পেলে: পায়ের জাদুতে ফুটবলের মহাকাব্য লিখেছেন! যে নক্ষত্রের মৃত্যু নেই...
সাবেক ইংলিশ ফুটবলার ববি চার্লটন বলেছিলেন, 'ফুটবল খেলার আবিষ্কারই হয়েছে তার জন্য।'
বলাই বাহুল্য যে বেশিরভাগ ধারাভাষ্যকার তাকে অভিহিত করেছেন ফুটবল নামক নান্দনিক খেলাটির সর্বশ্রেষ্ঠ নজির হিসেবে।
তিনি এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো, ডাকনাম 'পেলে'। লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলের জাতীয় নায়ক, ক্রীড়াজগতের বিশ্বব্যাপী আইকন। পেলের দক্ষতা ও বিদ্যুতের গতিতে বল নিয়ে দৌড়ানোর ক্ষমতাকে পরিপূর্ণ করেছে গোলবারের সামনে তার মারাত্বক নির্ভুলতা।
আর মাঠের বাইরে এই মহানায়ক সারাজীবন কাজ করে গেছেন সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায় ও তাদের অবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে।
পেলে কেন সর্বকালের সেরা তা তার ক্যারিয়ারের দিকে এক নজর চোখ বুলালেই টের পাওয়া যায়। সর্বকালের সেরা নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক না কেন, সমঝদার ব্যক্তিমাত্রই বুঝতে পারবেন ফুটবলার হিসেবে পেলে নিজেকে কোন মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন। শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে তিনি নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন বারবার।
তরুণ তারকা
১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর দক্ষিণপূর্ব ব্রাজিলের ট্রেস কোরাকোয়েস শহরে জন্মগ্রহণ করেন এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো। জন্ম সনদে অবশ্য তার জন্মের তারিখ লেখা ছিল ২১ অক্টোবর। কিন্তু এ বিষয়ে পেলের ভাষ্য ছিল, "ব্রাজিলে আমরা নির্ভুলতা নিয়ে অতটা মাথা ঘামাই না।"
বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের নামানুসারে পেলের নাম রেখেছিলেন তার মা-বাবা। পেলের ভাষ্যমতে, তার জন্মের ঠিক আগেআগেই তাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ এসেছিল। পরবর্তীতে তার নাম থেকে ইংরেজি 'আই' অক্ষরটি বাদ দেন তার বাবা-মা।
ব্রাজিলের বাউরু শহরে দারিদ্র্যতার মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন পেলে। একটু বড় হয়েই স্থানীয় ক্যাফেতে পার্ট-টাইম কাজ করে বাবা-মাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন তিনি। পেলের বাবা তাকে ফুটবল খেলা শিখিয়েছিলেন, কিন্তু তাকে একটা বল কিনে দেওয়ার টাকাও ছিল না তার পরিবারের কাছে। তাই কিশোর পেলে প্রায়ই বিভিন্ন ফেলনা কাপড়-মোজা জড়ানো একটা পুটুলির মতো বল নিয়ে রাস্তায় খেলতেন।
শুধুই 'পেলে'
স্কুলে থাকতে বন্ধুরা এডসন আরান্তেসকে নাম দেয় 'পেলে', কিন্তু সেই বন্ধুদের বা পেলের নিজেরও কোনো ধারণা ছিল না এই নামের অর্থ কী। অনেকেই জেনে হয়তো অবাক হবেন যে নিজের এই ডাকনাম পেলে তেমন পছন্দই করতেন না, তার কাছে মনে হতো এই নামটা পর্তুগিজ ভাষায় অনেকটা 'বেবি টক' এর মতো লাগে।
টিনেজ বয়সে স্থানীয় কয়েকটি ক্লাবের হয়ে খেলতে শুরু করেন পেলে। সেসময় ওই অঞ্চলে ইনডোর ফুটবল সবে জনপ্রিয় হচ্ছে এবং তরুণ পেলেও সেই পরিবর্তনের স্বাদ পেয়েছিলেন। পরে এ বিষয়ে পেলে বলেছিলেন, "মাছকে যেমন নদীতে নিয়ে যাওয়া হয়, আমার কাছেও ব্যাপারটা তেমনই ছিল। মাঠে ঘাসের মধ্যে ফুটবল খেলার চেয়ে ওটা আরও গতিময় ছিল- ওখানে আপনাকে অনেক দ্রুত চিন্তাভাবনা করতে হবে।"
বাউরু অ্যাথলেটিক ক্লাবের জুনিয়রদের নেতৃত্ব দিয়ে ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নশিপ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্বও ছিল পেলের, ফলে দ্রুতই তরুণ প্রতিভা হিসেবে খ্যাতি পেয়ে যান পেলে। ১৯৫৬ সালে তার কোচ ওয়ালদেমার দে ব্রিতো তাকে বন্দর নগরী সান্তোসে নিয়ে যান সান্তোস এফসি ক্লাবে যোগাদান করানোর চেষ্টায়। আর এখান থেকেই শুরু হয় পেলের কিংবদন্তি হয়ে ওঠার যাত্রা।
দে ব্রিতো ইতোমধ্যেই তার শিষ্যের ক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন এবং সান্তোসের কর্তাদের কাছে গর্ব করে বলেছিলেন যে পেলে একদিন সর্বকালের সেরা ফুটবলার হবেন।
কোচের সেই কথাকে মিথ্যা প্রমাণ করেননি পেলে। সান্তোসে পা রাখামাত্রই দিন দিন নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন পেলে। তার ফুটবল দক্ষতায় সান্তোসের কর্মকর্তারা এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তাকে ১৯৫৬ সালের জুন পর্যন্ত ক্লাবে রেখে দেওয়ার চুক্তি করেন। সেসময় পেলের বয়স মাত্র ১৫ বছর।
শীর্ষ গোলদাতা
বছরখানেক বাদে সান্তোসের সিনিয়র টিমে খেলার জন্য নির্বাচিত হন পেলে এবং প্রথম ম্যাচে মাঠে নেমেই সান্তোসের হয়ে প্রথম গোল করেন তিনি। খুব শীঘ্রই দলের শুরুর একাদশে জায়গা করে নেন পেলে এবং ক্লাবে প্রথম বছরেই শীর্ষ গোলদাতা হন তিনি।
সান্তোসের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার মাত্র দশ মাসের মাথায় ব্রাজিল জাতীয় ফুটবল দলে খেলার ডাক পান পেলে।
যে উদ্দেশ্য নিয়ে তাকে জাতীয় দলে ডাকা হয়েছিল তা বেশ ভালোভাবেই পূরণ করতে পেরেছিলেন ১৬ বছর বয়সী পেলে। আন্তর্জাতিক ম্যাচে সবচেয়ে তরুণ খেলোয়াড় হিসেবে গোল করেছিলেন তিনি।
কিন্তু হঠাৎ করেই হাঁটুর ইনজুরির কারণে ব্রাজিলের হয়ে ১৯৫৮ বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নভঙ্গ হয়ে যায় পেলের। কিন্তু তার সতীর্থরা টিম ম্যানেজমেন্টকে চাপ প্রয়োগ করে পেলেকে দলে নেওয়ার জন্য। ফলে নিজের প্রথম বিশ্বকাপে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে অভিষেক হয় তার।
হ্যাটট্রিক
বিশ্বকাপে মাঠে নামবেন আর গোল করবেন না পেলে, তা কি হয়! ওয়েলসের বিপক্ষে সবচেয়ে তরুণ খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপে গোল করেন তিনি। সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে ব্রাজিল ২-১ গোলে এগিয়ে ছিল, এরপর দ্বিতীয়ার্ধে পেলের হ্যাটট্রিকে বিশাল জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে ব্রাজিল।
ফাইনালেও ব্রাজিলের জয়ে ভূমিকা রাখেন পেলে। সুইডেনের বিপক্ষে পেলের জোড়া গোলে ৫-২ ব্যবধানের জয় নিয়ে বিশ্বকাপ জেতে ব্রাজিল। আর সেই টিনেজ বয়সেই পেলে পেয়ে যান বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ!
১৯৫৮ সালে সান্তোসকে সাও পাওলোর শীর্ষ লীগ প্রতিযোগিতা জিততে সাহায্য করেছিলেন পেলে এবং ওই মৌসুমে ক্লাবের শীর্ষ গোলদাতা হয়েছিলেন তিনি।
১৯৬২ সালে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন বেনফিকার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক এক জয় লাভ করেন পেলে। লিসবনে পেলের হ্যাটট্রিকে পর্তুগিজদের ভরাডুবি ঘটে এবং তাদের গোলকিপার কস্তা পেরেইরার প্রশংসাবাক্য ছিল পেলের উদ্দেশ্যেই।
পেরেইরা বলেছিলেন, "আমি একজন শ্রেষ্ঠ ফুটবলারকে থামানোর উদ্দেশ্য নিয়ে মাঠে এসেছিলাম। কিন্তু আমি এখন নিশ্চিত যে আমাকে যেই মানুষটা পরাজিত করেছে সে আর দশজনের মতো সাধারণ মানুষ হিসেবে জন্ম নেয়নি।"
জাতীয় সম্পদ
১৯৬২ বিশ্বকাপ ছিল ব্রাজিলের জন্য হতাশার, কারণ টুর্নামেন্টের শুরুতেই ইনজুরির কারণে সাইড বেঞ্চে বসে কাটাতে হয়েছে পেলেকে। কিন্তু তাতে করে পেলেকে দলে টানার জন্য নামিদামি ক্লাবের লাইন লেগে যাওয়া থেমে থাকেনি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদের মতো ধনী ক্লাবগুলো পেতে চেয়েছে পেলেকে।
কিন্তু পেলের বিদেশি ক্লাবে খেলার বিষয়ে প্রবল আপত্তি ছিল ব্রাজিল সরকারের। তার বিদেশে খেলা ঠেকাতে পেলেকে 'জাতীয় সম্পদ' ঘোষণা করে তারা।
১৯৬৬ বিশ্বকাপ পেলে ও ব্রাজিল জাতীয় দলের জন্য ছিল চরম হতাশার। এই বিশ্বকাপে পেলেকে টার্গেট করা হয় এবং ক্রমাগত ফাউল করা হয় প্রতিটি ম্যাচে, বিশেষ করে পর্তুগাল ও বুলগেরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে। ফলে প্রথম রাউন্ড পেরোতেই ব্যর্থ হয় ব্রাজিল এবং ফাউলের কারণে আঘাতপ্রাপ্ত পেলে তার সেরাটা দিতেই পারেননি।
ব্রাজিলে ফিরে যাওয়ার পর দেখা যায় সান্তোসও ভালো ফল করতে পারছে না এবং সেবছর পেলেও সান্তোসের হয়ে সেরা পারফরমেন্স দেখাতে পারেননি।
সর্বশ্রেষ্ঠ দল
১৯৬৯ সালে পেলের বয়স ত্রিশ ছুঁই ছুঁই, ব্রাজিলের হয়ে ১৯৭০ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপ খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।
পেলে বামপন্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল-এমন সন্দেহে সেসময় ব্রাজিলের সামরিক স্বৈরশাসকের হাতে তদন্তের মুখেও পড়তে হয়েছিল ফুটবলের রাজাকে। ১৯৭০ বিশ্বকাপে পেলে চারটি গোল করেন এবং এই বিশ্বকাপের ব্রাজিল দলকে মনে করা হয় ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ দল।
গ্রুপ পর্বে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে আসে সবচেয়ে বিখ্যাত একটি মুহূর্ত। হেড থেকে পেলের গোল যখন অবধারিতভাবেই জালে জড়াবে বলে মনে হচ্ছিলো, সেই অন্তিম মুহূর্তে গর্ডন ব্যাংকস পেলের শট ঠেকিয়ে দেন, যেটিকে বলা হয় 'দ্য সেভ অব দ্য সেঞ্চুরি'।
কিন্তু তা সত্ত্বেও ফাইনাল অবধি পৌছায় ব্রাজিল এবং ফাইনালে ইতালির বিরুদ্ধে ৪-১ গোলের জয়ের মাধ্যমে তিনবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা জুলে রিমে ট্রফি চিরকালের জন্য নিজেদের করে নেয়। আর হ্যা, সেই সঙ্গে পেলের গোল তো ছিলই।
১৯৭১ সালের ১৮ জুলাই রিওতে যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিলের হয়ে শেষ ম্যাচটি খেলেন পেলে। এরপর ১৯৭৪ সালে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ফুটবল থেকে অবসর নেন পেলে।
এর দুই বছর পর তিনি নিউইয়র্ক কসমসের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। শুধুমাত্র পেলের নামের জোরেই যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলের গুরুত্ব বেড়ে যায় অনেক গুণ।
শুভেচ্ছা দূত
১৯৭৭ সালে পেলের অবসরকে স্মরণীয় করে রাখতে কসমস-সান্তোসের ম্যাচ আয়োজন করা হয়, দুই দলের হয়েই অর্ধ-অর্ধ সময় খেলেছিলেন পেলে।
ততদিনে পেলে বিশ্বের সর্বোচ্চ আয়কারী একজন ক্রীড়াবিদ হিসেবে পরিচিত, কিন্তু অবসরের পরেও পেলের তারকাখ্যাতি তাকে অর্থ এনে দিয়েছে।
সিলভেস্টার স্ট্যালন ও মাইকেল কেইনের ১৯৮১ সালে চলচ্চিত্র 'এসকেইপ টু ভিক্টোরি'তে অভিনয়ের মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন জগতে পা রাখেন পেলে। এছাড়াও, একাধিক স্পন্সরশিপ ও এনডর্সমেন্টের মাধ্যমেও অনেক টাকা উপার্জন করেছেন তিনি। কারণ শুধুমাত্র 'পেলে' নামটির মূল্য ছিল বিশ্বের অন্য অনেক মূল্যবান জিনিসের চেয়ে বেশি।
১৯৯২ সালে জাতিসংঘের বাস্তুসংস্থান ও পরিবেশ বিষয়ক দূত নির্বাচিত হন পেলে এবং পরে তাকে ইউনেস্কোর শুভেচ্ছা দূত নির্বাচন করা হয়।
এর পাঁচ বছর পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে বাকিংহাম প্যালেসে পেলেকে সম্মানসূচক নাইট কমান্ডার উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
১৯৫৫ সালে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ফার্নান্দো হেনরিকে করডোসো পেলেকে ব্রাজিলের ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন এবং ব্রাজিলের ফুটবল খাতে দুর্নীতির অবসানকল্পে প্রধান ভূমিকা রাখেন পেলে। ব্রাজিলে ফুটবল পরিচালনা খাতের আধুনিকায়নের লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালে একটি আইন পাশ করেন পেলে।
কিন্তু খোদ পেলের ওপরেই দুর্নীতির অভিযোগ আসার পর তিনি ইউনেস্কোর শুভেচ্ছাদূতের পদ ছেড়ে দেন, যদিও তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
২০১৬ সালে অলিম্পিকে রিও ডি জেনেইরোতে অলিম্পিকে ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখেন পেলে। এর আগে ২০০৫ সালে তিনি 'বিবিসি'স স্পোর্টস পারসোনালিটি অব দ্য ইয়ার' অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছিলেন পেলে।
ব্যক্তিগত জীবন
পেলে ১৯৬৬ সালে রোজমেরি দস রেইস চোলবিকে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে দুই মেয়ে ও এক ছেলের জন্ম হয়। ১৯৮২ সালে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর ফিল্ম তারকা জুজার সাথে সম্পর্কে জড়ান পেলে।
পেলে দ্বিতীয় বিয়ে করেন আসিরা লেমোস সেইজাস নামের এক গায়িকাকে। এই সংসারে পেলের যমজ সন্তান রয়েছে, কিন্তু এই বিয়েও টেকেনি পেলের।
২০১৬ সালে মার্সিয়া চিবেলে আওকি নামের একজন জাপানি-ব্রাজিলিয়ান নারী ব্যবসায়ীকে বিয়ে করেন পেলে, যার সাথে পেলের প্রথম পরিচয় হয়েছিল ১৯৮০ সালে।
অনেকে দাবি করেন, এ সম্পর্ক থেকেও পেলের সন্তান রয়েছে কিন্তু তিনি তাদের স্বীকৃতি দেননি।
সাম্প্রতিক সময়ে পেলে একাধিক শারীরিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করেন। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে তার কোলন (মলাশয়) থেকে টিউমার সরানো হয় এবং বছরখানেক যাবত তিনি কেমোথেরাপি নিচ্ছিলেন।
শারীরিকভাবে যতই কাহিল হন না কেন, নিজের স্বভাবজাত রসিকতা দিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে ভালোবাসতেন পেলে। ২০২২ সালের নভেম্বরে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে ইনস্টাগ্রামে একটি পোস্টে পেলে মজা করে লিখেছিলেন, 'মাসিক পরিদর্শনের' উদ্দেশ্যে হাসপাতালে যাচ্ছেন তিনি। এসময় তিনি কাতার বিশ্বকাপের আয়োজকদেরও ধন্যবাদ জানান, যেখানে একটি ভবনে বিশাল অক্ষরে লেখা ছিল- 'দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন, পেলে।'
বিশ্বব্যাপী এক ব্র্যান্ড
ফুটবল সম্পর্কে সামান্য জানেন বা ফুটবল ভালোবাসেন এমন যেকোনো মানুষ পেলের নাম শোনামাত্রই তাকে চিনতে পারবেন, তা তিনি বিশ্বের যে স্থানেই থাকেন না কেন। এবার পেলে নিজেও মজা করে বলেছিলেন যে সারা বিশ্বে মাত্র তিনটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড আছে- জেসাস, কোকা কোলা ও পেলে!
পেলে ছিলেন ওই সকল ব্যক্তিদের একজন, যারা নিজের ক্রীড়া দক্ষতাকে অতিক্রম করেও সারা বিশ্বে খ্যাতি পেয়েছেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে গিয়ে নিতম্বে একটি অপারেশনের ফলে সোজা হয়ে দাড়াতে কষ্ট হতো পেলের; ফলে হুইল চেয়ারে বসে কাটাতে হয়েছে তাকে।
কিন্তু জীবনের সোনালি সময়ে পেলে ছিলেন বিদ্যুতের গতিতে ছুটে চলা এক খেলোয়াড়, ডিফেন্ডারদের ত্রাস, গোলবারের সামনে গোলকিপারদের ভীতির কারণ; সেই সাথে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের হৃদয় জিতে নেওয়া এক ফুটবলার। তার প্রতিভার ঔজ্জ্বল্য ছিল এত বেশি যে সতীর্থ ও প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রাও তাকে সম্মান করতে বাধ্য হতেন।
বিখ্যাত হাঙ্গেরিয়ান স্ট্রাইকার ফেরেন্স পুসকাস পেলেকে স্রেফ একজন খেলোয়াড় হিসেবে আখ্যা দিতে রাজি ছিলেন না। তিনি মনে করতেন, 'পেলে একজন খেলোয়াড়ের চেয়েও বেশি কিছু।'
কিন্তু সম্ভবত দক্ষিন আফ্রিকার কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাই পেলের জীবনকে সবচেয়ে ভালোভাবে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করতে পেরেছেন। ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, "পেলেকে খেলতে দেখা মানে একটি শিশুর আনন্দ ও এর সঙ্গে একজন পুরুষের ঐশ্বরিক গুণের সমন্বয় দেখা।"
৩০ ডিসেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন ফুটবলের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র, কিংবদন্তি ও সর্বকালের সেরা ফুটবলার পেলে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে প্রবাদ রয়েছে- 'কীর্তিমানের মৃত্যু নেই'। পেলের গোটা ক্যারিয়ারের দিকে তাকালে নিঃসন্দেহে এই বাক্যটিই সত্যি মনে হয়। পেলে এমনই এক নক্ষত্র যার মৃত্যু নেই; বিশ্বের কোটি মানুষের আবেগে-ভালোবাসায় আর ফুটবলের ইতিহাসের পাতায় পাতায় অমর হয়ে থাকবেন পেলে।
সূত্র: বিবিসি