জুলাই-সেপ্টেম্বরে শিল্প ঋণ বিতরণ বেড়েছে ২৩%
শিল্পখাতের কাচাঁমাল ও মুলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও ব্যাংক ঋণের সুদহার কম থাকায়, চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে শিল্পখাতের ঋণ বিতরণ বেড়েছে ২৩ শতাংশ।
ব্যাংকাররা বলেন, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে শিল্পখাতে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এছাড়া দেশে ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে এলসি পেমেন্টে অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে যার কারণে শিল্প ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে শিল্পখাতে ঋণ বিতরণ হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে গত বছরের তুলণায় ঋণ বিতরণ বেড়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
এদিকে ঋণ বিতরণের সঙ্গে ঋণ আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে শিল্প খাতে। চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে ঋণ আদায় হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৮২ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা। সে হিসেবে আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে ২২.৩৮%।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "আমাদের ওভারঅল বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। তেমনি শিল্প ঋণের প্রবৃদ্ধি হবে এটাও স্বাভাবিক। আমাদের ব্যাংক ঋণের সুদের হার কম, ব্যবসায়ীরা স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ায় ঋণ বিতরণের পরিমাণ বেড়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "চলতি বছরের শুরু থেকে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ও র মেটেরিয়াল ব্যাপকভাবে আমদানি হয়েছে।"
"এছাড়া কোভিডকালে যে পেমেন্টগুলো ডেপার্ড সুবিধা পেয়েছে। তা উঠে যাওয়ার কারণে টাকায় লোন তৈরি হয়েছে। এর কারণে শিল্প ঋণের পরিমাণটা বেড়েছে," যোগ করেন মাহবুবুর রহমান।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য থেকে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসের আগের অর্থবছরের তুলনায় ইমপোর্ট সেটেলমেন্টের পরিমাণ বেড়েছে ৩৫%।
চলতি অর্থবছরে (জুলাই-সেপ্টেম্বরে) আমদানি এলসি সেটেলমেন্টের পরিমাণ ছিল ২২.৪৪ বিলিয়ন ডলার। যা আগের অর্থবছরের একই সময় ছিল ১৭.০৬ বিলিয়ন ডলার।
চলতি অর্থবছরের তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি বেড়েছে ৫৭.৩৪%, ইন্ডাস্ট্রিয়াল র ম্যাটেরিয়াল আমদানি বেড়েছে ২৬.৯৬%।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান রিপোর্ট বলছে, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে দেশে ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকা। এই সময়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২.২৪%।
দেশে কোভিডের কারণে গত দুই বছরে শিল্প ঋণের পরিমাণ কম ছিল। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে শিল্প ঋণ বিতরণ হয়েছে ৯৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। তারপর ২০২১ সালে শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ হয়েছে ১ লাখ ৬৫৯৬ কোটি টাকা।
যদিও কোভিডের আগের বছরগুলোতে শিল্প ঋণের বিতরণ আরও বেশি ছিল। গত ১৯ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকেও ১ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালের জুলাই মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮.৩৮%। ধীরে ধীরে বৃদ্ধির পর, এ বছরের জানুয়ারিতে তা ১১.০৭ শতাংশে পৌঁছেছে।
তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা মন্থর হয়ে ১০.৮৭% হয়েছে, তারপর তা আগস্ট পর্যন্ত বাড়তে থাকে। সেপ্টেম্বরে এটি ১০ শতাংশ পয়েন্ট এবং অক্টোবরে ২ শতাংশ পয়েন্ট কমেছে।
সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ২৪.৬০%
চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণ আগের বছরের তুলনায় ২৪.৬০% বেড়েছে।
২০২১ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে এই খাতে ১.২৮ লাখ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছিল। চলতি বছরের একই সময়ে বিতরণ করা হয়েছে ১.৬০ লাখ কোটি টাকা। সে হিসাবে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণ বিতরণ বেড়েছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা।
অবশ্য এই খাতে ঋণ বিতরণ আগের প্রান্তিকের তুলনায় গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ৮.৫১% কমেছে, জানা গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য থেকে।
চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ব্যাংক ও এনবিএফআই মিলে ঋণ বিতরণ করেছে ৫১,৬৭৭ কোটি টাকা। যদিও আগের (এপ্রিল-জুন) সময়ে বিতরণের পরিমাণ ছিল ৫৬,৪৮৪ কোটি টাকা।
ঋণ বিতরণ আগের বছরের তুলনায় বাড়লেও চলতি (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রান্তিকে আগের প্রান্তিকের চেয়ে কমে যাওয়ায় আশঙ্কা প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
তিনি টিবিএসকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এ বছরের ডিসেম্বর শেষে মোট বিতরণ করা ঋণের ২৩%, ২০২৩ সাল শেষে ২৪% এবং ২০২৪ সাল শেষে ২৫% সিএমএসএমই খাতে বিতরণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল ব্যাংকগুলোকে। "তবে, বছর শেষে প্রতিষ্ঠানগুলো এ লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে না বলে আমাদের ধারণা। গতবছরও তারা টার্গেটের ৮০ শতাংশের কাছাকাছি হারে লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছিল।"
তবে লক্ষ্য পূরণ করতে না পারলেও ঋণ বিতরণ আগের বছরের তুলনায় বাড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, "কোভিডকালীন সময়ে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী নতুন করে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থেকেছেন। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় ব্যবসায়ীরাও বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন।"
এই খাতে ব্যাংকগুলো কেন ঋণ বিতরণে লক্ষ্য পূরণ করে পারছে না জানতে চাইলে সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণ করা ব্যাংকগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানীয় একটি ব্যাংকের এমডি টিবিএসকে বলেন, "এই খাতে ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোর অপারেটিং কস্ট অনেক বেশি হয়। বেশিরভাগ ব্যাংকই এটাকে ঝামেলা হিসেবে দেখে। তারা ছোট এসব ঋণ বিতরণের চেয়ে লার্জ লোন ডিসবার্স বেশি করার দিকেই বেশি মনযোগী।"
"অথচ সিএমএসএমই খাতে বিতরণ করা ঋণের মধ্যে ক্লাসিফাইড হওয়ার রেশিও অনেক কম অন্য লোনের তুলনায়। তাই, ভালো ব্যাংকগুলো এই খাতে ঋণ দিতে ধীরে ধীরে ঝুঁকছে," যোগ করেন তিনি।