কেরানীগঞ্জের যে বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং শুরু হয়েছিল আগে থেকেই
আটি বাজার পৌঁছানোর পর জিরানোর দরকার হলো। আশ্রয় নিলাম ছমির শেখের চায়ের দোকানে। ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলছিলেন শেখ, "আবে গেলি কই? ছাবেরে চা দে, নাহ এইসব পোলাপাইন লইয়া পারি না আর।" ছমির শেখ গগন এমপিকে দেখেছেন। দেশ স্বাধীন হবার পর প্রথম যে সংসদ নির্বাচন হয়েছিল '৭৩ সালে, তাতে কেরানীগঞ্জ থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন বোরহানউদ্দিন আহমেদ গগন। তখন ছমির শেখ গিয়েছিলেন আরো অনেকের সংগে মোহাম্মদপুরে তার নূরজাহান রোডের বাড়িতে। কেন গিয়েছিলেন? জানতে চাইলে ছমির শেখ বললেন, "আমি তখন ছুড, বড়গো পিছ পিছ গেছিলাম।"
লেখক: বড়রা কেন গিয়েছিল?
ছমির শেখ: কিছু আটা-ময়দা আর পকেট খরচা পাইছিল মনে কয়।
লেখক: কেমন দেখতে ছিলেন গগন সাব?
ছমির শেখ: খুব সুন্দর আছিলেন। পোক্ত মানুষ।
লেখক: তাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প হইছিল, জানেন কিছু?
ছমির শেখ: না, এতো কথা জানা নাই। আপনে যান হ্যাগো বাড়িতে। খবরসবর লন। এখান থিকা সিএনজি (শেয়ারে) ভাড়া ত্রিশ টাকা।
আবার পথে নামলাম। জিনজিরা, ভাওয়াল হয়ে শেষে পৌঁছলাম কলাতিয়া। সিরাজুল আলম খানের লেখা 'স্বাধীনতা-সশস্ত্র সংগ্রাম এবং আগামীর বাংলাদেশ' বই থেকে এই বাড়ি ও গ্রামটার কথা জানতে পারি। বইটির ৫৮ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা- কেরানীগঞ্জ থানার কলাতিয়া গ্রামের রতন-গগন-মাখনদের বাড়িতে নিউক্লিয়াস-বিএলএফ সশস্ত্র ট্রেনিংয়ের যে ব্যবস্থা করেছিল তার মূল দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন বেগ।
মনে করিয়ে দেওয়া
১৯৬২ সালে সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহেমদ-এ তিন ছাত্রলীগ নেতা স্বাধীনতার পক্ষে গোপন সংগঠন হিসেবে নিউক্লিয়াস গঠন করেন। স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসই 'নিউক্লিয়াস' নামে পরিচিত। এটি স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামেও অভিহিত।
১৯৬৮ সাল নাগাদ নিউক্লিয়াস সারাদেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০০ ইউনিট গঠন করে। পাঁচ সদস্যের গোপন কমিটি নিয়ে গঠিত হতো একেকটি ইউনিট। ছাত্রলীগকে স্বাধীনতার পথে পরিচালিত করাই ছিল নিউক্লিয়াসের গোড়ার দিকের উদ্দেশ্য।
ছাত্রলীগ, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে নিউক্লিয়াস যেসব ঐতিহাসিক কাজ সংগঠিত করেছিল তার কয়েকটি হলো-জাতীয় পতাকা তৈরি, জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান নির্ধারণ, স্বাধীনতার ইশতেহার তৈরি, ৬ দফা ও ১১ দফাকে এক দফায় রূপান্তর করে স্বাধীনতার বিষয় সামনে নিয়ে আসা ইত্যাদি (সূত্র: স্বাধীনতা-সশস্ত্র সংগ্রাম এবং আগামীর বাংলাদেশ, সিরাজুল আলম খান)।
কলাতিয়া গ্রাম
ঢাকার নয়াবাজার ব্রিজ পার হয়ে কদমতলী থেকে ডানের নবাবগঞ্জ দোহারের রাস্তা ধরে আটি বাজার বা রামেরকান্দা হয়ে যাওয়া যায় কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া ইউনিয়নে।
মোহাম্মদপুরের বসিলা হয়েও যাবার পথ আছে। বেশ পুরোনো এখানকার বসতি। ভাওয়াল রাজার কাচারি ছিল কলাতিয়া বাজারে। একটি নীল কুঠির ধ্বংসাবশেষও আছে এখানে।
রতন-গগন-মাখনদের বাড়ি
কলাতিয়ার আকছাইল গ্রামে বড়সড় এক বাড়ির নাম খান সাহেবের বাড়ি। লোকে গগন এমপির বাড়ি বা রতন চেয়ারম্যানের বাড়ি নামেও চেনে। শামছুদ্দিন আহমেদ ছিলেন বাড়ির মালিক। ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ রাজ বাড়ি বয়ে এসে তাকে খান সাহেব খেতাব দিয়ে যায়। দেশভাগের সময় তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের নেতা। তার চার সন্তান আনোয়ার উদ্দিন আহমেদ ওরফে তোতা মিয়া, আরফান উদ্দিন আহমেদ রতন, বোরহান উদ্দিন আহমেদ গগন এবং হেলাল উদ্দিন আহমেদ মাখন। তোতা মিয়া ছাড়া সকলেই ছিলেন ছাত্রলীগ কর্মী।
বিশেষ করে গগন ছিলেন বৃহত্তর ঢাকা জেলা মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ-বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) অধিনায়ক। গগন ১৯৯২ সালে অকালেই মারা যান। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর পরই গগন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং সাড়ে তিন বছর জেলখানায় নির্যাতনের শিকার হন।
জানা যায়, উনসত্তরের গণআন্দোলনের আগে থেকেই গগনদের বাড়ি জাতীয় নেতাদের আশ্রয়স্থল (শেল্টার) হয়ে উঠেছিল আর ২রা মার্চ থেকে হয়ে উঠেছিল সশস্ত্র যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শিবির। তাইতো মুক্তিযুদ্ধ গবেষক এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসংরক্ষক কলাতিয়ার আতিকুজ্জামান পিন্টু বলছিলেন, 'গগন সাহেবদের বাড়ি থেকেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল বলতে পারেন। গগন সাহেবের স্ত্রীও ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। জগন্নাথ কলেজে পড়ার সময় তিনি ছাত্র নেতাদের সহচর্য পেয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সভায়ও যোগ দিতেন।'
ক্যাপ্টেন বেগ
পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের বাঙ্গালি ক্যাপ্টেন ছিলেন মাহফুজ আলম বেগ। বিদ্রোহ করে চলে আসেন ঢাকায়। ৩২ নম্বরে গিয়ে দেখা করেন বাঙ্গালির মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। পালিয়ে আসা ক্যাপ্টেন বেগের থাকার জন্য একটি নিরাপদ জায়গা দরকার। তখন নিরাপদে লুকানোর জায়গা ছিল ওই একটিই, গগন-রতনদের বাড়ি। বঙ্গবন্ধু সেখানে যাওয়ার নির্দেশ দেন বেগকে।
হেলাল উদ্দিন আহমেদ মাখনের সন্তান শিহাব উদ্দিন রানার সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলা২৪ এর প্রতিবেদক তানজির মেহেদীর। তানজিরকে তিনি বলেন, গোপন আশ্রয়ে এসেও চুপচাপ বসে ছিলেন না ক্যাপ্টেন বেগ। সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। আশপাশের গ্রামের ছাত্রলীগ কর্মী আর যুবকদের তিনি সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন।
আরো বলেন, "বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই আমাদের বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র সংগ্রামের প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করা হয়। নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন বেগ চাচা।"
কলাতলী বাজারে নামার পর
একটি বিরাট জলকড়ই গাছের তলায় বাজারটি। গুড়ের দোকান, তেলের দোকান, চালের দোকান, চায়ের দোকান ইত্যাদি।
কলাতলী বাজারে নামার পর একটি বিরাট জলকড়ই গাছের তলায় বাজারটি। গুঁড়ের দোকান, তেলের দোকান, চালের দোকান, চায়ের দোকান ইত্যাদি সবকিছুই আছে। ভাওয়াল রাজার কাচারি ঘরটি বাজারের মাঝখানে (এখন ভূমি অফিস)। একটা সিনেমা হলও ছিল, সেটি এখন বন্ধ।
বাজারের এক গুঁড়ের দোকানির কাছে জানতে চাইলাম, গগন সাহেবদের সময়কালের কেউ কি আছেন আপনার জানামতে? তিনি ভাবলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন মিঠাপুরে কাশেম বেপারী আছেন। গগন সাহেবদের বাড়ির কাছেই বাড়ি।
কাশেম বেপারীর বাড়ি পেতে দেরি হলো না বেশি। ছোট্ট একটি উঠান-বাগান পেরিয়ে ড্রইংরুম। দুপুরের খাবার খেয়ে ছোট ছেলে আরমানের সঙ্গে বসে খামারের খবর নিচ্ছিলেন। মাছের খামার আছে তাদের। আরমান হোটেল ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে পড়াশোনা করে কিছুদিন ঢাকার র্যাডিসন হোটেলে কাজ করেছেন। পরে খামার দেখাশোনা করতে বাড়ি চলে এসেছেন।
কাশেম বেপারীর (গোলাম মোস্তফা কাশেম) বয়স সত্তরের কিছু বেশি। গগন এমপি তাকে স্বাধীনতার চেতনায় দীক্ষিত করেছিলেন। বললেন, "গগন সাহেব আমার চেয়ে ১৫-২০ বছরের বড় ছিলেন। জীবন বীমা অফিসে কাজ করতেন। তখনকার ছাত্রলীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান, ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমেদ, আসম আব্দুর রব প্রমুখের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। কলাতিয়া স্কুলে পড়তাম; কৃষকের সন্তান আমি। খুব বেশি কিছু বুঝতাম না। তবে পশ্চিমারা যে দেশটাকে লুটে নিচ্ছে তা বুঝতে পেরেছিলাম।"
"৭ মার্চের ভাষণ শুনতে কেরানীগঞ্জ থেকে কম করেও ১০ হাজার মানুষ গিয়েছিল। গগন সাহেবের নেতৃত্বে আমরা দশটায় বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। ব্যানার হাতে স্লোগান দিতে দিতে যাচ্ছিলাম। মোড়ে মোড়ে, বাজারে বাজারে লোকেরা আমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছিল। পুরোটা পথ হেঁটে গিয়েছিলাম। নদী পার হয়েছিলাম সওয়ারিঘাট দিয়ে। ঘাট মাঝিদের সবার হাতে ছিল বৈঠা। ঘাট পার হয়ে চকবাজার তারপর জেলখানা পার হয়ে রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছাই। ততক্ষণে দুপুর শেষ। সকালে বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে বেড়িয়েছিলাম, তারপর রাতে আবার বাড়ি এসেই খেয়েছিলাম। মাঝখানে আর খাওয়ার কথা মনে ছিল না।"
লেখক: বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে তো তখন অনেক জল্পনা-কল্পনা চলছিল। শুনে কি মনে হলো আপনাদের মনের কথাই বললেন তিনি?
কাশেম বেপারী: ভাষণের দুটি কথা, যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকো আর এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম- আমাদের মনের কথাই ছিল। এ কথাগুলায় স্বাধীনতার ঘোষণা আছে। নিউক্লিয়াসের নেতাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিল বেশি তাই আমরা আগে থেকেই জানতাম তিনি ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণাই দেবেন।
পঁচিশে মার্চের পর অনেক নেতাই গগন সাহেবদের বাড়িতে এসেছিলেন। আমি ট্রেনিং নিতে রওয়ানা হয়েছিলাম আষাঢ় মাসের শেষাশেষি। আমাদের বাড়ির পেছন দিকের খালে ছিল নৌকাটা। হাতে বাওয়া নৌকা। আমরা আটজন। চিড়া-মুড়ি নিয়ে উঠলাম সকালে। মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। আমাদের সঙ্গে থানা আওয়ামী লীগের নেতার দেওয়া গাইডলাইন ছিল- মানে কোথায় গিয়ে কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
পরের দিন আমরা দাউদকান্দির উজানচরে গিয়ে থামলাম। এখান দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে। মিলিটারির গাড়ির আসা যাওয়া অনেক। আমাদের তাই ভাগ ভাগ হয়ে যেতে হলো। তখন সময়টা আলাদা ছিল। সবাই সবাইকে সাহায্য করত, খাওয়াতো, থাকতে দিত, লাগলে জামাকাপড়ও দিত।
আমরা তিনদিন নৌপথে চলে আগরতলা পৌঁছেছিলাম। মেলাঘরে মেজর হায়দার আমাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। দুইমাস প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরি।
লেখক: আপনি কী কী অস্ত্র চালনা শিখেছিলেন?
কাশেম বেপারী: আমরা তো সম্মুখ যুদ্ধের প্রশিক্ষণ পাইনি। গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং পেয়েছি। নিজেকে যতটা পারা যায় নিরাপদ রেখে শত্রুকে ক্ষতিগ্রস্ত করাই ছিল আমাদের মূল লক্ষ্য। আমরা শত্রুকে ব্যস্ত রাখতাম, বিভ্রান্ত করতাম। আমি থ্রি নট থ্রি, এলএমজি চালাতে শিখেছিলাম। ডিনামাইট ফাটাতে পারতাম, গ্রেনেড ছোড়ার কৌশল রপ্ত করেছিলাম।
লেখক: দেশে ঢুকে আপনারা ক্যাম্প করলেন কোথায়?
কাশেম বেপারী: নবাবগঞ্জের পাড়াগ্রামে। মেজর হায়দার আমাদের নেতৃত্ব দিতেন। পাড়াগ্রাম এমন জায়গা যেটা ছিল কালিগঙ্গা আর ধলেশ্বরী নদীর মুখে। মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল আর ঢাকায় ঢোকার মুখ আমরা বন্ধ করে দিতে পারতাম। আমরা পাকবাহিনীর খাবারসহ নানারকম রসদ আটকে দিতাম। তবে যুদ্ধ যে এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে ভাবিনি।
লেখক: দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কী করলেন?
কাশেম বেপারী: তখন তো আমরা ভলান্টিয়ার। এলাকায় যেন চুরি ডাকাতি না হয়, আইন শৃংখলা যেন বজায় থাকে ইত্যাদি ব্যাপারে কাজ করতাম।
এবার যুদ্ধবাড়িতে
কাশেম বেপারীর বাড়ি থেকে বেশি দূরে না রতন-গগনদের বাড়ি। বিরাট বড় বাড়িটা। ঢোকার মুখেই মসজিদ। তারপর একটা টিনের ঘর। তারপর বড় একটা সবুজ উঠান, গাছপালা অনেক বাড়িটায়। পুকুরই আছে পাঁচটা। নারকেল গাছ ঘেরা সবগুলো পুকুর। রতন-গগন-মাখন –তোতা মিয়া- শামছুদ্দিন খান সাহেবের বাঁধানো কবর আছে একটা পুকুরের ধারে। রতন চেয়ারম্যান বেঁচে থাকতে একটা দ্বিতল ভবন তুলেছিলেন। তার একটা অফিস ঘরও আছে টিনের। শামছু কুঞ্জ নামের পাকা ভিতের টিনের বাংলোতে থাকেন গগন এমপির স্ত্রী ইয়াকুত আরা আহমেদ।
ঘুরে ঘুরে দেখি আর শিহরিত হই। আমাদের মুক্তি সংগ্রামের অনন্য সব স্মৃতি ধরে আছে বাড়িটি। মুক্তিসংগ্রামী নেতা-কর্মীরা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে এ বাড়িতে আশ্রয় নিতেন, পরবর্তী কর্মসূচীও ঠিক করতেন এখানে বসেই। আব্দুর রাজ্জাক, শাহজাহান সিরাজ, আসম আব্দুর রবদের কাছে এটা ছিল অনেকটা নিজের বাড়ির মতোই।
'মুজিবনগর দিবসের স্মৃতিকথা' শিরোনামে এক নিবন্ধে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ লিখেছেন, '…কেরানীগঞ্জে আমাদের সাবেক সংসদ সদস্য বোরহানউদ্দিন গগনের বাড়িতে আমরা আশ্রয় গ্রহণ করি। জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী সাহেব এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান সাহেব, মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমিসহ স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত হলো মণি ভাই ও আমি, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান সাহেবকে নিয়ে ভারতের দিকে যাব।'
শামসুদ্দিন পেয়ারার লেখা 'আমি সিরাজুল আলম খান: একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য' বইয়ের 'স্বাধীনতার প্রস্তুতিপর্ব' অধ্যায়ে সিরাজুল আলম খানের উদ্ধৃতিতে বাড়িটির কথা এভাবে বলা হয়েছে: '… ১৯৬৬-৬৭ এ দুই বছর আমরা স্বাধীনতার বিষয়টিকে শুধু স্লোগানে সীমাবদ্ধ না রেখে পরবর্তী পর্যায়ের করণীয়সমূহ নিয়েও চিন্তাভাবনা করতে শুরু করি। এজন্য কেরানীগঞ্জ থানার কলাতিয়ায় রতন-গগন-মাখনদের বাড়িটিকে আমরা আমাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করতে থাকি। এই তিন ভাইয়ের বড়জন রতন আমার খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। অবস্থাপন্ন এই পরিবারটি শুধু আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাই নয়, বরং আর্থিক ও অন্যান্যভাবে আমাদের সশস্ত্র কার্যক্রমেও সহায়তা করে।…'
গগন সাহেবের স্ত্রী ইয়াকুত আরার বড় বোনেরও এ বাড়িতেই বিয়ে হয়েছিল। তার বাবার বাড়ি ডেমরার মাতুয়াইলে। শ্যামবাজারের শুকলাল দাস লেনেও তাদের বাড়ি আছে। পড়তেন বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয়ে। বিয়ে হয় '৬৭ সালে। গগন সাহেব বিয়ের পরপরই বলেছিলেন, "মুক্তির সংগ্রামে নেমেছি, কখন কী হয় বলা যায় না। তুমি নিজে যতটা পারো গুছিয়ে নাও।" ইয়াকুত আরা বিয়ের পরও পড়েছেন। গগন কলাতিয়া স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন স্কুলবেলাতেই। দেশ মুক্তির স্বপ্নে বিভোর থাকতেন। একরকম জোর করেই তাকে ঢাকার কিছু দূরে মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে পড়তে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু গগন দেশ মুক্ত না হলে থামবার পাত্র ছিলেন না।
বিয়ের পর পর কিছুদিন গগন-পরিবার ছিলেন ওয়ারির র্যাংকিং স্ট্রিটে। সে বাড়িতে বিএলএফ নেতৃবৃন্দের এক বৈঠক হয়েছিল মনে করতে পারেন ইয়াকুত আরা। আব্দুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান ছিলেন বৈঠকে। গগন বাসা নিয়েছিলেন মালিবাগেও। সেখানে আব্দুর রাজ্জাক থেকেছেনও। ইয়াকুত আরা ও গগনের প্রথম সন্তান শাওনের জন্ম ১৯৬৮ সালে আর দ্বিতীয় সন্তান গর্ভে আসে সত্তরে।
একাত্তরের মার্চের পহেলা দিনে ইয়াহিয়া গণ পরিষদের বৈঠক স্থগিত করলেন। বাঙালির বুঝতে বাকি রইল না পশ্চিমারা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। পরেরদিন অর্থাৎ ২ মার্চে ক্যাপ্টেন বেগ গগনদের বাড়িতে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করলেন।
ইয়াকুত আরা বলছিলেন, "আমরা মালিবাগের বাসায় তখন। গগন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গেছেন। আমাকে বললেন, 'কলাতিয়া যাচ্ছি, বাড়িতে আজ থেকে ট্রেনিং শুরু হচ্ছে। তোমরা সাবধানে থেকো।' বাড়িতে আমাদের দুটি বন্দুক ছিল, বেগ সাহেবের নিজের পিস্তল থেকে থাকবে, আশপাশের ইপিআর জোয়ানদেরও হাতিয়ার বাড়িতে জড়ো করা হয়েছিল। সম্ভবত ১০-১২ জন ছিল প্রথম দিনের ট্রেনিংয়ে। এভাবে কয়েকদিনই ট্রেনিং হয়েছিল।"
"তারপর তো এলো ২৫ মার্চের কালোরাত, কিন্তু আমার নড়বার সুযোগ ছিল না। শ্যামবাজারে বাবার বাড়িতে ২৯ মার্চ আমার দ্বিতীয় সন্তান জন্ম নিল। বাবা ওর নাম রাখলেন, সংগ্রাম। তার কিছুদিন পরই আমরা চলে এলাম কলাতিয়া। জুন মাস পর্যন্ত ছিলাম বাড়িতেই। মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিতে যাওয়ার আগে আমাদের বাড়িতে এসে উঠত। প্রতিদিনই ২০-২৫ জনের জন্য রান্না হতো বাড়িতে। তখন শোল মাছ, রুই মাছ, সবজি পাওয়া যেত খুব। দুধও পাওয়া যাচ্ছিল সস্তায়। আমার ভাসুররা ছিলেন উদারহস্ত। গগনসাহেব তো ততদিনে দেশের ওইপারে চলে গেছেন,"
"এরমধ্যে বাড়িতে একদিন মিলিটারি এলো। বেশি কোনো ঝামেলা পাকালো না। কিন্তু গগন সাহেব ওখান থেকেই খবর পেয়ে গেলেন। ট্রেনিং ফেরত এক মুক্তিযোদ্ধা মারফত চিঠি দিলেন আমরা যেন আগরতলা চলে যাই। ট্রেনিংয়ে যাবে এমন ১০-১২ জন তরুণের সঙ্গে আমি বাচ্চাদের নিয়ে রওয়ানা হই। মুন্সিগঞ্জ হয়ে দাউদকান্দি গিয়ে পড়ি বিপদে। রাস্তায় মিলিটারির আনাগোনা। তখন রাজাকার খাতায় নাম লিখিয়েছে এমন ছেলেরাও আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। তারা কোকিল বা কাকের ডাক নকল করে আমাদের ইংগিত দিত। মানে কোকিল ডেকে উঠলে রাস্তা ক্লিয়ার আর কাক ডাকলে বিপদ সামনে," বলে চলছিলেন ইয়াকুত আরা।
"চার দিন পথে কাটিয়ে আমরা পৌঁছালাম আগরতলা। সেটা এক অন্যরকম সময় ছিল। মানুষ যে মানুষের কত ভালো বন্ধু হতে পারে তা যুদ্ধের দিনগুলোতে দেখেছি।"