লেখক ধর্মঘট শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত হার্পারকলিন্সে নতুন প্রকল্প জমা দিচ্ছেন না। এতে বই প্রকাশে বিলম্ব হবে।
হার্পারকলিন্সের মুখপাত্র অবশ্য দ্য ওয়াশিংটন পোস্টকে জানিয়েছেন যে ধর্মঘটে তাদের বইয়ের বিক্রি, মার্কেটিং পরিকল্পনা ও প্রকাশনার টাইমলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কিন্তু ধর্মঘটে নামা কর্মীরা বলেন, তাদের যেসব সহকর্মী ধর্মঘটে যোগ দেননি তারা জানিয়েছেন যে প্রতিষ্ঠানটি অস্থায়ী কর্মী ও ইন্টার্ন নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করছে।
এখন বছরের সবচেয়ে ব্যস্ত সময়, কারণ ছুটি শুরু হওয়ার আগে যথাসম্ভব কাজ গুছিয়ে আনতে চেষ্টা করেন সম্পাদকরা।
গুয়েরদান বলেন, 'অস্থায়ী কর্মীর পেছনে টাকা না ঢেলে আমাদের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসে আমাদের কাজে ফিরিয়ে নেওয়াটাই কোম্পানির জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে।'
১৯৮০-র দশকে রুপার্ট মারডক হার্পারকলিন্স কিনে নেন। তার আগে থেকেই প্রকাশনীটির ইউনিয়ন আছে।
হার্পারকলিন্সের কর্মীরা সর্বশেষ ধর্মঘটে গিয়েছিলেন ১৯৭৪ সালে। ওই সময় তিন সপ্তাহ ধর্মঘট করার পর কর্মীদের সঙ্গে প্রকাশনীর নতুন চুক্তি হয়।
হার্পারকলিন্সের ধর্মঘটরত কর্মীরা জানান, এবারের ধর্মঘট আগেরটার চেয়েও দীর্ঘস্থায়ী। হার্শবার্গার বলেন, কৃত্রিমভাবে কমিয়ে রাখা এই নিম্ন-বেতনের বিরুদ্ধে জেতার পর গোটা প্রকাশনা শিল্পেই জীবন যাপনের মতো পর্যাপ্ত মজুরির নিশ্চয়তা তৈরি হবে।
হার্পারকলিন্স দ্য ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছে, তারা এক বছরের বেশি সময় ধরে সরল বিশ্বাসে ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনা করছে। এ সময় তারা ইউনিয়নের বহু প্রস্তাবও মেনে নিয়েছে। নতুন চুক্তিতে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
প্রকাশনীটির মুখপাত্র এরিন ক্রাম বলেন, 'ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে এবং কর্মী ও কোম্পানি উভয়ের জন্য ন্যায্য একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য আমরা প্রস্তুত আছি।'
যদিও গুয়েরদান বলেছেন, সর্বশেষ পদক্ষেপ নিয়েছিল ইউনিয়ন। ধর্মঘট শুরু হওয়ার সপ্তাহখানেক আগে ইউনিয়ন প্রস্তাব রাখে, কিন্তু কোম্পানি তা আমলে নেয়নি। পরে জানিয়ে দেয় যে, তারা ইউনিয়নের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে।
গুয়েরদান বলেন, 'বল এখন তাদের কোর্টে। আমরা নিজেদের বিরুদ্ধে দরকষাকষি করতে পারব না। তারা আমাদের ফের আলোচনার টেবিলে ডাকতে পারে। তার আগপর্যন্ত আমরা এই ঠান্ডার মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকব, যত সময়ই লাগুক।'
- সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট